সিনেমাঘরটা পুরোপুরি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। ডলবি ডিজিটাল। এমনকী ‘ফুড কোর্ট’ও আছে।
নতুন প্রজন্মের দর্শকদের টানতে বছর দু’য়েক আগে এই ভাবেই ঢেলে সেজেছে বেলডাঙার নিউ গন্ধেশ্বরী টকিজ। তবুও লোক হচ্ছে কই। সাড়ে পাঁচশো আসনের প্রেক্ষাগৃহে অন্তত ১৫ জন দর্শক পেলেই শো চালু রাখা হয়। কিন্তু মাঝে-মধ্যে সেই ১৫ জনের কোটাও পূরণ না হওয়ায় শো বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছেন কর্তৃপক্ষ।
বেলডাঙার শুধু এই একটি প্রেক্ষাগৃহ নয়, এমনকী শুধু মুর্শিদাবাদও নয়, এই দুরবস্থা রাজ্য-দেশ জুড়ে। ইন্টারনেট, ইউটিউব আর অবৈধ ডিভিডি-র ব্যবসায় এইভাবেই মার খাচ্ছে সিনেমাঘরগুলি। যাঁরা পারছেন, লোকসান সত্ত্বেও চালিয়ে যাচ্ছেন। যাঁরা পারছেন না, প্রেক্ষাগৃহ ভেঙে ফেলে সেখানে ফ্ল্যাটবাড়ি তুলছেন। বাঙালির চলচ্চিত্রপ্রীতির এমনই ছন্নছাড়া দশা বিশ্বায়নের যুগে।
বেলডাঙা শহরে আগে চারটি সিনেমাহল ছিলরানি, শ্রীকৃষ্ণ, নিউ মিতালি টকিজ ও নিউ গন্ধেশ্বরী টকিজ দশকের পর দশক ধরে রমরমিয়ে সেখানে চলছে সাদা-কালোর সপ্তপদী থেকে রঙিন অন্যায়-অবিচার। হাউসফুলের বোর্ড ঝুলত হামেশাই। টিকিট না পেয়ে ফিরে যেতেন লোকজন, কখনও বা ব্ল্যাকে টিকিট কেটে দ্বিগুণ তিন গুণ দামে ছবি দেখা হত। এমনকী শহরের দু’টি বড় ভিডিও পার্লারেও উপচে পড়ত ভিড়।
সে সবই অবশ্য অতীত। নিউ মিতালি টকিজ ও নিউ গন্ধেশ্বরী চলছে টিমটিমিয়ে। বাকি দু’টো বন্ধ। প্রথমে ব্যবসায় মন্দা, পরে জমিজট ও লাইসেন্সজনিত সমস্যার কারণে বন্ধ হয় শ্রীকৃষ্ণ টকিজ। সেই জায়গায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বহুতল বসতবাড়ি তৈরি হয়। অন্যদিকে রানি সিনেমাহলটি ভেঙে প্লট করে জমি বিক্রি হচ্ছে। রানির মালিকপক্ষের তরফে শিখা মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বিদ্যুৎ বিল, পুরকর, লাইসেন্সজনিত ব্যায়ভার মেটাতেই সমস্ত টাকা বেরিয়ে যাচ্ছিল। লাভ তো দূরের কথা, লোকসানই হচ্ছিল শুধু। প্রতি শো চালাতে ন্যূনতম এক হাজার টাকা খরচ হয়। সেই টাকাও উঠছিল না। আমরা লিজে কয়েকজনকে ছেড়ে দিয়েছিলাম। তারাও চালাতে পারল না। সিনেমাহল বন্ধ করার পর রাতের অন্ধকারে মেশিন, চেয়ার, ফ্যান চুরি হয়ে গেল। বাধ্য হয়ে আমরা হল ভেঙে ফেললাম। বর্তমানে জমি ভাগ করে বিক্রি করতে হচ্ছে।” স্থানীয় সূত্রে জানা গেল, শেষ দিকে ব্যবসা চালু রাখার জন্য রানিতে প্রাপ্তবয়স্কদের ছবিও দেখানো হচ্ছিল। লাভ হয়নি তাতে। নাম খারাপই হয়েছে শুধু।
বেলডাঙার চালু সিনেমা হলগুলির মধ্যে অন্যতম নিউ মিতালি। পুরনো ভবন ভেঙে প্রচুর খরচ করে ৯৫০ আসনের আধুনিক প্রেক্ষাগৃহ বানিয়েছিলেন এই হলের মালিকরা। ভাল শব্দ ব্যবস্থা, বসার আসন, নিরাপত্তাকর্মীদর্শকদের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য যা যা প্রয়োজন, সবই করা হয়েছিল। এমনকী টিকিটঘরের কাছে একটা রেস্তোরাঁ বানিয়েছেন হল কর্তৃপক্ষ। তবুও লোকের অভাবে মাঝে-মধ্যে শো বন্ধ রাখতে হচ্ছে নিউ মিতালিকেও। মালিকপক্ষের তরফে আব্দুর রহমান বলেন, ‘‘আর চালাতে পারছি না। দৈনিক সংবাদপত্রে তাই বিক্রির বিজ্ঞাপন দিয়েছি। বিক্রি যত দিন না হচ্ছে ততদিন সুষ্ঠু ভাবে চালানোর চেষ্টা করছি।”
বেলডাঙার এখন সবচেয়ে ভাল সিনেমাঘর নিউ গন্ধেশ্বরী। কয়েক কোটি টাকা খরচ করে এটিও নতুন ভাবে ঢেলে সেজেছে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত, ডলবি ডিজিটাল সাউন্ড, ব্ল্যাকবেল্টধারী নিরাপত্তা কর্মী, ঝাঁ চকচকে অন্দরসজ্জা করেও সেই ভাবে দর্শক টানতে পারছে না নিউ গন্ধেশ্বরী। রমজানের মাসে মাঝে-মধ্যেই লোক কম হচ্ছে বলে শো বন্ধ রাখতে হচ্ছে। মালিকপক্ষের তরফে শ্যামল সওদাগর অবশ্য বলেন, ‘‘এটা শুধু ব্যবসা নয় পরিবারের ঐতিহ্যও বটে। সব ব্যবসায় সময়-অসময় থাকে। এতে আমরা বিচলিত নই। ভবিষ্যতে এই এসি হলের নীচে একটা দু’শো আসনের ছোট অত্যাধুনিক প্রেক্ষাগৃহ তৈরির কথাও ভাবছি আমরা।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy