সুষমা স্বরাজ, বসুন্ধরা রাজে-র ঘটনা তখনও শুরু হয়নি। রুটিন কল যেমন সাংবাদিকরা করে থাকে, তেমনই লন্ডনের নম্বরে ফোন করলাম ললিত মোদীকে। সব সময়ই একটা ভীষণ তাড়া আছে এমন একটা টোন-এ ফোনে হ্যালো বলেন ললিত। সেদিনও তাই হল।
কথা বলতে বলতেই শুনলাম একটা ‘চুকচুক’ শব্দ হচ্ছে। লন্ডনে সকাল। প্রথমে ভাবলাম ললিত কি তা হলে সকালেই ভদকা খাচ্ছেন কোনও পার্টিতে? জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘হোয়াট আর ইউ হ্যাভিং?’’ গলা নামিয়ে বললেন ‘কোকোনাট ওয়াটার’।
তার পর কিছুক্ষণ অন্য কথা হওয়ার পর ললিতকে মজার ছলেই বললাম, ‘‘জানেন, এটা একটা দারুণ কোইনসিডেন্স যে আপনি ডাবের জল খাচ্ছেন। ভারতীয় ক্রিকেটে আর একজনের ডাবের জল খুব প্রিয়!’’
হাসতে হাসতেই ললিত আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘কে সেটা?’’
আমি বললাম, ‘‘নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসন।’’ বিশ্বাস করবেন কি না সেটা সম্পূর্ণ আপনার ওপর। কিন্তু কী অসম্ভব রেগে গিয়েছিলেন ললিত এটা শোনামাত্র, কল্পনা করতে পারবেন না। চেঁচামেচি করে জাস্ট ফোনটা কেটে দিলেন। তার পর সাত দিন রোজ বারবার ফোন করলেও আর ফোনটা তোলেননি তিনি। এই হচ্ছেন ললিত মোদী। একমুহূর্তে ভীষণ বন্ধু, পরমুহূর্তেই রুদ্রমূর্তি। একমুহূর্তে পরম বন্ধু। পর মুহূর্তেই চরম শীতল। লন্ডনের স্লোন স্ট্রিটে নিজের রাজসিক বাড়িতে বসে ললিত তখন ঘুঁটি সাজাচ্ছেন সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘ব্রেকিং নিউজ’টা কী ভাবে ছাড়বেন! বিসিসিআই আর মিডিয়ার প্রিয় ‘পলাতক’ থেকে অনেক দিন হল ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছেন ‘দলছুট’। তাঁর আক্রমণে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সংস্থাই শুধু পর্যুদস্ত হয়নি, মাথা বাঁচাতে হয়েছে অনেক রাজনীতিবিদ, মিডিয়ার হোমরাচোমড়া থেকে নামীদামি শিল্পপতিদের।
আর তাঁর হাতিয়ার এক ব্ল্যাকবেরি। যা থেকে ক্রমাগত বন্দুক দেগে যাচ্ছেন টুইটারে। টুইটার বায়ো-টাও তো পাল্টে নিয়েছেন: ‘রাজনৈতিক মাফিয়া মুক্ত করায় ব্যস্ত’।
‘‘যারা আমাকে অন্যায় ভাবে খাটো করার চেষ্টা করেছে, তাদের কারওকে আমি ছাড়ব না,’’ ফোনে বেশ ঝাঁঝিয়েই বললেন মোদী। তাঁর টুইটার পরবর্তী অধ্যায়ে ভারতের রাজনীতিতে ঝড় বয়ে যাওয়ার পর ফোন করেছিলাম।
টুইটারে তিনি প্রতিজ্ঞা করেছেন, সব গোপন কথা ফাঁস করে দেবেন। এমনকী সেই সব নামও, যারা সাহায্য নিয়েছিল একসময়ে। একটা স্কুপ পাওয়া যেতে পারে এটা ভেবেই বেশ চেপেই ধরেছিলাম সে দিন ললিতকে। জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘‘এ যুদ্ধে কি জিতবেন?’’ সে প্রশ্নের সোজা উত্তর পেলাম না বিতাড়িত আইপিএল প্রধানের থেকে। ফোনটা কাটার আগে শুধু বললেন, ‘‘জাস্ট ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ।’’
গত পাঁচ বছরে নিজেকে ভারত থেকে সরিয়ে নিয়েছেন ললিত মোদী। অবশ্য তাঁর প্রয়োজনীয়তাও কমে এসেছিল ক্রিকেট আমলাতন্ত্র থেকে মিডিয়ার কাছেও। না হলে কেনই বা নিজের বিজয়গাথা নিজেকেই লিখতে হবে! যাঁর প্রায় প্রতিটা লাইনে পাওয়া যায় ‘উচ্চাকাঙ্ক্ষী, উদ্ধত, অফুরন্ত প্রাণশক্তি’র মতো শব্দ! আর কী ভাবেই বা ব্যাখ্যা করা যায় আইপিএল কমিশনার হয়ে একদিনে আধডজন ফ্লাইটের গল্প নিয়ে মিডিয়ার আদেখলামি! আসলে সংবাদলোলুপ মিডিয়াকে ললিত মোদী নিয়ে গিয়েছেন যেখানে তিনি নিয়ে যেতে চান। আর মিডিয়াও সাগ্রহে সেখানে তাঁর সঙ্গে।
কিন্তু এমন মোদীকে আগে কখনও দেখা যায়নি। নির্বাসনই তাঁকে চতুর মার্কেটিং জিনিয়াস থেকে বদলে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানবিরোধী এক ‘হুইসেলব্লোয়ার’য়ে। মোদী মিডিয়াকে সাহায্য করেছেন। এমন অনেক ভিতরকার তথ্য দিয়েছেন, যা হয়তো কোনও দিন বোর্ডরুমের বাইরের আলো দেখত না। ওই যে আগেই বললাম, মোদী বদলে গিয়েছেন। ক্রিকেট সাংবাদিকদের ইনবক্স এখন ভরে ওঠে তাঁর পাঠানো ইমেলে। যাতে করে আইপিএল-এর সবচেয়ে বড় দুর্নীতি ফাঁস হয়। আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে এর মধ্যে। ভারত থেকে দূরে থাকাটা ফ্ল্যামবয়েন্ট জেটসেটারকে বেশ কষ্ট দিয়েছে। এমনটা তিনি কখনও কল্পনাও করেননি।
আইপিএলের সময় সারা ভারত চষে ফেলা ললিত মোদী এখন তো একরকমের বন্দিই! লন্ডনে যারা তাঁর সঙ্গে দেখা করেছেন তাদের কাছেই শুনেছি ললিত মোদী এখন কেমন ভাবে ‘মিস’ করেন অনবরত বিদেশভ্রমণ। তাঁর মন থেকে আইপিএল এতটুকু মুছে যায়নি। অনেকটা সেই ডিভোর্স হয়ে যাওয়া স্বামীর মতো, যে স্ত্রীকে মন থেকে মুছে ফেলতে পারছেন না।
আসলে তিনি জানেন আইপিএলকে আজও দরকার তাঁর। বেঁচে থাকার জন্য। আর সেটাই কারণ এই সব বিস্ফোরক টুইটের।
কিন্তু তিনি যে ললিত মোদী। তিনি তো সিস্টেমের মতো নিজেকে পাল্টে নেবেন না, সিস্টেমকেই বদলে নিতে হবে তাঁর মতে। ক্রীড়াজগতের ‘সুপার ব্রেন’ হিসেবে প্রসিদ্ধ হলে কী হবে, বিসিসিআই তাঁর পিছনে ধাওয়া করবে কি না— তার উত্তর কিন্তু ললিত মোদীর কাছেও নেই। একদা বিসিসিআই-য়ের সর্বময় কর্তার শুধু জবাব, ‘‘ওরা আমাকে ছাঁটতে চাইল কারণ আমি বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছিলাম।’’
যাই হোক, তাঁর এই সব নথিপত্র রেখে দেওয়ার অভ্যেস কাজে এসেছে যখন তিনি ‘ক্রিকেট মাফিয়া’র সঙ্গে লড়াইতে নামলেন। হাজারখানেক ডকুমেন্টস বের করলেন যা দিয়ে লড়াই করতে পারেন প্রতিপক্ষের সঙ্গে। অনেকেই জানেন, মোদী এই তথ্য সংগ্রহের কাজটা প্রায় চার-পাঁচ বছর ধরেই চালিয়ে আসছেন। বিসিসিআই-য়ের কর্তাব্যক্তিদের বাইরেও অনেকের থেকে জোগাড় করতেন তথ্য। যা থেকেই তৈরি করিয়েছেন তাঁর এই যুদ্ধের হাতিয়ার।
‘লোকে যে কেন ওয়েবসাইট খুঁটিয়ে দেখে না’— প্রায়ই অভিযোগ করতেন মোদী। অবশেষে তাই বেছে নিলেন টুইটারকে তার যুদ্ধের সঙ্গী হিসেবে। নিজেই আপলোড করতে থাকলেন নানা চমকে দেওয়া তথ্য। মিডিয়ায় শুরু হল #LalitGate। অনেক নিউজ চ্যানেল তো গত কয়েক সপ্তাহ ধরে তাঁকে নিয়ে দিনে ছ’ঘণ্টা অনুষ্ঠান করত। তিনি টিভি ইন্টারভিউ দিন কি না দিন— ‘মোদী ম্যানিয়া’তে সর্বভারতীয় মিডিয়াও বুঁদ হয়ে থাকল। বিসিসিআই তাঁকে যতই বলুক ‘পারসনা নন গ্রাটা’ (অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি), মোদীর বক্তব্য একেবারে ফেলে দেওয়া যায় না।
তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা আর্থিক দুর্নীতির সামনাসামনি তাঁকে হতে হবে কি না বোঝা শক্ত। তবে যেটুকু ললিত মোদীকে জানি, দরকারের সময় সঠিক লোককে ডেকে নিতে তাঁর দু’মিনিটও দেরি হবে না। এক সিনিয়র লিগাল এডিটরের কাছে একটা গল্প শুনেছিলাম। স্যুটপরা এক লোকের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছিল সুপ্রিম কোর্টে। তখনও ‘ললিত মোদী’ না হয়ে ওঠা লোকটি সিগারেট চেয়েছিল। বছরকয়েক পরে আরসিএ-তে তাঁকে যখন বিরোধী পক্ষ উচ্ছেদ করতে চাইছে— মোদী কিন্তু তাঁকে ভুলে যাননি। ঠিক লোককেই ফোন করেছিলেন। ললিত মোদী মানেই সবাই ভাবে ভীষণ ঊদ্ধত একজন মানুষ। নিশ্চয়ই এক সময় তাই ছিল। কিন্তু ইদানীং শুনেছি নিজেকে অনেকটা বদলে ফেলেছেন ললিত। আগের সেই উদ্ধত ভাবটা অনেকটা কমে গিয়েছে। একটু হলেও শান্ত হয়েছেন। শুধু একটাই ব্যাপার এখনও ছাড়তে পারেননি ললিত।
তা হল গুড লাইফের প্রতি একটা সাঙ্ঘাতিক ভালবাসা। দুবাইয়ের বেস্ট হোটেলের স্যুটে থাকা থেকে প্যারিস হিলটনের সঙ্গে পার্টি করা। ললিত মানেই লিভ লাইফ কিং সাইজ।
হয়তো আমাদের দেশে অনেকেই এই ‘গুডলাইফ’টা পছন্দ করে কিন্তু সেটা অন্যদের দেখায় না। এখানেই ললিত বাকিদের থেকে আলাদা।
এবং এর জন্যেই ওকে নিয়ে সবার এত সমস্যা।
পুনশ্চ: ললিত মোদীর সঙ্গে এই পাঁচ বছরে বহুবার কথা হয়েছে। এক-দু’বার জিজ্ঞেসও করেছিলাম। কিন্তু কোনও দিন হ্যাঁ কি না, কিছুই বলেননি। তবে একটা গুজব কিন্তু দিন দিন বাড়ছে। গুজবটা এই রকম— ললিত মোদী নাকি বিশ্বের বিখ্যাত ফুটবলারদের নিয়ে চিন-এ একটা আইপিএলের মতো টুর্নামেন্টের প্ল্যান করেছেন। শেষ পর্যন্ত আবার একটা দুর্দান্ত সফল টুর্নামেন্ট হয় কি না, সেটা সময় বলবে। কিন্তু যেহেতু ললিত মোদী, তাই সেই বিখ্যাত বিজ্ঞাপনের লাইনটা ধার করে লেখাই যায়— ‘ইমপসিবল ইজ নাথিং’।
(লেখক ক্রিকেট এডিটর সিএনএন-আইবিএন)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy