অয়নান্ত ছবিতে সুপ্রিয়া দেবীর সঙ্গে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
সাতান্ন বছর তো হবেই... সুপ্রিয়ার সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ, অসিত সেনের ছবি ‘স্বরলিপি’ করতে গিয়ে। ’৬১-তে মুক্তি পায় ছবিটা, শুটিং সম্ভবত ’৬০-এই হয়েছিল, যদ্দূর মনে পড়ে। ওই ছবিটাই আমাদের দু’জনের একসঙ্গে প্রথম কাজ।
প্রথম যেদিন দেখি সুপ্রিয়াকে, রীতিমতো মোহিত হয়ে গিয়েছিলাম। অমন লম্বা টানটান চেহারা, বাঙালিদের মধ্যে চট করে দেখা যায় না। চমত্কার ফিগার, যেমন হাইট, তেমন প্রপোরশনেট। ‘আম্রপালি’ ছবিতে ওকে ছাড়া কাউকে মানাতই না। মুখখানিও ছিল ভারী সুশ্রী, আর তাতে মুক্তোর মতো দাঁত। এত সুন্দর দেখাত হাসলে... প্রথম দর্শনেই রসিকতা করার লোভটা ছাড়তে পারলাম না। মুখটুখ খুব সিরিয়াস করে বললাম ‘‘আপনার এই দাঁতগুলো কি স্বোপার্জিত না উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত?’’ প্রথম আলাপেই এমন প্রশ্ন, বুঝতে পারছে সুপ্রিয়া যে আমি বলতে চাইছি— ওর জন্মসূত্রে পাওয়া দাঁতগুলো বাঁধানো দাঁতের মতোই সুন্দর, মহার্ঘ। কিন্তু বুঝতে পারছিল না ঠিক কী বলবে, বরং একটু অপ্রস্তুতই হয়ে পড়ল। এমন কনশাস হয়ে গেল দাঁত নিয়ে যে ঠিকমতো হাসতেই পারছিল না। শুটিংয়ে সে কথা বললও অসিতদাকে। এ ভাবেই আমাদের দু’জনের দারুণ বন্ধুত্ব, তুই-তোকারির সম্পর্ক হয়ে গেল। প্রায় একই সময় অভিনয় করি ‘স্বয়ম্বরা’-য়, সেটাও অসিতদারই ছবি, তারও পরে ‘অয়নান্ত’। মাঝে কয়েক বছর একসঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়নি, আবার একসঙ্গে কাজ করেছি ‘যদি জানতেম’, ‘দেবদাস’, ‘আত্মীয়স্বজন’, এ রকম বেশ কিছু ছবিতে। কাজের ক্ষেত্রে সাময়িক বিচ্ছিন্ন থাকলেও আমরা বরাবরই ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
বাঙালি মধ্যবিত্ত জীবনে ওয়ার্কিং গার্ল-এর চরিত্রে সুপ্রিয়া ছিল এক্সেলেন্ট। লড়াকু মেয়ে, জীবনযুদ্ধে যাদের খেটে খেতে হয়, সে রকম চরিত্র ও যেন গুলে খেয়েছিল। কেবল ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’ বা ‘কোমল গান্ধার’-ই নয়, ‘অয়নান্ত’-তে কী অভিনয়! আরেকটা ছবি ‘আকাশছোঁয়া’, রাজেন তরফদারের— অসাধারণ অভিনয়। তালিকা বাড়িয়ে লাভ নেই, আদত কথাটি হল, ভাল অভিনয়ের জন্য প্রয়োজন জীবনের অভিজ্ঞতা, কল্পনাশক্তি, অনুধাবনশক্তি... সেগুলো স্বাভাবিক ভাবেই ঘটে গিয়েছিল ওর জীবনে। বর্মা (মায়ানমার) থেকে আসা, ব্যক্তিগত জীবনের টানাপড়েন, এ সবই ওকে দৃঢ় ও মার্জিত করে তুলেছিল চরিত্রগুলি রূপায়ণে।
তবে এ রকম মাটিতে-পা-রাখা চরিত্রের পাশাপাশি খুব সাবলীল ভাবেই যে সব গ্ল্যামারাস চরিত্র করত, সেখানেও কিন্তু টিপিক্যাল প্রেমিকা কিংবা সাজানো গৃহবধূ কখনওই হতো না সুপ্রিয়া। আমার তো মনে হয়, ও বোধহয় ইচ্ছে করেই প্যাম্পার্ড বা শেলটার্ড চরিত্র নিত না, স্বাবলম্বী চরিত্র করতেই ভালবাসত বেশি, আর মানাতও ওকে সেগুলি। উত্তমদার সঙ্গে ‘কাল তুমি আলেয়া’, ‘শুধু একটি বছর’, ‘শুন বরনারী’... আহা, কী অভিনয়!
আরও পড়ুন: ‘আন্টি দিদুর কাছে দাদুর গল্প সে ভাবে শোনা হয়নি’
সুপ্রিয়ার কথা বলতে গেলে উত্তমদার কথা এসে পড়বেই। ময়রা স্ট্রিটের বাড়িতে লক্ষ্মীপুজো, ‘যদি জানতেম’-এর শুটিংয়ে একসঙ্গে হাজারিবাগে গিয়ে অবসরে তাস, আড্ডা, গান— কী না হয়েছে। আন্তরিকতার দিক থেকে সুপ্রিয়া-উত্তমদা ছিল খুবই আপন। এত আন্তরিক ভাবে শুটিংয়ে রান্না করে এনে খাওয়াত সুপ্রিয়া, এত ভাল রান্না সুপ্রিয়া ছাড়া একমাত্র সাবিত্রীকেই করতে দেখেছি। তো একবার আমায় ফের পেয়ে বসল রসিকতায়, বললাম ‘এত ভাল রাঁধিস তুই, আর এত ভাল অভিনয় করিস, যত ভাল রান্না তত ভাল অভিনয়, কোনটা ছেড়ে কোনটাকে যে ভাল বলব...!’ শুনে অভিমান হয়েছিল সুপ্রিয়ার, বলেছিল ‘ও, পুলু তুই আমাকে ভাল অভিনেত্রী বলতে চাইছিস না তো...।’
আসলে তখন সিনেমা-মহলটাই ছিল একটা পরিবারের মতো, সকলেই যেন আত্মীয় পরিজন, কত ছোট ছোট মুহূর্ত, এত বন্ধুত্ব... আজ ভাবলে সত্যিই অবাক লাগে। তাই সুপ্রিয়ার কথা বলতে গিয়ে ওর সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন মধুর বন্ধুত্বের স্মৃতিই মনে পড়ছে সবচেয়ে বেশি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy