Advertisement
১০ মে ২০২৪

পড়তে হবে না শুনলেই চলবে

রবীন্দ্রনাথের ‘গল্পগুচ্ছ’। পঁচানব্বইটা গল্প। ঊনচল্লিশ শিল্পী। খোঁজ নিলেন সংযুক্তা বসুরবীন্দ্রনাথের ‘গল্পগুচ্ছ’। পঁচানব্বইটা গল্প। ঊনচল্লিশ শিল্পী। খোঁজ নিলেন সংযুক্তা বসু

শেষ আপডেট: ০৫ মার্চ ২০১৪ ০৫:০৩
Share: Save:

মাত্র কয়েক মাস আগের কথা।

বাড়ি থেকে রাস্তায় টেনে এনে নৃশংস ভাবে তালিবানেরা হত্যা করেছিল কাবুলিওয়ালার বাঙালি বৌ সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে।

খবর জেনে খেপে উঠেছিল বাঙালি। সুস্মিতার হত্যাকারীদের ক্ষমা করার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু এটা নিশ্চিত ক্ষমাপ্রবণ বর্ষীয়ান বাঙালির আবারও হয়তো মনে পড়ে যাবে আর এক কাবুলিওয়ালার কথা। তার নাম রহমত আলি। আট বছর জেল খেটে ফিরে এসে এই কলকাতা শহরেরই কোনও এক ঠিকানায় সে খুঁজেছিল তার আদরের মিনিকে। তার আদরের মিনি।

সে দিন মিনির বিয়ে। লাল চেলি, কপালে চন্দন মিনি এসে দাঁড়াল বধূবেশে। রহমত হেসে বলল ‘খোঁখী সসুরবাড়ি যাবিস?’ রহমতের ছলছল চোখে ভেসে ওঠে তখন আফগানিস্তানের আদিগন্ত মরুপ্রান্তর। হেঁটে আসছে তার একরত্তি মেয়ে..।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

প্রমিতা মল্লিক

আজও ‘কাবুলিওয়ালা’ ছবির শেষ দৃশ্য বাঙালির চোখে জল আনে। দেশ-কাল আলাদা। কিন্তু পিতৃহৃদয়? সে তো দেশকালের সীমানা মানে না। সিনেমায় ছবি বিশ্বাসকে দেখা গিয়েছিল রহমতের চরিত্রে। আর এ বার রহমতের গল্প বলবেন স্বয়ং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। গল্প পাঠ করবেন অভিনেতা সব্যসাচী চক্রবর্তী ও বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী।

আর ‘চারুলতা’ ছবির ‘অমল-চারু-ভূপতি’র জীবনের কথক এ বার কারা? জগন্নাথ বসু ও ঊর্মিমালা বসু। ‘স্ত্রীর পত্র’ ছবিতে মাধবী মুখোপাধ্যায়ের অনন্য অভিনয় ভোলার নয়। সেই জায়গায় সাতাশ নম্বর মাখন বড়াল লেনের বাঁধা গতের জীবন থেকে বেরিয়ে আসা মৃণালের চিঠির বয়ান পড়ছেন গায়িকা প্রণতি ঠাকুর।

রোজকার জীবনের মায়াময় উড়ানেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গল্পগুচ্ছ’র ‘অতিথি’ গল্পের তারাপদ, ‘দেনাপাওনা’র নিরুপমা, ‘ছুটি’র ফটিক, ‘জীবিত ও মৃত’র কাদম্বিনী, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’য়ের মেহের আলি, ‘সমাপ্তি’র মৃন্ময়ীরা একে অপরের চেয়ে আলাদা হয়ে যায়॥

কিন্তু এত শিল্পীকে নিয়ে এই রকম বিশাল সংগ্রহ তৈরি করার চিন্তাটা এল কী ভাবে? এখন সিডি কেনার অভ্যেস কমিয়ে ডাউনলোড-প্রবণতা বেড়েছে। প্রযোজক সংস্থার পক্ষ থেকে বিশ্ব রায় বললেন, “সিডি কেনা যে বন্ধ হয়ে গিয়েছে তা নয়। ছেলেমেয়েদের পড়ার অভ্যেস চলে গিয়েছে। তাদের যদি রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে সামান্য আগ্রহও থাকে তো শুনবে।”

সঙ্কলনে আবৃত্তিশিল্পী ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ কয়েকটি গল্প পড়ে বলছেন, “সমগ্র গল্পগুচ্ছ পাঠ উদ্যোগ হিসেবে এটা সর্বপ্রথম। এবং নতুন ধরনের। যাঁরা রবীন্দ্রনাথ নিয়ে গবেষণা করছেন, তাঁদের এই সিডি কালেকশন কাজে লাগবে।” সঙ্কলনের দাম পাঁচ হাজার টাকা কেন হল? উত্তরে ‘ভাবনা’র পক্ষ থেকে বিশ্ব রায় বললেন, “অ্যালবামটা তৈরি করতেই প্রচুর খরচ হয়েছে। দামটা ফ্যাক্টর নয়। আসল হল আর্কাইভাল মূল্য। বাড়িতে এমন একটা সিডি থাকা মানে নানা সুসময়ে-অসময়ে রবীন্দ্রনাথের গল্পগুলো শুনে জীবনকে অনুভব করা যাবে। যাঁরা কেনার, তাঁরা ঠিকই কিনবেন। আমার ধারণা দৃষ্টিহীনেরাও ইচ্ছে করলে অ্যালবাম শুনে রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের স্বাদ পেতে পারেন।’’

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় পড়েছেন মোট আঠারোটা গল্প। তিনি বললেন, “গল্পগুচ্ছের গল্পের আবেদন অন্যান্য সব পাঠযোগ্য বিষয়কেই মনে হয় যেন ছাপিয়ে যায়। নানা স্বাদের আঠারোটা গল্পে রবীন্দ্রনাথের ভাবনার বৈচিত্রকেই ধরার চেষ্টা করেছি।” শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার বলছেন, “সৌমিত্রদার মুখে ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পে পোস্টমাস্টারের সঙ্গে বালিকা রতনের অনামা সম্পর্ক একটা আলাদা মাত্রা পাবেই। এতটুকু অতি-অভিনয় না করে শুধুু কিছু অনুভূতির নিরুচ্চার-উচ্চারণে গল্পের ভেতরকার নির্যাসটা ধরে রেখে আঠারোটা গল্প পড়া ওঁকেই মানায়। তবে এ অ্যালবামে বাকি শিল্পীরাও একই ভাবে চমৎকার। সিনেমার প্রযুক্তি যতই উন্নত হোক, আসুক না ই-বুক, মুখে মুখে গল্প শোনার রোমাঞ্চটা থেকেই যাবে। এমনকী যাঁরা এখনও অক্ষরজ্ঞানহীন তাঁদেরও শোনানো যেতে পারে গল্পগুলো।” পবিত্র নিজেও পাঠ করেছেন পড়ন্ত জমিদারির গৌরব নিয়ে বেঁচে থাকা কৈলাস চৌধুরীকে নিয়ে গল্প ‘ঠাকুর্দা।’

শ্রাবন্তী মজুমদার থেকে বিজয়লক্ষ্মী বর্মণ, শাশ্বতী গুহ ঠাকুরতা, চৈতালী দাশগুপ্ত, পার্থ-ঘোষ-গৌরী ঘোষ থেকে ইন্দ্রাণী ভট্টাচার্যের মতো বাচিক শিল্পীরা বেশ অনেকটা জায়গা নিয়ে আছেন ‘গল্পগুচ্ছ’ সিডি সমগ্রে। “যে সব ছেলেমেয়ে একদম বই পড়ে না, তারা যদি সিডিগুলো শোনে, কিছুটা অন্তত রবীন্দ্রনাথের গল্পগুলোকে জানতে পারবে। ইচ্ছে হলে একটানা না শুনে মাঝে মাঝে শুনবে। আমাদের কি রবীন্দ্রনাথ বাদ দিয়ে চলে?” বলছেন অলৌকিক গল্প ‘মণিহারা’ ও আরও বেশ কিছু গল্পের বাচিক শিল্পী রায়া ভট্টাচার্য।

তা হলে কি এ বার গল্পটল্প পড়ার পাটটা উঠেই যাবে? সবটাই শ্রবণ? ‘ঘাটের কথা’ গল্পের কথক সুবীর মিত্র কিন্তু মনে করেন, তা হওয়ার নয়। পড়ার ব্যাপারটা যেমন ছিল তেমনই থাকবে। “বিদেশে এখন গল্পের সিডি খুব চলছে। লোকে এখন গাড়ি চালাতে চালাতে সিডিতে গল্প শোনে, অন্য কাজ করতে করতেও গল্প শোনা যায়,’’ বললেন আনন্দ পাবলিশাসের্র কর্তা সুবীর। তাঁর সঙ্গে একমত গায়িকা প্রমিতা মল্লিক। বহু অনুষ্ঠানে গল্প পাঠ করলেও ‘গল্পগুচ্ছ’ পাঠ এই প্রথম। পড়েছেন তিনটি গল্প, ‘একটি আষাঢ়ে গল্প’, ‘কঙ্কাল’ ও ‘জয়পরাজয়’। “আমার ধারণা এই অ্যালবাম বিদেশের বাঙালিদের খুব মনে ধরবে। কারণ ইতিমধ্যে রেকর্ডে গল্প শোনার অভ্যেস তৈরি হয়ে গিয়েছে,” বলছেন প্রমিতা।

‘গল্পগুচ্ছ’ মানে কি শুধু মানুষেরই স্বভাব উন্মোচন? না। জীবন্ত হয়ে উঠতে পারে নিষ্প্রাণ জিনিসও। যেমন ‘রাজপথের কথা’ গল্পে এক রাজপথ নিজেই বলছে তার গল্প। গল্পপাঠক আইপিএস বি ডি শর্মা কারা সংশোধনাগারের দায়িত্বে ছিলেন যখন, বন্দিদের নিয়ে তিনিই করেছিলেন ‘বাল্মীকিপ্রতিভা’। তার পর সেই গল্প নিয়ে ছবি হয়েছিল ‘মুক্তধারা’। শর্মা বললেন, ‘‘‘রাজপথ’ গল্পে, রাজপথ যেন মানুষ। কত ঘটনার সাক্ষী সে। কিন্তু কিছুই করার থাকে না তার। কী অসাধারণ দর্শন রবীন্দ্রনাথের।” গল্প পড়তে গিয়ে বেশ কিছুটা সময় দিতে হয়েছিল গায়িকা শ্রাবণী সেনকে। রসিকতা করে বললেন , ‘‘প্রথম দিনের রেকর্ডিংটা ফেলেই দিতে হয়েছিল।”

রবিঠাকুর ছোট গল্পের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে লিখেছিলেন ‘‘অন্তরে অতৃপ্তি রবে/ সাঙ্গ করি মনে হবে/শেষ হয়েও হইল না শেষ...” এই অ্যালবামের গল্পপাঠগুলো কি আটপৌরে সংসারের সেই অশেষ প্রান্তে নিয়ে যেতে পারবে শ্রোতাদের?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

entertainment soumitra promita
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE