মাটিতে বসে তখন একা একা কাঁদছেন মুনমুন সেন।
কাঁদছেন আর কপালে ঘোমটা টেনে নীল নেলপলিশ লাগানো আঙুলগুলো দিয়ে আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন সামনে রাখা পিণ্ডগুলোর উপর।
মেয়ে রিয়া একটু দূর থেকে মায়ের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে পাশে এসে বসলেন। পুরোহিত তখন বোঝাচ্ছেন কেন দরকার ছিল এই ‘মাতৃপিণ্ড দান’ করা।
‘‘এক বছর আত্মা প্রেতলোকে থাকে, আজকে এই পুজো করার পর আপনার মাতাজি চিরতরে পিতৃলোকে চলে গেলেন। এ বার নিজের মতো করে একটু মাকে স্মরণ করুন।’’
পলকের মধ্যে চোখে জল ভরে এল কন্যার।
কোনও ক্রমে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে শান্ত কণ্ঠে পুরোহিতকে বললেন, ‘‘পণ্ডিতজি, করছি মাকে স্মরণ।’’
তারপর আনমনা হয়ে নিজের মনেই বলতে থাকলেন, ‘‘মাই মাদার ওয়াজ আ স্পেশাল মাদার... মাই মাদার ওয়াজ আ স্পেশাল মাদার...।’’
মহাপ্রস্থানের পথের শেষ ধাপটা নিজের জন্মদিনে পেরিয়ে গেলেন মহানায়িকা।
আগে কেক নিয়ে যেতাম, আজ পিণ্ড দান করতে এসেছি
৬ এপ্রিল তাঁর জন্মদিন।
এক বছরের বাৎসরিক কাজ আগেই হয়ে গিয়েছে। কিন্তু পরিবারের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর পরামর্শে সোমবার সকালে আমদাবাদ থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরে সিধপুরের ছোট্ট মন্দির ‘মাত্রুগয়া’তে (মাতৃতীর্থ) পিণ্ডদান করতে এসেছিলেন মুনমুন সেন। জন্মদিনেই মা-কে অন্তিম শ্রদ্ধার্ঘ্য জানিয়ে গেলেন।
এখানে এসে জানা গেল সারা পৃথিবীতে একমাত্র এখানেই শুধুমাত্র মায়ের পিণ্ডদান হয়। কথিত আছে কপিলমুনি থেকে পরশুরাম সবাই তাঁদের মায়ের শ্রাদ্ধ এখানেই করেছিলেন। সেখান থেকেই স্থানমাহাত্ম্য।
গ্রামের বাসিন্দারা জানালেন, অমিতাভ বচ্চন থেকে উমা ভারতী— সবাই ঘুরে গিয়েছেন মাত্রুগয়া। সোমবার সকাল সাতটার সময় আমদাবাদ থেকে বেরিয়ে সাদা বিএমডব্লিউ চড়ে ন’টার মধ্যেই মাত্রুগয়া পৌঁছে গেলেন মুনমুন সেন।
গাড়ি থেকে তাঁকে আর রিয়াকে নামতে দেখে মানুষ ছোটাছুটি করলেও সেটা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে একেবারেও পৌঁছল না।
পুণে থেকে বিশেষ পুরোহিত ততক্ষণে হাজির। এঁরাই করবেন আজকের পুজো। হাত জোড় করে একে একে তাঁদের সবার সঙ্গে কথা বললেন। পাশের চেয়ারে বসা মাত্রই বুঝতে পারলাম সুচিত্রা-কন্যার নস্টালজিয়ার অ্যালবামের সেই রঙিন পাতাগুলো হুহু করে পাল্টাতে শুরু করেছে।
‘‘আজ মা-র জন্মদিন। আগে কত মজা হত মায়ের জন্মদিনে। আমরা সবাই কেক নিয়ে যেতাম মায়ের কাছে, জড়ো হতাম মা-র ফ্ল্যাটে, মা কেক কাটতেন। মাসিরা আসত বিকেলে। আড্ডা চলত কতক্ষণ। আর আজ মা-র জন্মদিনে পিণ্ডদান করতে এসেছি। ভাবলেই ভেতর থেকে কান্না পাচ্ছে। অসম্ভব খারাপ লাগছে। আর কথা বলতে পারছি না,’’ রুমালে মুখ গুঁজতে গুঁজতে বলেন রাইমা-রিয়ার মা।
সুচিত্রা...রমা...সেন
পুরোহিত ততক্ষণে পুজোর তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছেন। চট করে মাটিতে বসতে অসুবিধে হয় বলে মুনমুন কিছুক্ষণ চেয়ারে বসলেন।
‘‘পিণ্ডদানের সময় যত কষ্টই হোক না কেন, আমি কিন্তু মাটিতেই বসব,’’ পুরোহিতদের বললেন তিনি।
শুরু হল পুজো, পড়া শুরু হল মন্ত্র।
পুরোহিত মাথা নামিয়ে তাঁর কাছে জানতে চাইলেন, ‘মায়ের নাম বলুন?’
‘‘সুচিত্রা...সুচিত্রা...রমা...সেন।’’
নাম বলামাত্রই কেঁদে ফেললেন মুনমুন। তাঁর সঙ্গে আমদাবাদ থেকে আসা সকলেরই তখন চোখে জল।
পুজোর মাঝখানে মেয়ে জল দিতে চাইলেও খেলেন না।
‘‘পিণ্ডদানটা করে নিই মা, তার পর খাব,’’ রিয়াকে বলেন মুনমুন।
পুজোর ফাঁকে বলছিলেন কেন তিনি এই পিণ্ডদানকে ভয় পান এত।
‘‘এমনিতেই আমি ভীষণ প্রাইভেট, সহজে নিজের ইমোশনস দেখাই না। কিন্তু বেনারসে যখন রাইমাকে নিয়ে গিয়েছিলাম, সেই একবারই আমি আমার ইমোশন আর কন্ট্রোল করতে পারিনি। হাউহাউ করে কেঁদে ফেলেছিলাম। আর জানি না কী ভাবে মিডিয়া জেনে গিয়েছিল। দেখি হাজার হাজার ক্যামেরা। তাই এ বার আর কাউকে কিছু জানাইনি। শুধু ফ্যামিলি মেম্বাররা জানে। আর দেখলেন তো, আজও কী রকম কেঁদে ফেলছি। কী করব বলুন। মায়ের সব কিছুই তো আমি ছিলাম। বন্ধু বলুন, কথা বলার লোক বলুন। আমি নিশ্চিত সব ছেলেমেয়ের কাছেই মায়েরা একই রকম স্পেশাল। কিন্তু আমার কোনও ভাইবোন নেই। মা আমার সঙ্গেই সব শেয়ার করত। তাই হয়তো আরও বেশি খারাপ লাগছে,’’ ভেজা কণ্ঠে বলেন মুনমুন সেন।
আমাকে যেন একা থাকতে দেওয়া হয়
পুরো অনুষ্ঠানটাই যে অসম্ভব প্রাইভেট, তার আন্দাজ আগে থেকেই ছিল। তাই গুজরাটের মাত্রুগয়াতে এই অ্যাসাইনমেন্টে যাওয়ার আগে আনন্দplus-এর তরফ থেকে অবশ্যই সেন পরিবারের অনুমতি চাওয়া হয়েছিল। প্রস্তাবটা শোনার পর একদিন সময় চেয়েছিলেন তিনি।
পরের দিন ফোনে জানিয়েছিলেন, ‘‘মা থাকলে কোনও ভাবেই অ্যালাও করতেন না। কিন্তু অনেক ভেবে মনে হল মায়ের বিরাট সংখ্যক অনুরাগী তো কোনও দোষ করেননি। তাঁদের মনে তো আজও সুচিত্রা সেন রাজরানি হয়ে রয়েছেন। আমি তাঁদের বঞ্চিত করি কী ভাবে। কিন্তু একটাই শর্ত আছে আমার। পুজো চলাকালীন আমাকে যেন একটু একা থাকতে দেওয়া হয়।’’
কিন্তু সোমবার সকালে সব শর্তই কী রকম যেন ওলটপালট হয়ে গেল।
মন্ত্রপাঠ শেষ। ধীরে ধীরে পিণ্ডদান করলেন মুনমুন। পুরোহিতের কাছে জানতে চাইলেন মন্ত্রগুলোর মানে।
পুজো যখন শেষ হওয়ার মুখে, পুরোহিতরা সুচিত্রা-কন্যাকে বললেন, ‘‘যে সব কর্মে মনে হয় আপনার মা মনে মনে কষ্ট পেয়েছেন, তার জন্য মেয়ে হিসেবে ক্ষমা চেয়ে নিন। আপনি ক্ষমা চাইলে আপনার মা নিশ্চিন্তে পিতৃলোকে প্রবেশ করবেন।’’
কথা শুনে চোখ বন্ধ করলেন মুনমুন সেন। ধীরে ধীরে মায়ের হাত ধরলেন রিয়াও।
ব্যবধান শুধু একমাসের
পিণ্ডদান শেষ।
হোয়াটসঅ্যাপে দিদি রাইমাকে ছবি পাঠাতে পাঠাতে রিয়া বলছেন, ‘‘সবচেয়ে স্যাটিসফাইং লাগছে এটা ভেবে যে, দিম্মার জন্মদিনে পুজোটা হল। দিম্মা খুব ভাল থেকো তুমি। খুব মিস করি রাইমা আর আমি তোমাকে।’’
কিছুটা নিজের কথা। কিছুটা স্বগতোক্তির মতো বলে ওঠেন ছোট নাতনি।
এর মধ্যেই মুনমুন জানালেন কী রকম হঠাৎ করেই তিনি এই মাত্রুগয়া আসার প্ল্যান করেছিলেন।
রিয়ার চোখেও তখন বিষণ্ণতা।
‘‘আমি তো দশ দিন আগে শুনলাম জায়গাটার কথা। শোনার পরে ডিসাইড করি মায়ের জন্মদিনে এখানেই পুজো করব। আর কোথাও নয়। দিদি মানে মমতা (বন্দ্যোপাধ্যায়)কেও বললাম সঙ্গে সঙ্গে কারণ, এখন পুরভোটের প্রচার করছে। যদি আমার কোনও কর্মসূচি থাকত পার্টি থেকে, তা হলে সেটা ক্যানসেল করতে হত। তাই ওকে বললাম এই পুজোর কথাটা। মমতা সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘‘তুমি যাও।’’ আসলে কী জানেন! মমতার মা মারা গিয়েছেন ১৭ ডিসেম্বর আর আমার মা ১৭ জানুয়ারি, ঠিক এক মাসের ব্যবধান। কিন্তু একই তারিখ
বলে মমতার ভীষণ একটা ইমোশনাল বন্ড আছে মায়ের ব্যাপারে,’’ হাতের ঘড়িটা ঠিক করতে করতে বলেন মুনমুন।
পুরোহিত তখন মন্দির দর্শন করাতে নিয়ে যাচ্ছেন সেন পরিবারকে। দর্শন করিয়ে পিণ্ডগুলো গো-খাদ্য হিসেবে রাখা হল লাগোয়া এক গোয়াল ঘরের সামনে।
দাঁড়িয়ে থাকা দু’টো গরুর গায়েই মাতৃস্নেহে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন মুনমুন।
মন্দির ততক্ষণে তেতে পুড়ে এতটাই গরম যে খালি পায়ে আর হাঁটা যাচ্ছে না।
ধীরে ধীরে ফিরলেন তাঁরা গাড়ির কাছে।
পিছনে ফিরে একবার দেখলেন তাঁর অর্পণ করা পিণ্ডগুলো।
মনে হল শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের কোণটা মুছলেন একবার।
আর তাকালেন না ফিরে।
মন্দির চত্বরে যেন বেজে উঠল:
অসতো মা সদগময়
তমসো মা জ্যোতির্গময়
মৃত্যুর্মা অমৃতম গময়
কিছু ফুল, কিছু নৈবেদ্য নিয়ে পিতৃলোকে প্রবেশ করলেন মহানায়িকা।
সুচিত্রা... রমা... সেন।
সব ছবি: ইন্দ্রনীল রায়।
একমাত্র মাতৃপিণ্ড এখানেই
• সিধপুরের বিন্দু সরোবরই একমাত্র তীর্থ যেখানে মায়ের উদ্দেশে পিণ্ডদান করা হয়
• উপকথা, সিধপুর গঙ্গা ও সরস্বতী নদীর সঙ্গমে অবস্থিত। সরস্বতী বহু দিন লুপ্ত। আর গুজরাতে গঙ্গাও নেই। মিথ এ ভাবেই জন্মায়
• উপকথা আরও অনেক। কপিল মুনি এখানে তাঁর মা দেবহুতিকে সাংখ্য দর্শন শুনিয়েছিলেন, দেবহুতি মোক্ষলাভ করেন।
পরশুরাম এখানে মাতৃশ্রাদ্ধ করেছিলেন। দধীচি এখানে ইন্দ্রের বজ্র তৈরির জন্য জীবন বিসর্জন দেন। সবই মিথ। কেননা দধীচি ঋষি নমুচি দানবের পুত্র ছিলেন। মিথ তৈরিতে ঋষির দানব-পিতা অবশ্যই গুরুত্ব পাননি।
• বলা হয় ঋগবেদেও সিধপুরের উল্লেখ আছে। এটি বিতর্কসাপেক্ষ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy