Advertisement
০৪ মে ২০২৪
বিশেষ সংখ্যা

ফাগুরাম... কানহাইয়ের ফলিং সুইপ... বিশ্বনাথের তিরিশ

ইডেনের প্রতিটি ঘাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে হাজারো স্মৃতি। সেই সরণি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দশটা মাইলফলক খুঁজে পেলেন রাজু মুখোপাধ্যায়। সঙ্গে ছিলেন রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়।ইডেনের প্রতিটি ঘাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে হাজারো স্মৃতি। সেই সরণি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দশটা মাইলফলক খুঁজে পেলেন রাজু মুখোপাধ্যায়। সঙ্গে ছিলেন রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়।

শেষ আপডেট: ২০ অক্টোবর ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:


গোড়াপত্তন

বাংলায় প্রথম স্বীকৃত ক্রিকেট ম্যাচ ইডেনে হয়নি। হয়েছিল রাজভবনের উল্টো দিকের মাঠে, এখন যেখানে মহমেডান মাঠ। ১৭৮০ সালের ওই ম্যাচে ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাবের প্রতিপক্ষ কারা ছিল, আজ সঠিক করে আর বলা যায় না। পরে অবশ্য রাজভবনের উল্টো দিকে ওরা আর খেলত না। চলে গিয়েছিল এখন যেখানে কাস্টমস মাঠ, সেখানে। ইডেনে ক্রিকেট শুরু অনেক পরে, ১৮৬৪ সালে। ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাবের তখন কোনও স্থায়ী মাঠ ছিল না। সরকারের কাছে ওরা আবেদন করেছিল একটা স্থায়ী মাঠের। তখনই ইডেন গার্ডেন্স ওদের দেওয়া হয়। যে মাঠে প্রথম ম্যাচ ওই ১৮৬৪-তেই, অক্টোবর মাসে।


বাংলার প্রথম গর্জন

ভদ্রলোকের নাম বিধু মুখোপাধ্যায়। বাঙালিদের মধ্যে উনিই প্রথম, যিনি সাহেবদের নিয়ে তৈরি ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাবের বিরুদ্ধে ইডেনে সেঞ্চুরি করেন। ডান হাতে ব্যাট করতেন, অসাধারণ ফিল্ডার। যিনি আবার নিয়ম করে দু’টো টিমের হয়ে নামতেন। কখনও নাটোরের মহারাজার দলে, কখনও আবার কোচবিহারের মহারাজার টিমের প্রতিনিধি হয়ে। তবে দুর্ধর্ষ ক্রিকেটার হয়েও তাঁর সর্বভারতীয় টিমে খেলা হয়নি। ১৯১১ সালে পাতিয়ালার মহারাজার উদ্যোগে ইংল্যান্ড সফরের জন্য যে অল ইন্ডিয়া টিম হয়, তার ট্রায়ালে ডাক পেয়েছিলেন বিধুবাবু। ক্রিকেট নয়, তাঁকে আটকে দিয়েছিল সমাজের কুসংস্কার। বিধুবাবুর পরিবার তাঁকে বলে দেয়, কালাপানি পেরোলে তোমার জাত যাবে। বিধুবাবু ইংল্যান্ড গেলেন না। ভারতীয় ক্রিকেটও প্রথম এক দুর্ধর্ষ বাঙালি ক্রিকেটারকে হারাল।


ফাগুরামদের কথা

‘ইডেন কিউরেটর’ শুনলেই এখন প্রবীর মুখোপাধ্যায়কে মনে পড়বে। আজ থেকে নয়, একদম গোড়ার দিন থেকেই পিচের জন্য ইডেন বিখ্যাত। ১৯২৬ সালে এমসিসি টিম নিয়ে বেসরকারি টেস্ট খেলতে এসেছিলেন আর্থার গিলিগান। ইডেনের মাঠ দেখে চমকে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, এ মাঠ তো লর্ডসের সমতুল্য! প্রশংসার বেশিটাই ছিল ফাগুরামকে নিয়ে। ফাগুরামই তখন ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাবের মাঠ পরিচর্যার দায়িত্বে। ফাগুরামের পরম্পরা ধরে রেখেছিলেন তাঁর দুই বংশধর কালুরাম এবং বালুরাম। এর পরেও বহু অসাধারণ কিউরেটর পেয়েছে ইডেন। ভূপেন দত্ত, জগদীশ বন্দ্যোপাধ্যায়, বংশী, মহেশ্বর, সনাতন থেকে কল্যাণ মিত্র বা আজকের প্রবীরবাবু।

স্পিরিট অব ক্রিকেট

জগদীন্দ্রনাথ রায় তখন নাটোরের মহারাজা। উনি ভাবতেন, টিম করব ভারতীয়দের নিয়ে। বিদেশি সাহায্য নেব না। তাতে যা হওয়ার হবে। ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাবে তখন সাহেবরা খেলতেন। নাটোরের মহারাজার টিমের সঙ্গে ম্যাচ ছিল সিসিসির এবং মহারাজার টিম ম্যাচটা জিতেছিল। হারার পর সিসিসি ক্যাপ্টেন মহারাজাকে তির্যক ভাবে বলে বসেন, এতগুলো পেশাদার প্লেয়ার নিয়ে আপনারা খেললেন। আপনারা তো জিতবেনই। মহারাজা তাঁকে পাল্টা বলেন, আমার টিমে তো যদ্দুর জানি আমিই একমাত্র পেশাদার ক্রিকেটার। কারণ আমার কোনও কাজ নেই। বাকিদের আছে। মহারাজা সে দিন বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, ক্রিকেটে হারার পর অজুহাত খোঁজা উচিত নয়। দেখা উচিত নয় কে পেশাদার, কে পেশাদার নয়। মাঠে নামলে সবাই-ই ক্রিকেটার।

যখন প্রতিবাদের মুখ

১৯৪৫ সালে কলকাতায় বেসরকারি টেস্ট খেলতে এসেছিল অস্ট্রেলিয়া সার্ভিসেস। ক্যাপ্টেন ছিলেন লিন্ডসে হ্যাসেট। যে টিমে প্রবাদপ্রতিম কিথ মিলারও ছিলেন। আর তাঁরা দেখেছিলেন, কী ভাবে এক জন প্লেয়ারকে স্রেফ চাপ দিয়ে টিমে ঢুকিয়ে দিতে পারে ইডেন দর্শক। মুস্তাক আলির কথা বলছি। মুস্তাককে অস্ট্রেলিয়া সার্ভিসেসের বিরুদ্ধে টিমে রাখা হয়নি। ইডেন দর্শকও বলে দিয়েছিল: নো মুস্তাক, নো টেস্ট। আর সেই প্রতিবাদের প্রতাপ এতটাই ছিল যে, মুস্তাক আলিকে টিমে নিতে বাধ্য হন নির্বাচকরা। আমার মনে হয় না বিশ্ব ক্রিকেটের ইতিহাসে এ রকম আর কোথাও কখনও ঘটেছে বলে। যেখানে দল নির্বাচন করেছে এক জন ক্রিকেটারের জনপ্রিয়তা।

রোহন কানহাই

গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ

মিউজিয়াম নয়, গ্যালারি

ইডেনে ঘটে যাওয়া কলঙ্কের মধ্যে এটাকে উপরের দিকেই রাখব। ১৮৭১ সালে ইডেনের অনিন্দ্যসুন্দর প্যাভিলিয়ন তৈরি হয়েছিল। বর্মা থেকে আমদানি করা কাঠ দিয়ে। ইডেনের গর্ব ছিল ওটা। কিন্তু ১৯৭৭ সালে সিএবি প্রশাসকরা সেটা ভেঙে গ্যালারি বাড়ানোর দিকে মন দেন। যা এক কথায় লজ্জার। ইডেনের ওই প্যাভিলিয়নে নানা রকম ছবি রাখা ছিল। যে প্যাভিলিয়নকে অনায়াসে মিউজিয়াম করা যেত, যা লর্ডস-মেলবোর্নের ক্রিকেট জাদুঘরের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারত, সেটাকে সাতাত্তরে ধ্বংস করে ফেলল সিএবি।

ফলিং সুইপ শট

১৯৫৮-’৫৯ সালে যেটা ইডেন দেখে। আর সেটা তার পর ক্রিকেটে আর কোনও দিন দেখেনি। ওয়েস্ট ইন্ডিজ এসেছিল খেলতে। টিমে সোর্বাস, হল, গিলক্রিস্ট, রোহন কানহাইরা ছিলেন। কানহাই ইডেনের ওই টেস্টে ২৫৬ করেন। তার মধ্যেই একটা শট ছিল, ফলিং সুইপ শট। মাটিতে শুয়ে উনি সুইপটা মেরেছিলেন। কানহাইয়ের মতো অত ভাল টেকনিক সমৃদ্ধ ব্যাটসম্যান আমি খুব বেশি দেখেছি বলে মনে হয় না।

বিশ্বনাথ দর্শন

ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ইডেনে ১৩৯ করা গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ নয়। আমি একটা দলীপ ট্রফি ম্যাচের বিশ্বনাথের কথা বলছি। মনে আছে, দক্ষিণাঞ্চল বনাম পূর্বাঞ্চলের ওই ম্যাচ খেলা হয়েছিল আন্ডারপ্রিপেয়ার্ড উইকেটে। সুব্রত গুহ-দিলীপ দোশীদের সামনে দক্ষিণাঞ্চলের বড়-বড় ব্যাটসম্যানরা দাঁড়াতে পারেনি। কিন্তু বিশ্বনাথ যে ভাবে ওদের খেলেছিল, তাতে বোঝা গিয়েছিল ভারতীয় ক্রিকেটকে টানার আরও একটা হাত আসছে। খুব বেশি রান করেনি। তিরিশের ঘরে। তার পরের বছরই ও অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে টেস্ট টিমে চান্স পায়। কলকাতায় যখন প্রথম বারের জন্য টেস্ট খেলতে নামে, ভারত তখন ০-২। প্রথম বলটাই স্কোয়্যার ড্রাইভে বাউন্ডারি। কভারে দাঁড়িয়ে থাকা বিখ্যাত ফিল্ডার পল শিহানের বাঁ দিক দিয়ে। পরের বলেও শিহান নড়তে পারেননি, এ বার ডান দিক দিয়ে, আবার বাউন্ডারি। মনে আছে, ওই দু’টো বাউন্ডারি দেখার পর সারা ইডেন একযোগে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিল। আসলে আবহাওয়া একেবারে পেস বোলিংয়ের উপযুক্ত ছিল সেদিন। মেঘলা, পিচে ঘাস, সিম করছে। সেখানে একটা কুড়ি বছরের ছেলে যা খেলেছিল, অভাবনীয়।

যাঁদের পড়বে না আর পায়ের চিহ্ন

কত যে বিখ্যাত সব ক্রিকেটার খেলে গিয়েছেন ইডেন গার্ডেন্সে! রঞ্জি সিংহজি খেলেছেন। রঞ্জি আসলে দু’বার এসেছিলেন ইডেনে খেলতে। ১৮৯৮ সালে পাতিয়ালার হয়ে ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাবের বিরুদ্ধে খেলে গিয়েছেন। আবার ১৯০৪ সালে ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে খেলেছেন। তিরিশের দশকে আবার স্যর জ্যাক হব্স এসেছেন। কমনওয়েলথ টিমের হয়ে ফ্র্যাঙ্ক ওরেল। কিথ মিলারও খেলে গিয়েছেন। ব্ল্যাক ব্র্যাডম্যান যাঁকে বলা হত, সেই জর্জ হেডলি ইডেনে এসেছিলেন ১৯৪৮-’৪৯-এ। তবে খেলেননি। আসল ব্র্যাডম্যানও এক বার পা রেখেছিলেন এই শহরে। ১৯৫৩ সালের কথা। ব্র্যাডম্যান তখন অবসর নিয়ে ফেলেছিলেন। সাংবাদিক হিসেবে অস্ট্রেলিয়া থেকে ইংল্যান্ড যাচ্ছিলেন। মাঝে তাঁর ফ্লাইট হল্ট করে আমাদের দমদম বিমানবন্দরে। ওটাই তাঁর কলকাতায় প্রথম ও শেষ পা রাখা!

১০

ওরেল কাকে বলে

ফ্র্যাঙ্ক ওরেল ক্রিকেটার হিসেবে কেমন ছিলেন, আমার বলার অপেক্ষা রাখে না। আমি বলতে চাই মানুষ ওরেলের কথা। যিনি ১৯৬৭-তে একটা বড় কলঙ্ক থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন ইডেন গার্ডেন্সকে।ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ওই টেস্টে ইডেন উপচে পড়েছিল। ম্যাচের দ্বিতীয় দিন, ১ জানুয়ারি। আসনের চেয়ে দর্শক বেশি। দর্শকদের সঙ্গে পুলিশের ঝামেলা। পুলিশ টিয়ার গ্যাস চার্জ করতে থাকে। এর পর সীতেশ রায় নামে এক জনকে বেধড়ক মারে পুলিশ। দর্শকও খেপে গিয়ে পুলিশকে মারধর করতে শুরু করে দেয়। আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয় গ্যালারিতে। সব দেখেশুনে ওয়েস্ট ইন্ডিজ প্লেয়াররা প্রাণভয়ে গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের দিকে দৌড়তে শুরু করেন। কনরাড হান্ট ছোটেন গ্যালারিতে উঠে জাতীয় পতাকা বাঁচাতে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ঠিক করে ফেলে, তারা আর খেলতে নামবে না। স্যর ফ্র্যাঙ্ক ওরেল তখন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন বক্তৃতা দিতে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ টিমের সঙ্গে থাকা স্থানীয় ম্যানেজার দিলীপ ঘোষ সোজা ওরেলের কাছে চলে যান। অনুরোধ করেন তাঁকে ব্যাপারটা দেখতে। ওরেল ওয়েস্ট ইন্ডিজ টিমের সঙ্গে দেখা করে বলেন, দর্শকরা তোমাদের তাড়া করেনি। বরং তোমাদের খেলা দেখতেই টিকিট কেটে মাঠে এসেছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সম্মানের কথা ভাবো। দর্শকদের আবেগের কথা ভাবো। সোবার্সরা ওরেলের কথা শুনে মাঠে নেমে যান সে দিন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE