মান্নাদা উত্তেজিত হয়ে সরাসরি ফোন করলেন এইচএমভি-র বড় কর্তা বিশ্বনাথ চট্টোপাধ্যায়কে —‘এটা কেমন হল? নতুন গানের ক্যাসেট রিলিজের অনুষ্ঠান করছেন। আর খোকাকেই নিমন্ত্রণ করেননি? না, না, আমার পক্ষে বোধহয় আপনাদের অনুষ্ঠানে যাওয়া সম্ভব হবে না।’
মান্নাদার এক ফোনেই এইচএমভি-র টনক নড়ল। সঙ্গে সঙ্গে সুপর্ণকান্তির (‘খোকা’ বলে ডাকতেন মান্নাদা) কাছে ফোন—‘খুব ভুল হয়ে গেছে। আপনার সাদর নিমন্ত্রণ।’
১৯৮১। মান্নাদা গাইলেন এক ভীষণ মর্মস্পর্শী গান।১৯৮০ সালের ১৬ অগস্ট চির প্রতিদ্বন্দ্বী ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের খেলায় ভয়ঙ্কর গোলমাল বাঁধে—পদপিষ্ট হয়ে মারা যায় ষোলো জন ফুটবল-প্রেমী দর্শক। বড় মর্মান্তিক ঘটনা। সেই আবহে অভিনেতা সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় লিখলেন একটি অসাধারণ কবিতা—‘খেলা ফুটবল খেলা/খোকা খেলতে গেল/সেই সকাল বেলা/দুটো বড় টিমের খেলা/শত লোকের মেলা।’ তখন ‘কল্পতরু’ প্রোডাকশনের ‘টাকার ফানুষ’ ছবির গানের রেকর্ডিং-এর কাজ চলছে। গান লিখেছেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। সুরকার সুপর্ণকান্তি ঘোষ। সে দিন গাইছেন মান্না দে। স্টুডিওতে উপস্থিত ‘কল্পতরু’র দুই প্রাণ-পুরুষ সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় ও তরুণকুমার। এক সময়ে সত্যবাবু মান্নাদাকে কবিতাটি পড়ে শোনান। সবার মনে হল এই কবিতাটা একটা দারুণ গান হতে পারে। এর আগে পুলক-নচিকেতা-মান্না সৃষ্টি করেছেন ফুটবলের জাতীয় সঙ্গীত ‘আহা, সব খেলার সেরা বাঙালির তুমি ফুটবল’। এই কবিতাটাও তো সেই ফুটবল নিয়ে। আর এমন কবিতাধর্মী, কাহিনিমূলক গান সুর করতে সুপর্ণকান্তির তো জুটি নেই। এর আগে করেছেন—‘কফি হাউস’, ‘সে আমার ছোট বোন’-এর মতো গান। অতএব সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সুপর্ণকান্তির অনেক দিনের সিটিং, কথাগুলোকে সুরের উপযোগী করে তোলা এবং অসাধারণ একটি সুর সংযোজন। সমীর খাসনবিশের মিউজিক অ্যারে়ঞ্জমেন্টে মান্নাদা গাইলেন—‘খেলা, ফুটবল খেলা’। রেকর্ডিংয়ের সময়ও গায়ক এবং সুরকার নানা ভাবে গানটির ইম্প্রোভাইজেশন করছেন। গানের মধ্যে ‘খোকা’ বলে যে ‘কল’টি আছে, সেটি কিন্তু মূল সুরে ছিল না—গাইতে গাইতে রেকর্ডিং-এর সময়ে তৈরি হল। এক একটা মহান সৃষ্টি এমন ভাবেই হয়। গানটি গাইতে গাইতে মান্নাদা বারবার অশ্রুরুদ্ধ হয়ে পড়ছিলেন। হওয়ারই কথা। অত্যন্ত নরম মনের মানুষ, ফুটবল-অন্ত প্রাণ, সেই খেলার জন্য এত মানুষের মৃত্যু। অমন কথা, অমন সুর—চোখে জল তো আসবেই। কোথাও কোথাও কান্না-ভেজা গলাটা গানের সঙ্গে মিশে গেল—অনেকে চাইলেন গাওয়াটা এ ভাবেই থাকুক। আপত্তি করলেন স্বয়ং মান্নাদা। এক মূল্যবান কথা বলেছিলেন সুপর্ণকে—‘গায়কির মধ্যে আবেগটা কতটুকু প্রকাশ করবে, কী ভাবে করবে সেই হিসাবটা জানা চাই। নইলে সব গোলমাল হয়ে যাবে’। সুপর্ণ মনে করতে পারলেন—‘সে আমার ছোট বোন’ গানের রেকর্ডিংয়ের সময়ও এমন ঘটনা ঘটেছিল। গাইতে গাইতে অনেক বার কেঁদে ফেলছিলেন। ফাইনাল ‘টেক’-এ নিজেকে সামলে নিয়েই গেয়েছিলেন। ফল কি হল? মান্নাদা গাইলেন, আর আমরা যারা শুনলাম, শুনতে শুনতে কাঁদলাম, কাঁদতে কাঁদতে শুনলাম।
এমন একটি গান যার অসাধারণ সুরারোপে সৃষ্টি হল, তাকেই কিনা রেকর্ড কোম্পানি নিমন্ত্রণ করতে ভুলে গেল। গীতিকার-সুরকারদের উপর মান্নাদার ছিল অসীম শ্রদ্ধা। কোনও ভাবেই তাদের অবমাননা মান্নাদা সহ্য করতে পারতেন না। কলকাতা প্রেস ক্লাবে ১৯৮১ সালে ফুটবল নিয়ে এই ক্যাসেটটি উদ্বোধন হয়। গায়ক-গায়িকা-সুরকার ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন মান্নাদার পরম বন্ধু সেবাব্রত গুপ্ত, স্নেহাংশু আচার্য আর সব ফুটবল নক্ষত্র।
মান্নাদা আর কবিতা কৃষ্ণমূর্তির নাম এমন ভাবে জড়িয়ে আছে, অনেকে ভাবেন কবিতা মান্নাদার শালি। কবিতা নিজে মনে করেন তিনি মান্নাদার তৃতীয় কন্যা। মান্নাদার বড় কন্যা সুরমা ছিল কবিতার অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। কবিতার প্রসঙ্গে একটা কথা বলি। সাউথ ইন্ডিয়ান মেয়ে। কেরিয়ার মূলত মুম্বাইতে। এত ঝরঝরে বাংলা সে বলে কি করে? কোথায় শিখল? আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে খুব ছোট বেলায় কবিতার মা মারা যান। সেই ছোট বেলা থেকে প্রতিমা ভট্টাচার্য নামে এক বাঙালি মহিলা কবিতার দেখাশোনা করতেন। তার সঙ্গে সব সময় কথা বলতে বলতে কবিতা মাতৃভাষার মতো বাংলাটা শিখে যায়। কবিতা ছিল মান্নাদার বড় মেয়ে সুরমাদির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সেই সূত্রে পরিবারের একজন হয়ে ওঠা। আর সঙ্গে ছিল গান। মান্নাদার প্রত্যক্ষ গাইডেন্স। কবিতা যখন মুম্বাইতে কলেজ-ছাত্রী, তখন তাদের একটা গানের দল ছিল ‘সঙ্গীত মণ্ডল’। তাদের আমন্ত্রণে মান্নাদা কত বার এসেছেন অনুষ্ঠান শুনতে, উৎসাহ দিতে। এখনও কবিতার মনে পড়ে লন্ডনের অ্যালবার্ট হলে সেই অনুষ্ঠানের কথা। অ্যালবার্ট হলে গান গাওয়া তো যে কোনও শিল্পীর জীবনে স্বপ্ন। আর তখন তো কবিতার নিতান্ত অল্প বয়স। আর গাইছেন কার সঙ্গে? মান্না দে। হল ভর্তি সমঝদার শ্রোতা। কবিতা নার্ভাস। সাহস জোগালেন মান্নাদা— ‘কবিতা, চিয়ার আপ, আজ তুমি দারুণ গাইবে’। একটা ঘোরের ভিতর দিয়ে সময়টা চলে গেল। সম্বিত ফিরল মুগ্ধ শ্রোতাদের করতালিতে।
যে মান্নাদা তাকে সব সময় আড়ালে রাখতেন, একদিন সেই মান্নাদার কাছে এমন বকুনি খেল যে চোখের জল ধরে রাখতে পারল না। তখন ‘মোহরা’ ছবি মুক্তি পেয়েছে। বিজু শাহ-র সুরে রবিনা ট্যান্ডনের লিপে কবিতার গাওয়া ‘ম্যায় চিজ ভরি হ্যায় মস্ত মস্ত’ সুপার-ডুপার হিট। সে গানে হিমালয় থেকে কন্যাকুমারিকার তামাম মানুষ একই সুরের দোলায় দুলছে। কবিতার গান এত জনপ্রিয় হয়েছে, মান্নাদার খুশি হওয়ারই কথা। কবিতা এসেছে মান্নাদার বাড়িতে। মান্নাদার মুখটা থমথমে। এ রকম তো হওয়ার কথা নয়। মান্নাদা আহত মুখে বললেন, ‘এ গান তুমি গাইলে কি করে কবিতা? তুমি না একটা মেয়ে। আর একটা মেয়ে হয়ে গাইতে পারলে ‘ম্যায় চিজ ভরি হ্যায় মস্ত মস্ত’ আমি ভাবতেও পারিনি। গাইবার আগে একবার কথাগুলো দেখবে না? কি বলছো? ভারতীয় নারীর মান-মর্যাদা তুমি ভুলে গেলে? আই ডি’ডন্ট এক্সপেক্ট ফ্রম ইউ?’ কবিতা তো কেঁদেই আকুল। বাঁচালেন এসে বউদি। বকলেন মান্নাদাকে—‘কেন তুমি মেয়েটাকে এমন করে বকছো,’ তার পর কবিতাকে জড়িয়ে ধরে নিয়ে গেলেন ভিতরের ঘরে।
মেয়েদের প্রতি মান্নাদার ছিল অসীম শ্রদ্ধা। আর সেই মহিলা শিক্ষিতা হলে তো কথাই নেই। একবার মান্নাদার সঙ্গে গল্প-গুজব চলছে মদন ঘোষ লেনের বাড়িতে। এমন সময় একজন খুব সুন্দরী মহিলা ভিতর বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার মুখে বললেন—‘কাকাবাবু আসছি’। মান্নাদার মুখটা প্রসন্ন হয়ে উঠল। তিনি চলে গেলে মান্নাদা খুব গর্বিত মুখে বললেন—‘ও রিনা, সুদেবের স্ত্রী। খুব এডুকেটেড মেয়ে, পোস্ট-গ্রাজুয়েট, বি এড।’
কবিতার কথা বলছিলাম। ওর কথা দিয়েই শেষ করি। ২০১৩-র ১০ জুন গিয়েছিলাম বেঙ্গালুরে দেবী শেঠির নারায়ণা হৃদয়ালয় হসপিটালে। সেখানে দেখা কবিতার সঙ্গে। একেবারে বিধ্বস্ত অবস্থা। কোনও ভাবে বলল ‘মান্নাদা যে দিন ভর্তি হলেন, সে দিন ওনাকে দেখে এসে এত কষ্ট হয়েছিল। শরীরটা একদম ছোট হয়ে গেছে। সেই মানুষটা.....না জানলে চিনতেই পারতাম না।’ কবিতা কাঁদছিল—‘এত অসুস্থ মান্নাদাকে কেন যে দেখলাম।’
মনে মনে ধন্যবাদ জানালাম ঈশ্বরকে। সেই মান্নাদাকে আমায় দেখতে হয়নি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy