Advertisement
০৬ মে ২০২৪
Adil Hussain

‘ছেলে জন্মের পর থেকেই বাবার প্রতিযোগী’

কখনও মনে হয়, নিজের মৃত্যুকে উপলক্ষ করে ছেলের চাপ থেকে নাতনিকে বাঁচার সুযোগ করে দিতেই রাজীবকে পরিবার থেকে সরিয়ে কাশীতে নিয়ে আসেন তিনি। মুক্তি ভবনের ঘরে মরতে মরতেও ফিরে আসেন দয়া। কখনও বিমলাজির স্নেহস্পর্শে একই সঙ্গে খুঁজতে থাকেন বাঁচার অর্থ, মৃত্যুপথের হদিশ। শুভাশিসের ছবি দেখায়, মৃত্যু জীবনের বিপরীত ছবি নয়, জীবনের অনিবার্য সঙ্গী।

মুক্তি ভবন ছবিতে আদিল হুসেন।

মুক্তি ভবন ছবিতে আদিল হুসেন।

রাজীবাক্ষ রক্ষিত
গুয়াহাটি শেষ আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ১৪:১৫
Share: Save:

দু’দিন আগেই ওয়াশিংটন ডিসিতে হওয়া দক্ষিণ এশিয়া চলচ্চিত্র উৎসবে ‘মুক্তি ভবন’ ছবির জন্য সেরা অভিনেতার শিরোপা মাথায় উঠেছে। তার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ঘরের মাটিতে পা রেখেছেন। হোটেলের ঘর থেকে গুয়াহাটির পাহাড়ের ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোডও করেছেন। জাতীয় পুরস্কারে ‘স্পেশ্যাল জুরি অ্যাওয়ার্ড’ পকেটে। মুক্তি ভবন নিয়ে বিশ্বের যেখানেই যাচ্ছেন তুমুল প্রশংসা, পুরস্কারে ভরছে ঝুলি। কিন্তু স্বভূমির দর্শকের কাছে ঘরের ছেলের স্বীকারোক্তি, নিজেকে মোটেই বড় অভিনেতা ভাবছেন না। বরং ‘ডিরেক্টর্স অ্যাক্টর’ হওয়াই তাঁর লক্ষ্য। এক সময় ১০ ঘণ্টা সেটে থেকে ১০ মিনিটের চরিত্র পেতেন। এখন তাঁর জন্যই চরিত্র তৈরি হচ্ছে। ‘ইশকিয়া’ থেকে ‘লাইফ অফ পাই’, ‘জাসুস বিজয়’ থেকে ‘মুক্তি ভবনে’র এই যাত্রায় কখনও অসুখী অভিনেতা, কখনও চরম দার্শনিক আদিল হুসেনকে পেল ‘ব্রহ্মপুত্র ভ্যালি চলচ্চিত্র উৎসব’-এর প্রথম রাত। যেখানে উত্তর-পূর্বের দর্শকদের জন্য মুক্তি ভবনের স্পেশ্যাল স্ক্রিনিং নিয়ে হাজির আদিল ও পরিচালক শুভাশিস ভুটিয়ানির বাবা তথা ছবির প্রযোজক সঞ্জয় ভুটিয়ানি।

‘মুক্তি ভবন’ বা ‘হোটেল স্যালভেসন’- ছবির কাহিনি বাবা-ছেলে আর বারাণসীকে ঘিরে আবর্তিত। মৃত্যুর সময় ঘনিয়েছে ধরে নিয়ে ৭৭ বছরের দয়াশঙ্কর শর্মা (ললিত বেহল) কাশীবাসী হবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন। বাধ্য হয়ে অফিস ছুটি নিয়ে ছেলে রাজীব (আদিল হুসেন) বাবাকে নিয়ে আসেন বারাণসীতে গঙ্গার পারে মুক্তি ভবনে। যেখানে সচরাচর মরণাপন্নদের নিয়ে আসা হয়। হাতে মরার জন্য সময় থাকে ১৫ দিন। তার পরেই ঘর খালি করতে হবে, জানান ম্যানেজার মিশ্রজি। বারাণাসীর সেই ছোট্ট ঘর, সরু গলি, সুপ্রাচীন ঘাট, গঙ্গার বুকে বাবা আর ছেলের সম্পর্কের আলো-আঁধারি খেলা করতে থাকে ২৪ বছরের পরিচালক শুভাশিসের অদ্ভুত মুন্সিয়ানা আর ক্যামেরার রেট্রো-টাচে। গোটা ছবিতে রাজীবের স্ত্রীর ভূমিকায় গীতাঞ্জলি কুলকার্নির আন্ডার-অ্যাক্টিং নজর কাড়ে। আপাতদৃষ্টিতে জেদি, আত্মকেন্দ্রীক দয়াশঙ্করই গোপনে নাতনি (পালমি ঘোষ) কে বিয়ের ফাঁদ থেকে পালিয়ে চাকরি পেতে সাহায্য করেন। কখনও মনে হয়, নিজের মৃত্যুকে উপলক্ষ করে ছেলের চাপ থেকে নাতনিকে বাঁচার সুযোগ করে দিতেই রাজীবকে পরিবার থেকে সরিয়ে কাশীতে নিয়ে আসেন তিনি। মুক্তি ভবনের ঘরে মরতে মরতেও ফিরে আসেন দয়া। কখনও বিমলাজির স্নেহস্পর্শে একই সঙ্গে খুঁজতে থাকেন বাঁচার অর্থ, মৃত্যুপথের হদিশ। শুভাশিসের ছবি দেখায়, মৃত্যু জীবনের বিপরীত ছবি নয়, জীবনের অনিবার্য সঙ্গী।

আগে না হয় পর্দার কাজ কম ছিল, কিন্তু এখনকার বলি-হলি চষা ব্যস্ত অভিনেতা আদিল এমন অদ্ভুত বিষয়, আনকোরা, বাচ্চা পরিচালকের ছবি করতে রাজি হলেন কেন?
• আদিল: ভাল গল্প হলে আমি স্ক্রিপ্ট পাওয়া পর্যন্তও অপেক্ষা করি না। টাকার দরদাম তো নয়ই। এই ছবির ক্ষেত্রেও বিষয়টা জাস্ট হোয়াট্‌সঅ্যাপে পড়েই মনে হয়েছিল, চরিত্রটা আমায় করতে হবে। আর ২৩ বছরের শুভাশিসের প্রথম ছবি ‘কুশ’ ভেনিসে সেরা হয়। ২৪ বছর বয়সে যে ছেলে মুক্তি ভবন-এর মতো গল্প ভাবতে পারে, পরিচালনার সাহস দেখায়— তখন আমার ভিতরের অভিনেতা তো তাতে সাড়া দেবেই।

কিন্তু মৃত্যু আর জীবনের এমন আশ্চর্য চিত্রনাট্যে নিজেকে ঢালতে সমস্যা হয়নি?


মুক্তি ভবন ছবির একটি দৃশ্য।
• আদিল: ঠিক উল্টোটাই। কারণ আমার জীবন ও দর্শনের খুব কাছে এই ছবিটা। ২০০৩ সাল। আমি তখন পাকিস্তান সীমান্তের কাছে জাজুস বিজয়ের শুটিং করছি। মনে আছে, রাত ৮টায় শুটিং ব্রেকে বাড়ি থেকে ভাই ফোন করে জানাল, বাবা মারা গিয়েছে। তখনই পিছন থেকে সহকারী পরিচালক জানালেন, পরের শট রেডি। ঝাড়া দু’ঘণ্টা ফের শুটিং করলাম। পরে ভাবলাম, আমি কি অস্বাভাবিক? বাবা মারা গিয়েছেন। কোনও দুঃখ বোধ নেই। কান্না নেই! কিন্তু মন বোঝালো, এটাই স্বাভাবিক ছিল আমার ক্ষেত্রে। কারণ প্রথমে রামকৃষ্ণ, পরে ১৯৯৬ সালে অরবিন্দ্র আশ্রমে অনিবার্য মৃত্যুকে সাদরে গ্রহণ করার কথা শুনি। তার পর এ নিয়ে অনেক বই পড়েছি, চর্চা করেছি। তাই বাবার মৃত্যুও ছিল তেমনই আমার কাছে এক স্বাভাবিক, অনিবার্য বিষয়। অনিবার্যকে ঠেকানো যায় না। তাই তাকে গ্রেসফুলি মেনে নেওয়াই ভাল। ভারতে কিন্তু হাজার বছর আগে থেকেই এই আদর্শ চলছে। বৈদিক থেকে বৌদ্ধ ধর্ম— সবেতেই এই কথা রয়েছে। আমি নিজেও এই দর্শনে বিশ্বাসী। তাই মৃত্যু আমার কাছে এক উদ্‌যাপন। শুভাশিসও ছবিটা ঠিক সে ভাবেই ভেবেছে।

তা হলে অভিনয় করতে গিয়ে আগে থেকেই রেফারেন্স একটা নিজের ভিতরে ছিল?
• আদিল: প্রতি বার নতুন করে একটা চরিত্রকে ভাবতে হয়। কোনও চরিত্র পেলে নিজের যা মনে আসে, তা জোর করে ভুলে যাই। পরিচালককে জিজ্ঞেস করি কী চাইছেন তিনি। অভিনয় করার আগেই বেশি বুঝে বা জেনে গেলে মিডিওক্রিটি এবং পতন শুরু। করতে করতে শেখার ম্যাজিকটাই আলাদা। সেটা পারিশ্রমিকের চেয়েও বড় পাওনা।

তিন দশকের পোড় খাওয়া অভিনেতার পক্ষে সদ্য যুবা, অনভিজ্ঞ পরিচালকের কথা মেনে চলতে ইগোয় লাগেনি? মনে হয়নি, এ আবার আমায় কী শেখাবে?
• আদিল: আমি কিন্তু মনে করি, একটা সিনেমা পুরোপুরি পরিচালকের সম্পত্তি, সন্তান। অভিনেতারা খণ্ড-খণ্ড ছবি বুঝতে পারেন। কিন্তু পরিচালকের মাথায় গোটা ছবিটা পরিষ্কার থাকে। অভিনেতার বেশি পাকামো করে লাভ নেই। তার ফুটেজ এডিটিং টেবলে কাটা যেতে পারে। মিউজিক টেবলেও কত কিছু বদলে যায়। তাই পরিচালককে ছোট করে দেখা ধৃষ্টতা। তার বয়স যাই হোক। আর অন্যকে পরামর্শ দেওয়া দূরের কথা, আমি নিজে ৩৫ বছর ধরে শুধু ভাল অভিনেতা হওয়ারই চেষ্টা করে চলেছি। আমার ছাত্রদেরও বলি, পরিচালকের কাছে নিজেকে পুরো সমর্পণ করতে শেখ। আর শুভাশিসের চিন্তার ব্যাপকতা, সৃজনশীলতা, ভদ্রতার সঙ্গে অ্যাং লি-র মিল পাই।

আজকাল অনেক অন্য শহর বলিউডি ছবিতে জায়গা করে নিচ্ছে। মুক্তি ভবনে বারাণসীতে কাজ করার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
• আদিল: শুভাশিস সত্যিকারের মুক্তি ভবনে গিয়ে, সেখানকার আবাসিকদের সঙ্গে কথা বলে আবেগতাড়িত হয়ে পড়েছিল। তার পরেই চিন্তাটা আসে। এই ছবিতে বারাণসী শুধু স্থান নয়, নিজেই একটা চরিত্র। আমি প্রথম বার প্রেমিকার ডাকে বারাণসী গিয়েই কাশীর প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। শহরটায় এমন কিছু আছে, যা চট করে আপনার মন হাল্কা করে দেবে, ‘পজিটিভ ভাইব’ দেবে। এখনও মনে আছে, প্রথম মণিকর্ণিকা ঘাটে দাঁড়িয়েছি। দেহ পুড়ছে। নাকে মাংস পোড়া গন্ধ। কিন্তু মনটা তাও খুশি-খুশি। যে কেউ শুনকে পাগল ভাবতে পারে। কিন্তু এটাই আমাদের কাশীর মাহাত্ম্য। যেখানে জীবন-মৃত্যু মিলেমিশে অনন্য কোলাজ হয়ে ওঠে। এই ছবিটা খুব কম টাকায় করা। কিন্তু বারাণসীর দিনগুলোই অমূল্য। ছবির জন্য ভাত খেয়ে মোটা হওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। তার পরেও পেটে প্যাড বাঁধতে হয়েছে।

আরও পড়ুন, ইনি এক বিখ্যাত বলিউড অভিনেত্রী, চিনতে পারছেন?

এত দেশে যাচ্ছে ‘মুক্তি ভবন’। মৃত্যুকে উদ্‌যাপন করার কাহিনি অন্য দেশগুলো কেমন ভাবে গ্রহণ করছে?
• আদিল: ভিয়েনায় ছবির প্রিমিয়ার হয়েছিল। সেখানে দর্শক অনেক ক্ষণ দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়েছিলেন। এক জার্মান ক্রু-র মুখে আগে কখনও কোনও অভিব্যক্তি দেখিনি। এই ছবিটা তাঁকে দেখানোর পরে সাড়ে ছ’ফুটের ওই রুক্ষ লোকটির চোখ ভিজে যায়। বলে, বাবাকে আগে ফোন করে নিই। এগুলোই তো বড় পাওনা। আর হাওয়াই, মেক্সিকোতেও কিন্তু অনেক মানুষ মৃত্যুর জন্য অনেক দিন তৈরি হতে থাকেন। ছবিটা ৪০টি দেশে দেখানো হবে। ইংল্যান্ড ও ইতালিতে এখন চলছে। সর্বত্রই প্রশংসিত। একেবারে অন্য এক সংস্কৃতি, জীবনযাত্রা, ভাষার একটি ছবিকে সকলে আপন করে নিচ্ছে। এখানেই তো মৃত্যুর জয়। জীবনের জয়।

বাবা-ছেলের সম্পর্ক নিয়ে তৈরি ছবিটা যদি বাবা-মেয়ে বা মা-ছেলের সম্পর্ক নিয়ে হত?
• আদিল: আমিও ভেবেছিলাম দিকটা। আসলে এমনিতেই বাবাদের মুখ্য চরিত্র করে ছবি কম হয়। আর বাবা-ছেলের সম্পর্কের শেডসগুলো হয় অদ্ভুত। তাতে সিনেমার উপাদান সরাসরি না থাকলেও একটা আন্ডারকারেন্ট কাজ করতে থাকে। এই দেখুন না, আমার ছেলে কবীর জন্মানোর পরেই বউয়ের মনোযোগ সব ছেলের দিকেই। মেয়ে হলে সমস্যাটা হত না। কিন্তু ছেলে জন্মের পর থেকেই বাবার প্রতিযোগী। হিংসা নয়, নিজের একচ্ছত্র আধিপত্য চলে যাওয়ার একটা ইরিটেশন হয়। যেটা পরে বাপ-বেটার ইগোর লড়াইতে দাঁড়িয়ে যায়।

আরও পড়ুন, বিকিনি পড়া ছবি পোস্ট করে ট্রোলড তাপসী, দিলেন যোগ্য জবাবও

সিনেমায় এত সাফল্য, পরিচিতি, পুরস্কারের পরে আর থিয়েটারে ফেরার খিদে থাকবে?
• আদিল: থাকবে মানে, আমি তো ভাবছি এ বার থেকে সেটাতেই বেশি মন দেব। আমি প্রধানত থিয়েটারের শিল্পী— যে যত ক্ষণ সেটে থাকবে অভিনয় করে যেতে চাইবে। কিন্তু সিনেমায় তা কোথায়? অভিষেক চৌবে ২০০৮ সালে ইশকিয়া ছবিতে আমায় বড় রোল দিয়েছিলেন। সেই থেকেই সিনেমায় সুযোগ আসছে। কিন্তু একটা থিয়েটার আমরা আড়াই মাস ধরে তৈরি করতাম। লিখতাম। তার পর রিহার্সাল শুরু। ১০ বছর ধরে ‘ওথেলো’ করার পরে এক দিন মনে হয়েছিল এত দিন পরে বেশ ভাল অভিনয় করলাম। তার পরেও একই অভিনয় চালিয়ে যেতে বোর লাগেনি। কিন্তু সিনেমা করতে গেলে মনে হয়, উফ, আগামী কাল আবার শুটিং আছে। নিজেকে ঠেলতে হয়। থিয়েটারে আমায় দর্শকের কাছে সরাসরি পৌঁছতে হবে। সিনেমায় ক্যামেরাই আমার কাছে আসছে। আমি স্বার্থপর অভিনেতা। তাই ক্যামেরা কখন আমার দিকে তাকাবে তার অপেক্ষায় থাকার চেয়ে মঞ্চের প্রতিটা ইঞ্চি শুষে নিতে চাই।

নিজস্ব চিত্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE