Advertisement
১১ মে ২০২৪
Moview Review

মুভি রিভিউ: শব্দ কল্প দ্রুম শিশুদের নিয়ে ছবি, কিন্তু শিশুসুলভ নয়

সত্যি কথা বলতে গেলে ছবির গল্পে তেমন কোনও মোচড় নেই। থ্রিলার ছবি এর থেকে অনেক বেশি জটিলতা দাবি করে। এ ছবির গল্প খুবই সরল। কিন্তু যেটা আছে সেটা হল এক ধরনের ইনোসেন্স।

শব্দ কল্প দ্রুম ছবির একটি দৃশ্যে খুদেরা।

শব্দ কল্প দ্রুম ছবির একটি দৃশ্যে খুদেরা।

মেঘদূত রুদ্র
শেষ আপডেট: ০৭ জুলাই ২০১৮ ১৪:৩০
Share: Save:

ছবির প্রিমিয়ারে কলকাতার একটি মূক ও বধির শিশুদের স্কুল থেকে বেশ কিছু বাচ্চা ছেলেমেয়ে এসেছিল। তাদের শিক্ষকদের জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম, এই প্রথম তারা কোনও একটি ছবির প্রিমিয়ারে আসার সুযোগ পেয়েছে। স্বভাবতই তারা উচ্ছ্বসিত ছিল। কিন্তু তাদের উচ্ছ্বাসের অভিব্যক্তির কোনও শব্দ ছিল না। কিংবা হয়তো বা ছিল। কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষ সেটা শুনতে পাই না, বুঝতে পারি না। এখন কথা হল, তারা এসেছিল কেন? এসেছিল, কারণ ছবির পাঁচ জন মুখ্য চরিত্র তাদেরই মতো মূক ও বধির শিশু। তারা এসেছিল ছবিতে তাদের মতো মানুষদের উপস্থিতি দেখতে। তারা এসেছিল ছবির পর্দায় তাদের রোজকার চেনা জীবনের বাইরে একটা রূপকথার জগৎ দেখতে। এবং এটা বলতে হয় যে এই দেখানোর কাজে ছবিটি অনেকটাই সফল হয়েছে।

ছবিতে অর্ক, ঝিমলি, তিতলি, রাজু আর পিকু একটি বোর্ডিং স্কুলে পড়ে। গরমের ছুটিতে বাকি বন্ধুদের বাবা-মায়েরা তাদের বাড়ি নিয়ে গেলেও বিভিন্ন কারণে এই পাঁচ জনের বাড়ির লোকেরা ওদের নিতে আসে না। ফলে আগামী এক মাস এই পাঁচ জনকে ফাঁকা হস্টেলেই থাকতে হবে। সঙ্গে থাকবে শুধুমাত্র এক জন কেয়ারটেকার (সুমিত সমাদ্দার) ও এক জন কাজের মহিলা। এই সময় তাদের হস্টেলে চার জন রহস্যজনক ব্যক্তি থাকতে আসে। বেশ ভাল টাকার বিনিময় কেয়ারটেকার ওই চার জনকে এখানে গোপনে থাকতে দিয়েছেন। তারা নিজেদের মুম্বই থেকে আসা একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম ইউনিটের লোক বলে পরিচয় দেয়। যার পরিচালক হলেন ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়, সহকারী পরিচালক সুদীপ্তা চক্রবর্তী, ক্যামেরাম্যান সমদর্শী দত্ত এবং প্রোডাকশন ম্যানেজার অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু একটা সময়ের পর রাজু-তিতলিরা বুঝতে পারে যে এরা আসলে ফিল্ম মেকার নয়। এরা সন্ত্রাসবাদী। একটা বড়সড় বোমা বিস্ফোরণের পরিকল্পনা নিয়ে এরা কলকাতায় এসেছে। এই বার এই পাঁচটি বাচ্চা কী ভাবে এই সন্ত্রাসবাদীদের মিশনকে বানচাল করার চেষ্টা করে এবং আদৌ তারা সেটা করতে পারে কি না তাই নিয়ে গোটা ছবি চলতে থাকে।

সত্যি কথা বলতে গেলে ছবির গল্পে তেমন কোনও মোচড় নেই। থ্রিলার ছবি এর থেকে অনেক বেশি জটিলতা দাবি করে। এ ছবির গল্প খুবই সরল। কিন্তু যেটা আছে সেটা হল এক ধরনের ইনোসেন্স। ছবির বাচ্চারা ইনোসেন্ট। কিন্তু আমি সে কথা বলছি না। গল্পের কথা বলছি। সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে ছবিটা অনেকটাই নিজের মতো করে কিছু জিনিস দেখাতে সক্ষম হয়েছে। অহেতুক কোনও কিছু নিয়ে বাড়াবাড়ি করার চেষ্টা করেনি। বিভিন্ন পাকা পাকা মেসেজ বা প্যাচপ্যাচে সেন্টিমেন্টের খাঁচায় পা দেয়নি। যার সুযোগ ছিল। এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিচালকেরা সেটাই করে থাকেন। স্পেশাল চাইল্ডদের নিয়ে তৈরি ছবির সমালোচনা লেখা বরাবরই বেশ মুশকিলের। যেমন আমির খানের ‘তারে জমিন পর’ বা অমিতাভ বচ্চনের ‘পা’ বা এ রকম ধরনের কোনও ছবির সমালোচনা যদি কেউ করেন, তখনই তাঁকে শুনতে হয় যে ‘দেখেছো, সমালোচক কী রকম নিষ্ঠুর! এ রকম অবলা শিশুদের নিয়ে তৈরি ছবিকে খারাপ বলছে। নিজের হলে বুঝত। ইত্যাদি ইত্যাদি’। কিন্তু কথাটা একেবারেই সেটা নয়। তিনি খারাপ বলছেন ছবিটাকে। শিশুদের নয়। এই ব্যাপারটা দর্শকদের বুঝতে হবে। বুঝতে হবে, ছবিটি কি আদৌ ভাল। না কি সহজে সহানুভূতি কুড়নোর জন্য এ রকম একটা বিষয়কে বাছা হয়েছে। যদি সেই সব শিশুর জীবনযাপনকে সঠিক ভাবে হৃদয়ঙ্গম করে ছবিটা বানানো যায় তা হলে সেটা সৎ ছবি। মেকি প্যাচপ্যাচে সেন্টিমেন্ট হলে ফাঁকিবাজি। আর এখানেই এই ছবিটির সাফল্য।

আরও পড়ুন:

‘উড়নচণ্ডী’দের চিনে নিন ট্রেলারে...

মধ্যরাতে আলিয়ার বাড়িতে রণবীর!

ছবিতে অনেক দুর্বলতা আছে। ছবিটি অতিরিক্ত সংলাপ নির্ভর। ছবি মূলত দৃশ্য মাধ্যম। ফলে অধিকাংশ ইনফরমেশন দৃশ্যের মাধ্যমে দেওয়া হবে সেটাই স্বাভাবিক। যেটুকু ইনফরমেশন দৃশ্যের মাধ্যমে একেবারেই দেওয়া যাচ্ছে না একমাত্র সেটুকুই সংলাপ বা অন্য ভাবে দেওয়া উচিত। বেশি উদাহরণ দেওয়ার দরকার নেই। আমাদের হাতের কাছে ‘পথের পাঁচালী’ আছে। সকলের দেখা। ছবিটিতে মিনিমাম সংলাপের ব্যবহার সম্পর্কে আমাদের সকলেরই কম বেশি জানা। এই ব্যপারটা এই ছবির লেখককে বুঝতে হত। সন্ত্রাসবাদী চরিত্রগুলির অতীত, কেন তারা এই পথে এল তার কারণগুলি পুরোটাই সংলাপের মাধ্যমে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এগুলো দেখানো যেতে পারত। তা হলে ব্যপারটা আরও বিশ্বাসযোগ্য হত। এ ছাড়া টুকটাক কিছু জিনিস ঠিক জমাটি হয়নি। বাঙালি মুসলিম চরিত্রদের সংলাপ কিছুটা মেকি লেগেছে। অভিনয় দুর্বলতাও হতে পারে। একটি চেজ সিকুয়েন্স অতিরিক্ত বড়। সম্পাদনার দুর্বলতা হতে পারে। এগুলোতে আর বেশি যাচ্ছি না। পরিচালকের প্রথম ছবিতে যা যা সমস্যা থাকে এই ছবিতে তার পরিমাণ অনেকটাই কম। পরিচালক নিজের মতো করে অন্তত অনেস্টলি কিছু একটা করার চেষ্টা করেছেন। বাংলা ছবিতে এই অনেষ্টি ব্যপারটা আজকাল মিসিং। আপনারা ছবিটা দেখুন। তা হলে এই ছবির নির্মাতারা ভরসা পাবেন। পরে আরও ভাল ছবি বানানোর সাহস দেখাতে পারবেন।

আর একটা কথা বলা হয়নি। ছবিটির টাইটেল দৃশ্য শুরু হয় সুকুমার রায়ের ‘শব্দ কল্প দ্রুম’ কবিতাটার মাধ্যমে। আবৃত্তি করেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে পরিচালক সুকুমার রায়ের কবিতা থেকে সরাসরি ছবির নামটি ধার করেছেন। কবিকে শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন করেছেন। কিন্তু কবিতার বিষয়বস্তুর সঙ্গে ছবির বিষয়বস্তুর আদৌ কি কোন মিল আছে? বাহ্যিক মিল থাকতে হবে এটা বলছি না। কিন্তু আত্মিক মিলও কি কিছু আছে? কবিতায় এমন কিছু শব্দের অস্তিত্বের কথা বলা হয়েছে যেগুলোর বাস্তবে অস্তিত্ব নেই। ফুল ফোটার শব্দ, চাঁদ ডোবার শব্দ, বুক ফাটার শব্দ এগুলো হয়ত শিশুর কল্পনাতেই এগজিস্ট করে। বাস্তবে করে না। কল্পদ্রুম বা কল্পতরু হল এমন এক বৃক্ষ যার কাছে যা চাওয়া যায় সেটাই পাওয়া যায়। তাই শব্দকল্পদ্রুম মানে শব্দের একটি কল্পতরু। তার কাছে যে কোনও শব্দ চাইলেই সেই শব্দটি পাওয়া যাবে। ছবির মুখ্য চরিত্রদের মুখে কোনও শব্দ নেই। শব্দ আছে তাদের কল্পনায়। শব্দ আছে তাদের আকাঙ্ক্ষায়। ফলে মিল আছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE