২৪তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের শেষ দিনে হাজির ছিলেন অভিনেত্রী তব্বু।— ফাইল চিত্র।
শেষ হল ২৪তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। গত সাত দিনে উৎসবে ভাল খারাপ মিলিয়ে অনেক ঘটনাই ঘটল। সিনেপ্রেমীদের ছবি দেখার উন্মাদনা, উৎসবের ছবির নির্ঘণ্ট নিয়ে সমস্যা এবং তাই নিয়ে দর্শকদের ক্ষোভ, জ্যঁ লুক গোদার, কিম কি ডুক, গ্যাসপার নোয়ে, লার্স ভন ট্রায়ার প্রভৃতি এই সময়ের উল্লেখযোগ্য পরিচালকদের নতুন ছবির প্রদর্শন, বিশ্ববরেণ্য ইরানি চিত্র পরিচালক মাজিদ মাজিদির উপস্থিতি, ফেস্টিভ্যাল সম্পর্কে পরিচালক অনীক দত্তর বক্তব্য এবং সেটা ঘিরে বিতর্ক, বড় পর্দায় নতুন করে ‘পথের পাঁচালী’ প্রদর্শন, পুরনো বাংলা ফিল্ম সংরক্ষণ নিয়ে পরিচালক শিবেন্দ্র সিংহ দুঙ্গারপুরের কর্মকাণ্ড, বিখ্যাত হলিউড পরিচালক ফিলিপ নয়েসের মাস্টার ক্লাস আর ষষ্ঠ দিনে ‘আসা যাওয়ার মাঝে’ খ্যাত পরিচালক আদিত্য বিক্রম সেনগুপ্তের নতুন ছবি ‘জোনাকি’র প্রদর্শন নিয়ে বিভ্রান্তি এবং প্রদর্শন।
ছবি দেখা নিয়ে প্রতি দিনই নন্দন চত্বরে প্রবল ভিড় ছিল। ভাল ছবি দেখার জন্য মানুষ দেড়-দু’ঘণ্টা অবধি লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। গোদারের ‘দ্য ইমেজ বুক’, গ্যসপার নোয়ের ‘ক্লাইম্যাক্স’ আর লার্স ভন ট্রায়ারের ‘দ্য হাউজ দ্যাট জ্যাক বিল্ড’ দেখার জন্য লোকে নন্দনের সামনে আড়াই ঘণ্টার বেশি লাইন দিয়েছিল। এ দিকে প্রথম দিন থেকেই সমস্যা করেছিল ফেস্টিভ্যালের ছাপানো নির্ঘণ্ট। সেটা ছিল ভুলে ভরা। ফলে কিছু কিছু প্রেক্ষাগৃহে কখন কোন ছবি হবে তাই নিয়ে চরম বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছিল। পরে অবশ্য নতুন নির্ঘণ্ট ছাপিয়ে সেটা শুধরে নেওয়া হয়।
ফেস্টিভ্যালে রেট্রোস্পেক্টিভ হল পরিচালক মাজিদ মাজিদির। তিনি নিজে উৎসবে উপস্থিত ছিলেন। তার চারটি ছবির মধ্যে ‘মুহাম্মদ’ ছবিটা নিয়ে খুবই উৎসাহ ছিল। এটা ইরানের সবথেকে বেশি বাজেটের ছবি। সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন এ আর রহমান। কিন্তু ছবিটা দর্শকের মন ভরাতে পারেনি। কিন্তু মন ভরিয়েছে কিম কি ডুক এবং গ্যাসপার নোয়ের ছবি। গোদারের বাংলায় একটা স্ট্রং ফ্যান বেস আছে। ফলে তার ছবি নিয়ে প্রবল উন্মাদনা থাকে। বিগত কিছু বছর ধরে তিনি ব্যক্তিগত ডায়েরি লেখার মতো করে ছবি বানাচ্ছেন। এ বারের ‘দ্য ইমেজ বুক’ সে রকমই একটি ছবি।
শেষ দিনেও নন্দন চত্বরে ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল নিয়ে মানুষের উন্মাদনা ছিল চোখে পড়ার মতো।
তবে আদিত্য বিক্রমের নতুন ছবি ‘জোনাকি’ শুরু থেকেই খবরের শিরোনামে ছিল। উৎসব কর্তৃপক্ষ ছবিটি রবীন্দ্র সদনে দেখাবেন বলে ঠিক করেন। সেটা ছাপিয়েও দেওয়া হয়। কিন্তু আদিত্য ছবিটা নন্দনে দেখাতে চান। না হলে ফেস্টিভ্যাল থেকে ছবি উঠিয়ে নেবে বলেন। শেষ পর্যন্ত ষষ্ঠ দিন দুপুর ১টায় বিশেষ স্ক্রিনিং-এর ব্যবস্থা করে নন্দন-১ এ ছবিটা দেখানো হয়। এবং দেখানোর পর দর্শক দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েন। এক দলের কাছে ছবিটা একটা বিরাট ডিজাস্টার আর আরেক দলের কাছে ওয়ার্ক অব আর্ট। এ ছাড়া পরিচালক অনীক দত্তের বক্তব্যও ছিল এবারের টক অব দ্য ফেস্টিভ্যাল। ‘ছবি পরিচালক না প্রযোজকের’ শীর্ষক আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে এসে উৎসবের প্রথম দিনই তিনি বলেন যে, “সিনেমা এখন আর পরিচালক, প্রযোজকদের ব্যাপার নয়। নন্দন প্রাঙ্গনে যাঁর ছবি ছড়িয়ে আছে, বাস্তবে তিনিই বোধহয় সিনেমার একমাত্র ব্যক্তিত্ব।” প্রসঙ্গত উৎসব প্রাঙ্গণে বিভিন্ন চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বদের ছবির সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর ছবি টাঙানো হয়েছে। সবার থেকে বেশি ওঁরই ছবি আছে। এই বক্তব্য নিয়ে প্রবল অশান্তি হয়।
আরও পড়ুন: বাংলা চলচ্চিত্রের শতবর্ষ! কে বলল?
আরেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল অস্ট্রেলিয়ায় জন্মানো বিখ্যাত হলিউড চিত্র পরিচালক ফিলিপ নয়েসের মাস্টার ক্লাস। ফিলিপ বিভিন্ন সময় অ্যাঞ্জেলিনা জোলি, হ্যারিসন ফোর্ড, মেল গিবসন, ডেঞ্জিল ওয়াশিংটন, নিকোল কিডম্যান প্রমুখ তাবড় তাবড় অভিনেতাদের নিয়ে ‘দ্য বোন কালেক্টর’, ‘সল্ট’, ‘ডেড কাম’, ‘প্যাট্রিয়ট গেমস’ প্রভৃতি বিখ্যাত সব ছবি বানিয়েছেন। উৎসবের তৃতীয় দিন নন্দন-৩-তে উনি একটা মাস্টার ক্লাস নিলেন। যাতে সিনেমার ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে অংশ গ্রহণ করেছিল ফেস্টিভালের ডিরেক্টর মহুয়া বন্দ্যোপাধ্যায়, ফেস্টিভ্যালের আহ্বায়ক ঋতব্রত ভট্টাচার্য ও আরেক অস্ট্রেলীয় হলিউড চিত্র পরিচালক গার্থ ডেভিস। গার্থ ডেভিস যিনি ২০১৬ তে ‘লায়ন’ ছবিটা বানিয়ে ছয়টি বিভাগে অস্কার নমিনেশন পেয়েছিলেন। সে এক দুর্দান্ত ক্লাস। তাঁর পঞ্চাশ বছরের ছবি তৈরির অভিজ্ঞতা ছাত্রদের সঙ্গে শেয়ার করলেন ফিলিপ। যারা ক্লাসটা করলেন তাদের কাছে এটা খুব বড় একটা প্রাপ্তি।
শেষ দিন দর্শককূল মজে গিয়েছিলেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় এবং ডোনা গঙ্গোপাধ্যায়ের কন্যা সানার নৃত্য প্রদর্শনে।
এ ছাড়া এ বারের উৎসবে ‘রেস্টর্ড ক্লাসিক’ বলে একটা বিভাগ রাখা হয়েছিল। যাতে বিভিন্ন ক্লাসিক ছবির পুনরুদ্ধার করা ভার্শন দেখানো হয়। যার প্রথম ছবি হিসেবে দেখানো হল সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’। সে এক অভুতপূর্ব অভিজ্ঞতা। কিন্তু এ বারের উৎসবের সবথেকে গুরূত্বপুর্ণ বিষয় হল ফিল্ম রেস্টিরেশন নিয়ে ওয়ার্কশপ। ভারতীয় পরিচালক শিবেন্দ্র সিংহ দুঙ্গারপুরের ফিল্ম হেরিটেজ ফাউন্ডেশন অনেক দিন ধরেই পুরনো ভারতীয় ছবির ফিল্ম নেগেটিভ সংগ্রহ হরে তার পুনরুদ্ধারের কাজ করে আসছে। এই ভাবে তারা ৩০০ ছবির প্রিন্ট যোগার করেছেন এবং সেগুলো লালন করছেন। এ বার তাঁরা বাংলা ছবি নিয়ে কাজ করা শুরু করছেন। ফেস্টিভ্যালের পঞ্চম দিন সেই প্রজেক্টের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়ে গেল রবীন্দ্র সদনে এবং তার আরেকটা অংশ হচ্ছে আইসিসিআর-এ। সেখানে ছাত্রছাত্রীদের ফিল্ম প্রিজারভেশন ও রেস্টোর করার ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে। আশা করা যায় শিবেন্দ্রর এই কাজ বহু বাংলা ছবিকে নষ্ট হয়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে সাহায্য করবে। ইতিমধ্যে তারা উদয় শঙ্করের বিখ্যাত ছবি ‘কল্পনা’-কে পুনরুদ্ধার করেছে। তাতে খরচ হয়েছে ১ কোটি টাকা। রাজ্য সরকার এই কাজে শিবেন্দ্রর সংস্থাকে সাহায্য করছে। সম্প্রতি ফিল্ম হেরিটেজের অফিস মুম্বই থেকে কলকাতায় স্থানান্তরিত করা হয়েছে। এ বারের উৎসবের এটা সত্যিই একটা বড় পাওনা।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশের ওয়েব সিরিজে প্রথম গান গাইলেন ইমন
চলচ্চিত্র উৎসব আসবে, চলেও যাবে। কিন্তু প্রতি বারের উৎসব মানুষের মনে কিছু কিছু ঘটনা গভীর ভাবে রেখাপাত করে যায়। পরবর্তীকালে সেই ঘটনাগুলি দিয়ে মানুষ একেকটি উৎসবের স্মৃতিচারণ করে। সেই যে বার ফেস্টিভ্যাল আওন্তোনিওনি এসেছিলেন, সেই যে বার সোলানাস এসেছিল, আর সেই বারের ফেস্টিভ্যালটা যে বার নন্দনে ‘অ্যাসাসিন’ দেখা নিয়ে বড় বিতর্ক হল- সিনে প্রেমীদের এরকম কথা আমরা শুনতে পাই। এ বারের উৎসবে আগের ঐতিহ্য মেনে এই সব স্মৃতি যুক্ত হল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy