পাক্কা এক ঘণ্টা তেরো মিনিট মন্ত্রীমশাইকে অপেক্ষা করিয়ে তবে এলেন দেবশঙ্কর হালদার!
২৮ অগস্ট মুক্তি পেতে চলা নতুন ছবি ‘কল্কিযুগ’-এ ওঁদের হাড্ডাহাড্ডি দ্বৈরথ দেখবে দর্শক। ব্রাত্য বসু সেখানে গোয়েন্দা দফতরের এসিপি দিলীপ দত্ত। দেবশঙ্কর হালদার চিত্রকর-ঔপন্যাসিক সঙ্কর্ষণ গুপ্ত। অফস্ক্রিনে তারই ‘শ্যাডো-প্লে’ হয়ে গেল সেদিন ভরদুপুরে।
ব্রাত্য: ‘রুদ্ধসঙ্গীত’ করার সময় তো আধঘণ্টা আগে এসে বসে থাকতে, এখন বড়সড় পুরস্কার পেয়ে…
দেবশঙ্কর: এটা কী হল! এক দিন দেরি বলে…আমি এখনও সবার আগে ঢুকি।
(খুনসুটি গড়াতে গড়াতেই আনন্দ প্লাস-এর রেকর্ডার অন। আড্ডা শুরু।)
একজন ওয়াটসন পেলে এ বার কি ব্রাত্য বসু শার্লক হতে চাইবেন?
ব্রাত্য (প্রচণ্ড হেসে): ‘সাইন অব ফোর’-এ শার্লক যখন জানলা দিয়ে লন্ডনের রাস্তা দেখছে, তখন বলছে, এই সেই আবহাওয়া যেখানে সাধারণ মানুষ অপরাধী হয়ে ওঠে। তো এমন একটা বাতাবরণ পেলে আমরা তো সবাই শার্লক হতে চাইব।… এসিপি দিলীপ দত্তর এই ব্যাপারটা আমার খুব পছন্দের। ইনফ্যাক্ট চরিত্রটা করতেই আমি মজা পেয়েছি। পরিচালক দেবারতি গুপ্তর এই ছবিটায় আমার চরিত্রটা আমার আগের সব সিনেমার থেকে আলাদা (প্রযোজক: ম্যাকনিল ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড)। আর একটা কথা, এ ক’বছর প্রশাসনে থেকে, আইপিএস-আইএএস-দের কাছ থেকে দেখে, তাঁদের বডি ল্যাঙ্গোয়েজ, কথাবার্তায় মাত্রাজ্ঞান আমাকে ‘দিলীপ দত্ত’ হতে খুব সাহায্য করেছে।
সেই মাত্রাজ্ঞান নিয়ে এসিপি কিন্তু বলছেন, ‘শঙ্খ ঘোষ’-কে মার্ডার কেসে জড়ালে বাঙালি রে রে করে তেড়ে আসবে’। অস্বস্তি হয়নি বলতে?
ব্রাত্য: এটা জাস্ট একটা মজা।
‘কল্কিযুগ’ কি দেবশঙ্কর হালদারের বোরডম কাটানো?
দেবশঙ্কর: ‘বোরডম’ শব্দটায় আমি বিশ্বাস করি না। চরিত্রটা আমার কাছে ইন্টারেস্টিং লেগেছে অন্য জায়গায়। লোকটা নিজেকে বিপদে ফেলে আনন্দ পায়। একটা বাজি জেতা হলে আরেকটা জিততে চায়। সব সময় নিজেকে চ্যালেঞ্জের মুখে রাখে। অন্ধকার জায়গায় নিজেকে নিয়ে যাওয়াতেই তার সুখ।
ইদানীং অনেকে বলছেন, আপনার অভিনয়ে একঘেয়েমি চলে আসছে।
দেবশঙ্কর: ইদানীং কেন, এ তো ‘উইঙ্কল টুইঙ্কল’ থেকে শুনছি। দেখুন, একঘেয়েমি যদি আসত, তা হলে এতগুলো থিয়েটার করতে পারতাম না। আমি তো গায়ের জোরে থিয়েটার করি না। লোকে ডাকে। আমি এক দুই তিন করে বলে দিতে পারি আমি যে চরিত্রগুলো করি, সেগুলো মেকআপে, ভঙ্গিমায়, চেহারায় আলাদা। যেহেতু আমি বেশি কাজ করি, লোকে এরকমটা বলে। বাজারে একটা চালু কথা আছে, রেস্ট নিয়ে, বেশি সময় নিয়ে করলে বুঝি কাজ ভাল হয়। আমি এর তীব্র বিরোধিতা করি। তবে মানুষ রোজ রোজ তো আলাদা হতে পারে না। আমারও তো একটা সিগনেচার আছে। আমরা অভিনেতারাও অনেক সময় ভুল করি। ভাবি, আগের বার তো পায়ে হেঁটে ঢুকেছিলাম, এ বার তা হলে হাতে ভর দিয়ে ঢোকা যাক। একঘেয়েমি কাটবে। শিল্পে এমন হয় নাকি?
ব্রাত্য, আপনার কি মনে হয়, দেবশঙ্করের অরবিন্দ ঘোষের যা স্বর বা ভঙ্গি, শিশির ভাদুড়িতেও তাই?
ব্রাত্য: দেখুন, যাঁর একঘেয়ে লাগে, তিনি আসবেন না। আমি মনে করি একজন অভিনেতা পরিচালকের ‘টুল’। যদি একঘেয়ে লেগেও থাকে, সেটা শুধু অভিনেতার একার দোষ নয়। আমি আমার তিনটে নাটকের কথা বলব, ‘উইঙ্কল টুইঙ্কল’, ‘রুদ্ধসঙ্গীত’, ‘বোমা’…কোথায় একঘেয়ে, দেখান।
নিঃসঙ্গ সম্রাট-এর শিশির ভাদুড়ি?
ব্রাত্য: আমি অন্যর নাটক নিয়ে মন্তব্য করব না।

দেবশঙ্কর, কল্কিযুগ-এ খুন হচ্ছে যে ছুরিটা দিয়ে সেটা জাপানি। এটা কেন?
দেবশঙ্কর: এটা দেবারতি বলতে পারবেন। চিত্রনাট্যও ওঁর। ছুরি খুব ক্ষুরধার। দৃঢ়। সেটা নিয়ে আপনারা এ বার যা ভাবার ভাবুন (হাসি)।
৫ অগস্ট রাতে ব্রাত্য বসুর কালিন্দীর বাড়িতে কী মেনু ছিল?
ব্রাত্য (অনেকটা সময় নিয়ে): মানে? সেটা আমি গণমাধ্যমকে বলব কেন!
ও দিন ঋদ্ধি সেন তার বাবা কৌশিক, মা রেশমিকে নিয়ে আসছে বলে আপনি শ্যামবাজারের এক বিখ্যাত দোকান থেকে ডিমের ডেভিল আর কষা মাংস আনিয়েছিলেন। সঙ্গে...
ব্রাত্য (হেসে উঠে): ডেভিলটা ঠিক। কষাটা ভুল। ওটা আমার বন্ধুদের আড্ডা। আর কিছু বলব না।
কৌশিকের সঙ্গে রিদমটা ফিরল। সুমন মুখোপাধ্যায়ের আবার একাডেমিতে ফেরার আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছে।
বাকি যাঁরা প্রতিবাদ করে একাডেমি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন তাঁদের সঙ্গেও কি কথা শুরু করবেন…
ব্রাত্য (বিরক্ত হয়ে): আচ্ছা, আমার অপরাধটা কী! আমি মন্ত্রী, এটাই অপরাধ? সব জায়গায় আমায় কথা শুরু করতে হবে কেন? আমার বিরুদ্ধে কার কী অভিযোগ সেটা আমায় এসে তো বলতে পারে। আমি আগেও বলেছি, আবার বলছি, এটা শরিকি ভাইদের ঝগড়া। তাতে প্রতিবেশীরা হাততালি দিতে পারে। মজা পেতে পারে। কিন্তু বাড়িতে তারা যেন না ঢোকে। ভাইরা কখন একজোট হয়ে যাবে, বলা মুশকিল।… তাছাড়া একাডেমি সরকারি প্রেক্ষাগৃহ নয়।
কিন্তু এটা তো সত্যি, শরিকদের মধ্যে দেবেশ চট্টোপাধ্যায় বা অর্পিতা ঘোষের সঙ্গে নতুন করে আপনার একটা ব্যবধান…
ব্রাত্য (বিরক্ত হয়ে): একেবারেই না।
তা হলে আপনার নাটক নিয়ে দেবেশের পরিচালনায় ‘জতুগৃহ’, ‘বিকেলে ভোরের সর্ষে ফুল’ বন্ধ হয়ে গেল কেন? পরিচালক উকিলের চিঠিও পেলেন।
ব্রাত্য: আমার থিয়েটার করতে গেলে অনুমতি নিতে হবে তাই।
সে তো এত দিন মৌখিক স্তরেই হত। উকিলের ব্যাপার ছিল না।
ব্রাত্য: আগে অনেক কিছুই হত না থিয়েটারে। অন্য দলে থিয়েটার করে টাকা পাওয়ার ব্যাপারটা যেমন আগে ছিল না। প্রত্যেক ক্ষেত্রে একটা প্রফেশনাল শেপ আসা উচিত। নাট্যকার হিসেবেও আমি এটা চাইব।
দেবশঙ্কর, আপনি কোনও দিনই এই বাদানুবাদে ফোকাসড নন। লোকে বলে আপনি গা-বাঁচানো মানুষ। কারও ‘হল’ পাওয়ার অসুবিধে হচ্ছে। আপনি সে-দলে অভিনয় করলেও কোনও সুরাহা করতে এগোন না। এতে তো থিয়েটারের অমঙ্গল?
দেবশঙ্কর: থিয়েটারের মঙ্গল আমার চেয়ে কেউ বেশি করে না। কেননা, আমি রোজ থিয়েটারটা করি। আর যদি বলেন, হল পাইয়ে দেওয়ার জন্য কথা বলা, তো বলব, তার যদি ধক থাকে সে হল পাবে। কীরকম ভাবে পেতে হয়, বুঝে নেবে। সেই করেই এক দিন ব্রাত্য বসুও থিয়েটার করেছেন। হল পাওয়ার অনুরোধটা ব্রাত্যদের করার আগে দেখতে চাই এই অভ্যাসটা ওরা রপ্ত করতে পারছে কিনা। আর এই বাদানুবাদ? শুনুন, এই ব্যাপারে নিরন্তর ভাবে একই কথা একমাত্র আমিই বলে আসছি। আপনাদের পুরনো রেকর্ড খুলে দেখে নেবেন। বারবার বলেছি, এটা মিটে যাবে।
থিয়েটার করার আকাঙ্ক্ষাটাই এদের মিলিয়ে দেবে। এটা গা বাঁচানোর জন্য বলি না, উত্তপ্ত কথা বলাটাকে যদি কেউ সংগ্রাম বলে ভাবেন, আমি সেই সংগ্রামে নেই। খোলা মনেই এটা বলতে চাই। এটাকেই আপনারা প্যাঁচালো বলেন। দুঃখ হয়...
এই প্রথম রাগতে দেখা যাচ্ছে দেবশঙ্কর হালদারকে!
দেবশঙ্কর: রাগ নয়। উল্লাস। এ উত্তর আপনার কাছেই মজুত। তাতেও একই কথা বারবার বলে যাওয়ার জন্য সাধুবাদ না জানিয়ে খোঁচাচ্ছেন!
দেবশঙ্কর, এও জানি, এক সময় দেবেশ-ব্রাত্য ভুল বোঝাবুঝি মেটানোর জন্য কৌশিক সেনের পুরনো বাড়িতে মিটিং করেছেন...
দেবশঙ্কর: সে আমায় ডেকেছিল বলে। সে আমি এখনও আছি। থাকবও।
ব্রাত্য: আচ্ছা, আপনি কি দেবেশের বিরুদ্ধে একটা কথা আমাকে বলতে শুনেছেন? তা হলে এ সব প্রশ্নের মানে কী? এ বার আমি বলি, আমিও দেবশঙ্কর আর গৌতম হালদারের মধ্যে যাবতীয় ভুল বোঝাবুঝি মিটুক, দেখতে চাই (ঠোঁটে চিলতে হাসি)।
দেবশঙ্কর: আরে আরে! গৌতমের সঙ্গে তো আমার কোনও বিবাদ নেই!
ব্রাত্য: তা হলে আমার আর দেবেশের মধ্যেও কিছু নেই। আর আমি চাই গৌতম আবার নান্দীকার-এ ফিরে আসুক। দেবুদা ইনিশিয়েটিভ নিক (প্রবল হাসি)।
দেবশঙ্কর (হা হা হা): এটা ভাল বলেছে। সত্যিই এর শেষ নেই!
‘শেষের কবিতা’ দেখলেন ব্রাত্য?
ব্রাত্য: হ্যাঁ। ভালও লেগেছে। যে ভাবে সুমন প্লটিংটা করেছে। ভিক্টোরিয়ান নভেলের আদল এনেছে।
রাহুল বোসকে কেমন লাগল?
ব্রাত্য: দেখুন এ সব ব্যাপারে আমি নির্দেশকের ভাবনাটাকেই সম্মান জানাই। সেটাই অবজার্ভ করি।
আপনি যদি ‘শেষের কবিতা’ করতেন, তা হলেও কি রাহুল বোসকে নিতেন?
ব্রাত্য: মাসির যদি গোঁফ গজাত, তা হলে মামা হত কি না, ভেবে লাভ কি! আমি হয়তো সুমনকে নিতাম, তো!
ব্রাত্য, অনেকে বলেন, আপনার থিয়েটার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মূল কারণ আপনি মিডিয়া ফ্রেন্ডলি, ছ’শোটা হোর্ডিং দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন…
ব্রাত্য: থিয়েটার মিডিয়ার ওপর অনেকটাই নির্ভর করে। কী করা যাবে! কিন্তু এখানে দু’ধরনের ক্লায়েন্টেল আছে। এক দল মিডিয়া যা বলল, তাতে প্রভাবিত হয়। আরেক দল হয় না। মিডিয়ায় শুধু আমার নয়, অনেকের থিয়েটার নিয়েই লেখা হয়। তার এফেক্ট কাউন্টারে পড়ে। কুড়ি-পঁচিশ নম্বর শো’র পরে থিয়েটারগুলো ঘুরে দেখতে বলব। আমি বলছি না, তখনও আমার প্রচুর লোক হয়। কিন্তু তুলনাটা করে দেখবেন। আর হোর্ডিং বলছেন? আমি ‘রুদ্ধসঙ্গীত’-এ চারটে হোর্ডিং দিয়েছিলাম। ‘সিনেমার মতো’-য় তার চেয়ে একটু বেশি। সবচেয়ে বেশি হোর্ডিং ‘কে’-তে। ‘বোমা’-য় ‘সিনেমার মতো’-র চেয়েও কম হোর্ডিং পড়েছে। কিন্তু কাউন্টার সেল? এক নম্বরে ‘রুদ্ধসঙ্গীত’, তারপর ‘সিনেমার মতো’, ‘বোমা’। ‘কে?’ শেষে। তাই হোর্ডিং-ও আসল কথাটা বলে না। জীবদ্দশায় এ সব ভেবেও লাভ নেই।
শেষ প্রশ্ন, ব্রাত্য। আজকাল প্রায়ই বলছেন, আর বছর কয়েক। তার পর থিয়েটার করা ছেড়ে দেব।
ব্রাত্য: সত্যিই তাই। থিয়েটার এখানে ভীষণ ভাবে রিজিওনাল। এখানে মানুষের ব্যবহারবিধি তার যোগ্যতার নিরূপক হয়ে ওঠে। এর জন্য যে পরিমাণ স্ট্র্যাটিজিক হয়ে উঠতে হয়, একটা বয়েসের পর আমি সেটা নিতে পারব না। বয়সটা পঞ্চাশ হলে আর নয়। লিখব, কিন্তু ...
(পাশে ম্লান মুখে চেয়ে দেবশঙ্কর হালদার)
কিছু বলবেন?
দেবশঙ্কর: এমনটা যদি হয়, খুবই দুর্ভাগ্যজনক হবে। পুরো নাট্যজগতের জন্য তো বটেই, এ ছাড়া আমার থিয়েটারি জার্নির ভেতর ওর উপস্থিতি এত স্বচ্ছন্দ, সহজাত, এত গা ঘেঁষাঘেঁষি করে… ব্যক্তিগত ভাবে এটা আমায় খুব কষ্ট দেবে।