রানাঘাটে আয়োজিত নাট্যোৎসবের একটি মুহূর্ত। —নিজস্ব চিত্র
সময়টা ২০০৩ সাল। রানাঘাটে উদ্বোধন হল নজরুল মঞ্চের। তারিখটা ছিল ১৩ অক্টোবর। ন’শোরও বেশি আসন। আধুনিক ওই নাট্যমঞ্চ শহরের সাংস্কৃতিক মহলে দারুণ সাড়া ফেলল। রানাঘাট যেন এরই অপেক্ষায় ছিল।
ঠিক পাঁচ মাসের মাথায় ওই মঞ্চে ‘রানাঘাট নাট্যপ্রেমী সংস্থার’ উদ্যোগে কলকাতার নান্দীকার মঞ্চস্থ করল তাদের সেই সময়ের বিখ্যাত নাটক, জসীমুদ্দিনের কাহিনী অবলম্বনে ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’। পরপর দু’টি শো। উপচে পড়ল দর্শক।
সেই শুরু। তারপর থেকে প্রতি বছর শীতকালে রানাঘাট নাট্যপ্রেমী সংস্থার উদ্যোগে এবং রানাঘাট পুরসভার সহযোগিতায় অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে নাট্যোৎসব। যে উৎসব এবার তেরো বছরে পা দিল। গত ৬ ফেব্রুয়ারি, শনিবার থেকে শুরু হয়েছে ত্রয়োদশ নাট্যোৎসবের দ্বিতীয় পর্ব। চলবে সোমবার, ৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। শীতের মরসুমে নাটক ঘিরে আর পাঁচ জায়গায় উৎসবের সঙ্গে রানাঘাটের নাট্যোৎসবের বেশ খানিকটা পার্থক্য রয়েছে। শনি-রবির ছুটির দুপুর কিংবা সন্ধ্যায় নিয়ম করে রানাঘাট শহর বা সংলগ্ন গ্রামের মানুষকে নাটকের হলে টেনে আনার কঠিন চ্যালেঞ্জ নিয়ে এই নাট্যোৎসব শুরু করেছিলেন স্থানীয় কিছু মানুষ। যাঁরা পেশায় অধিকাংশই ডাক বিভাগের কর্মী হলেও নাটক তাঁদের নেশা। নাটক নিয়ে তাঁদের আবেগ এতটাই, কাজের চাপে নিজেরা মঞ্চে উঠতে না পারলেও নাট্যোৎসবের প্রয়োজনে অফিস থেকে দেদার ক্যাজুয়াল লিভ বা আর্ন লিভ নিতে তাঁরা বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেন না। কোনও বছর নাট্যোৎসবের শেষে লক্ষাধিক টাকা ঋণের বোঝা ঘাড়ে চাপলেও পিছিয়ে আসেন না। পরের বছর ঠিক একই ভাবে মেতে ওঠেন নাটকের উৎসবে।
প্রায় এক যুগ ধরে তাঁদের ক্রমাগত চেষ্টায় নাটক দেখা ক্রমশ একটা অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছেন রানাঘাটের দর্শকেরা। শীতকাল হলেই তাঁরা অপেক্ষায় থাকেন কবে শহরে দেওয়ালে দেখা যাবে নাট্যোৎসবের বিজ্ঞাপন। তবে রানাঘাট নাট্যপ্রেমী সংস্থা উৎসবের আয়োজন করেন একটু অন্য ভাবে। সর্বত্র যেমন সাত-দশ দিনের টানা নাট্যমেলা কিংবা নাট্যোৎসব হয়, এখানে তেমনটা নয়। বরং নভেম্বর বা ডিসেম্বরের পরপর চারটি শনি-রবি জুড়ে নাটকের শো হয়। কোন নাটক একদিনে দু’বার বা পরপর দু’দিন ধরে একটাই নাটক দেখানো হয়।
আয়োজন যেমন ভাবেই হোক না কেন নাটকে মজে আছে রানাঘাট। কলকাতায় না গিয়েও সমকালীন সময়ের নামীদামি নাটক নিজের শহরে বসেই নিয়মিত দেখার সুযোগ কোনও মতেই হাত ছাড়া করতে রাজি নন মানুষ। ফলে বেশির ভাগ নাটকে উপচে পড়া ভিড়। নাটক শেষ শীতের রাতেও বিতর্কে তেতে উঠছে চায়ের দোকান। নাটক নিয়ে চায়ের ভাঁড়ে তুফান।
এই তেরো বছরে রানাঘাট নাট্যপ্রেমী সংস্থা শহরবাসীকে উপহার দিয়েছে সোজন বাদিয়ার ঘাট, রাজা অয়দিপাউস, দায়বদ্ধ, তথাগত, বড়দা, নাচনী, জান-এ-কলকাত্তা, বল্লভপুরের রূপকথা, আদি অন্ত আদি, ভুশুণ্ডির মাঠে, দুধ খেয়েছে ম্যাও, বিসর্জন, মাধবীর মতো নাটক। অভিনয় করে গেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, অশোক মুখোপাধ্যায়, দেবশঙ্কর হালদার, গৌতম হালদার, দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায়, মেঘনাদ ভট্টাচার্য, কৌশিক সেন, সোহিনী সেনগুপ্ত, স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত, সীমা মুখোপাধ্যায়ের এই সময়ের বাংলা নাটকের তা বড় ব্যক্তিত্ব।
বলা বাহুল্য, এমন মাপের নাট্য উৎসবের খরচের বহরও বিরাট। উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন এর মধ্যে দু’বার উৎসবের জন্য আর্থিক সাহায্য পেয়েছেন দিল্লির সংস্কৃতি মন্ত্রক থেকে। কিন্তু বাকি যে বছরগুলিতে তাঁরা সাহায্য পাননি সেই বছরগুলিতে কী ভাবে সামাল দেন নাট্য উৎসবের এই বিপুল খরচ? প্রশ্নের উত্তরে কিছু ক্ষণ চুপ করে থেকে সংস্থার সম্পাদক দিব্যেন্দু বিশ্বাস বলেন, “প্রত্যেক বারে সামাল দিতে পারিও না। বাজারে অনেক টাকা ধার হয়ে যায়। তারপর সারা বছর ধরে ওই ধার শোধ করি। ফের শীতকাল এলেই উৎসবের আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়ি।” দিব্যেন্দুবাবু জানিয়েছেন নবম বর্ষ নাট্যোৎসবে ঘাটতি পড়েছিল ৮৭ হাজার টাকা। আর একাদশতম বছরে ঘাটতির পরিমাণ ছিল এক লাখ তেতাল্লিশ হাজার টাকা।
তাতে অবশ্য উৎসব বন্ধ হয় নি। চলতি বছরের প্রথম পর্বের নাট্যোৎসবে মঞ্চস্থ হয়েছে ব্রাত্য বসুর নাটক ‘বোমা’, গত ১৪ ডিসেম্বর। শনিবার থেকে শুরু হয়েছে উৎসবের দ্বিতীয় পর্ব। এই পর্বে তিনটি নাটক হচ্ছে। শনিবার ‘ধর্মাশোক’, রবিবার ‘ফেরা’ সোমবার মঞ্চস্থ হবে ‘শের আফগানের টিনের তলোয়ার’। এবারের নাট্যোৎসবের সবকটি নাটকেই দেবশঙ্কর হালদার অভিনয় করছেন। তাই উদ্যোক্তারা এবারের উৎসবকে দেবশঙ্কর হালদার নাট্যোৎসব বলে চিহ্নিত করেছেন।
লক্ষ লক্ষ টাকা বাজেটের নাট্যোৎসবের অর্থসংগ্রহের প্রধান উৎস তিনটি। টিকিট, বিজ্ঞাপন এবং সদস্য-শুভানুধ্যায়ীদের আর্থিক অনুদান। সংস্থার সভাপতি অশোক মণ্ডল জানিয়েছেন সংস্থার শুভানুধ্যায়ী এবং সদস্যদের কাছ থেকে সংগ্রহ হয় চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা। প্রায় একই পরিমাণ অর্থ আসে বিজ্ঞাপন থেকে। বাকিটা টিকিট বিক্রি থেকে। শহরের রেল স্টেশন এবং বাজার এলাকায় দু’টি কাউন্টার খোলা হয় উৎসবের দিন পনেরো আগে থেকে। উৎসব চলাকালীন হলের কাউন্টার তো আছেই। এবার দৈনিক টিকিট ৮০-১০০, সিজন ১৫০-২০০ টাকা।
তারপরেও যে টাকা ঘাটতি পড়ে, তা মেটাবার জন্য তৈরি থাকেন দিব্যেন্দুবাবু এবং তাঁর পরিবার। কিন্তু কেন এ ভাবে অর্থ, শ্রম সব দিয়ে নাটকের নিয়ে ডুবে থাকেন?
দিব্যেন্দুবাবুর জবাব, কবে থেকে যে নাটকের সঙ্গে প্রেমের শুরু তা আজ আর মনে নেই। তবে অভিনেতা গৌতম হালদারের সঙ্গে পরবর্তী কালে পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে ওঠার পর থেকে কলকাতার নাটকের সঙ্গে বিশেষ করে নান্দীকারের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপিত হয়। স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, “জানেন, জসিমুদ্দিনের সোজন বাদিয়ার ঘাট বইটির একটি ছেঁড়াখোঁড়া কপি আমার কাছে ছিল। কথা প্রসঙ্গে আমি একদিন বইটি রুদ্রবাবুকে দিয়েছিলাম। তারপর যা হয়েছিল সে তো ইতিহাস। নান্দীকার যখন সোজন বাদিয়ার ঘাট মঞ্চস্থ করে তখন কৃতজ্ঞতা স্বীকারে সে কথা উল্লেখও করেছেন। এই ভাবেই নাটকের সঙ্গে জড়িয়ে গেছি। তাই নাটকের উৎসব বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমরা সর্বস্ব বাজি রাখতে পারি।”
প্রতি বছর টিকিটের অর্থে আর যাই হোক নাট্য উৎসব হয় না। মফস্সলে সেই অর্থে স্পনসরও নেই। নাট্য উৎসবের জন্য সরকারি অনুদান অনিয়মিত। ফলে সারা বছর ধরেই চলে অর্থের সংস্থান করা। তবে বারো বছর ধরে একটানা চর্চার ফলে এখন পাওনাদার ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেন এবং টাকা পেতে দেরি হবে জেনেও প্রতি বছর উৎসবের যাবতীয় কাজ করে দেয়।
দিব্যেন্দুবাবুদের কথায়, ‘‘আসলে এটা একটা দীর্ঘকালীন প্রক্রিয়া। যেখানে আয়োজক সংস্থাকে সকলের বিশ্বাস অর্জন করতে হয়। পৌঁছতে হয় অন্যরকম বোঝাপড়ায়। দর্শক যেন বিশ্বাস করেন অমুক সংস্থার নাট্য উৎসব মানেই সমকালীন সেরা নাটকগুলি দেখার সুযোগ। ফলে তারাও হাত বাড়িয়ে দেন। উৎসব সফল হয়। তবে বিশ্বাস অর্জনের কাজটি একদিনে হয় না।
তেরো বছরে রানাঘাট নাট্যপ্রেমী সংস্থা সেই বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছে।
সহ প্রতিবেদন— সৌমিত্র সিকদার
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy