‘‘প্রথমে তো ব্ল্যাকবেরি ছাড়া এক মুহূর্ত চলত না আমার। কিন্তু গত কয়েক বছর দেখছি মাঝে মাঝেই হ্যাং করে যায়। আর একবার হ্যাং করে গেলে মেল-এসএমএস-বিবিএম— কিচ্ছু করা যায় না। সে জন্যই এখন আর শুধু ব্ল্যাকবেরির উপর ভরসা করতে পারি না। আইফোনই ব্যবহার করি। অনেক দিনের অভ্যেস বলে ছাড়তে পারিনি। ব্ল্যাকবেরি জেড টেন-টা রেখে দিয়েছি ব্যাকআপ ফোন হিসেবে,’’ বলছিলেন নায়িকা ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত।
ঋতুপর্ণার মতো অনেকেই সরে এসেছেন তাঁদের একসময়ের চোখের মণি ব্ল্যাকবেরি থেকে। এই কিছু দিন আগে প্রীতীশ নন্দীও বেশ রেগেই টুইট করেছিলেন। তাঁর সমস্যা হচ্ছিল ব্ল্যাকবেরি কিউ টেন মডেল নিয়ে। তবে এ দুর্ভোগের শিকার কম বেশি সব ব্ল্যাকবেরি ব্যবহারকারী। ব্ল্যাকবেরির অনলাইন সাপোর্ট ফোরামে একবার উঁকি দিলেই দেখা যায়। কিন্তু কেন ব্ল্যাকবেরির বিশ্বজোড়া সাম্রাজ্যের এমন পতন।
নতুনত্ব কিছু আনতে পারল না
একদল প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞর মতে টেক-দুনিয়ায় এটাই নিয়ম। প্রত্যেক দু’বছরে সেখানে পাল্টে যায় ছবিটা। যেমন ভাবে নোকিয়া বা মোটোরোলা হারিয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে, ব্ল্যাকবেরিও তেমনটাই হবে। শুধু ফোনের ক্ষেত্রেই নয়, অ্যাপের দুনিয়ায় সে নিয়মের ব্যতিক্রম হয়নি। ফেসবুক না ছাড়লেও জেন ওয়াই-য়ের ইন্সটাগ্রাম-প্রীতি কিন্তু তারই ইঙ্গিত দেয়।
‘‘প্রযুক্তির বাজারে অভিনব কিছু না আনলে সরে যেতেই হবে। ব্ল্যাকবেরিরও তাই হয়েছে। ওরাই কিন্তু প্রথম ফোনের সঙ্গে মেলকে জুড়ে দিতে পেরেছিল। তারপর বিবিএম-এর মতো সার্ভিস। কিন্তু সেখানেই আটকে গেল। নতুনত্ব কিছু আনতে পারল না। সেই বাজারটা অ্যানড্রয়েড আর আইওস দখল করে নিল। আমিও তাই সরে এলাম ব্ল্যাকবেরি থেকে,’’ বলছিলেন ডা. কুনাল সরকার।
টেক দুনিয়ার অলিখিত নিয়ম: নিজেকে বদলাতে হবে। ফেসবুক যেমন সেই দেওয়াল লিখন আগেই পড়ে নিয়েছিল। আর ইন্সটাগ্রামকে ঠিক সময়ে কিনে নিয়েছিল। অ্যাপলেরও ঠিক তেমনটাই হয়েছিল। দেউলিয়া ঘোষণা করার খাদের ধার থেকে ফেরত এনেছিল নতুন প্রোডাক্ট আইপড। ব্ল্যাকবেরি সেটা একদম করতে পারেনি। তার ছাপ পড়েছে শেয়ার বাজারেও। ২০১১তে ন্যাসডাকে ব্ল্যাকবেরির শেয়ার ভ্যালু যেখানে ঘোরাঘুরি করছিল ৬০ ডলারের কাছাকাছি, আজ সেটাই এসে ঠেকেছে ৬-৭ ডলারে।
জেন ওয়াই আর হাতে নিচ্ছে না
এক সময়ের একচ্ছত্র সাম্রাজ্য আজ আক্রান্ত অ্যাপলের আইফোন আর গুগলের অ্যান্ড্রয়েড ডিভাইসে। এমনকী লোকসানের বোঝা কমাতে কিছু দিন আগে ব্ল্যাকবেরি বাধ্যও হয়েছিল কর্মী ছাটাইয়ে। সময় যে খারাপ সেটা ভাল মতোই টের পাচ্ছেন সংস্থার কর্মকর্তারা। ব্ল্যাকবেরির ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন করলে কিছু দিন আগেই সিইও জন এস চেন বলেছিলেন, ‘‘বলা খুব শক্ত...।’’ এই ২০১৫তেও যাঁরা এখনও ব্ল্যাকবেরি ব্যবহার করছেন, তাঁদের অধিকাংশই এন্টারপ্রাইজ সার্ভিসের জন্য। কিন্তু সেই বাজারও হাতছাড়া হতে চলেছে ব্ল্যাকবেরির। মাত্রাতিরিক্ত দাম বাড়ানোর ফলে অনেক অফিসই আর ওই সার্ভিস ব্যবহার করে না। ফলে একসময়ের ‘লয়াল’ ক্রেতার বাজারেও ভাঁটা পড়েছে ব্ল্যাকবেরির।
পুরনো বাজার যেমন হারিয়েছে, তেমনই নতুন বাজারও ধরতে পারেনি ব্ল্যাকবেরি। জেন ওয়াইয়ের কাছে ফোন হিসেবে ব্ল্যাকবেরি ব্যবহার করা আর আগুনের জন্য চকমকি পাথর ঘষা একই ব্যাপার। এই প্রজন্মের অভিনেতা অঙ্কুশই যেমন কেরিয়ারের শুরুতে একটা ব্ল্যাকবেরি কার্ভ ব্যবহার করলেও এখন পুরোপুরি স্যামসুং গ্যালাক্সি এজে মজে। ‘‘তখন বিবিএম খুব দরকার হত, তাই ব্ল্যাকবেরি ছাড়া রাস্তা ছিল না। কিন্তু এখন তো বিবিএম যে কোনও অ্যানড্রয়েড ফোনেও এসে গেছে। আর বিবিএম-এর প্রয়োজনও তো আর হয় না। সবাই এখন হোয়াটসঅ্যাপ করে দিচ্ছে। ব্ল্যাকবেরির যে ‘এলিট’ তকমাটা ছিল সেটাও এখন আইফোন কব্জা করে নিয়েছে। নতুন পাসপোর্ট মডেলটা ভাল লেগেছে, কিন্তু ব্ল্যাকবেরিতে তো সব অ্যাপস পাওয়াও যায় না। আমি তাই ব্ল্যাকবেরি ছেড়ে দিয়েছি,’’ বলছিলেন অঙ্কুশ।
ব্ল্যাকবেরি সাম্রাজ্যের পতনের শুরু যে হয়ে গিয়েছে, তা আর নতুন করে বলার দরকার নেই। তবে রাস্তায় ‘ভাঙাচোরা আছে?’ শুনলে আবার...