Advertisement
E-Paper

বঙ্গজীবনে আসলি ‘পরিবর্তন’ পরের সোমবার থেকে

এক সপ্তাহ পরে বাঙালি আবার রাতে ঘুমাবে। বেডরুমে মুলারের বদলে ফিরবে সানি লিওন। আর সস্তায় কেনা টেরিকটের ব্রাজিল জার্সি দিয়ে রতনের মা ক’দিন পরেই ঘর মুছবেন। লিখছেন সুমন দেবিশ্বকাপের আয়োজকদের ফি-বছর পাড়ার ফাংশনে ‘চিত্রাঙ্গদা’ দেখতে হয় কি না কে তাঁদের বোঝাবে! ‘শেষ যাহা হবেই হবে তারে/ সহজ হতে দাও শেষ/ সুন্দর রেখে যাক স্বপ্নের রেশ’? রেশ কোথায়, বিশ্বকাপের শেষ যেন অটোচালকের অনিচ্ছায় থামা। হেঁচকি তুলে ব্রেক, দুম করে সব শেষ। বত্রিশটা দেশ লড়ে মরল। আর তাদের পানে চেয়ে-চেয়ে বাঙালি ফুটবলের সাড়ে-বত্রিশ ভাজা গিলল পাক্কা একটি মাস ধরে। লাল থেকে সবুজ ঝান্ডা নয়, হুঁ হুঁ বাবা, বিশ্বকাপ শেষ মানে হল বঙ্গজীবনে আসলি ‘পরিবর্তন’। খাঁটি বদল— দশ দফার।

শেষ আপডেট: ০৭ জুলাই ২০১৪ ০০:১৪

বিশ্বকাপের আয়োজকদের ফি-বছর পাড়ার ফাংশনে ‘চিত্রাঙ্গদা’ দেখতে হয় কি না কে তাঁদের বোঝাবে! ‘শেষ যাহা হবেই হবে তারে/ সহজ হতে দাও শেষ/ সুন্দর রেখে যাক স্বপ্নের রেশ’? রেশ কোথায়, বিশ্বকাপের শেষ যেন অটোচালকের অনিচ্ছায় থামা। হেঁচকি তুলে ব্রেক, দুম করে সব শেষ। বত্রিশটা দেশ লড়ে মরল। আর তাদের পানে চেয়ে-চেয়ে বাঙালি ফুটবলের সাড়ে-বত্রিশ ভাজা গিলল পাক্কা একটি মাস ধরে। লাল থেকে সবুজ ঝান্ডা নয়, হুঁ হুঁ বাবা, বিশ্বকাপ শেষ মানে হল বঙ্গজীবনে আসলি ‘পরিবর্তন’। খাঁটি বদল— দশ দফার।

টোলে পণ্ডিতমশাই থেকে গার্হস্থ্যে গৃহিণী, বাঙালির চেনা গঞ্জনা— ‘‘তোমার জীবনে কোনও ‘গোল’ নেই।’’ এর থেকে মুক্তি দিতে রাতের ম্যাচ গোলের পর গোল! বিশ্বকাপ শেষে ফের বঙ্গসন্তানরা ফিরবে গোলহীন জীবনে। আর গোলের নেশায় যে সব ‘মাল’রা (ভাষা সৌজন্যে, তাপস পাল) ওই দ্রব্যটি গলায় ঢালতে ভুলে গিয়ে গোলমাল করেননি এ ক’দিন, তাঁরা ফিরবেন স্বমহিমায়।

বিশ্বকাপ শেষে জয়ী দল কাপ হাতে দেশে ফিরবে। বঙ্গজীবনেও কাপ ছাড়াই বহু কিছু ফিরবে। রাতের ঘুম ফিরবে, প্রতিবেশীর নাসিকাগর্জন ফিরবে, মর্নিংওয়াক ফিরবে। এককথায়, বাঙালি বল ছেড়ে ফের বলবান হওয়ার লক্ষ্যে ঝুঁকবে (অবশ্য দুপুরে বিরিয়ানি

না ছেড়েই)।

সাড়ে ন’টায় সিরিয়াল দেখতে না পেরে বৌ বাপের বাড়ি আর রাতদিনের কাজের মাসির দেশে পাড়ি। বাঙালি এক মাস রূপমপন্থী— ‘এই একলা ঘর আমার দেশ’। এ বার বৌ ফিরল, বাঙালির সপ্তাহান্তের যৌনজীবন ফিরল। রগচটা হবু শ্বশুর জেগে আছে বলে প্রেমিকাকে রাতের এসএমএস বন্ধ ছিল এক মাস। অবশেষে তা-ও ফিরল। তবে গেলও অনেক কিছু। ব্যাচেলর জীবনে রাতে সুয়ারেজ গেল, সেই জায়গায় সানি লিওন ফিরল। আর বিবাহিতদের ফুটবল দেখার বাহানায় সাম্বার লাস্যে চোখ সেঁকার দিন শেষ। এককথায় বাঙালি সাম্বা-সম্মোহন মুক্ত হল।

সবচেয়ে বড় কথা খরচ কমল। নেইমার থেকে নেই ধার। এত দিন বৌকে রাতে এক ফ্লাস্ক চায়ের জন্য ঘুষ— ‘তোমায় রাঁধতে হবে না, অফিস থেকে ফেরার সময় আজ একটু রুটি-মাংস আনি?’ ছেলেকে সকালের ক্রিকেট কোচিং ক্লাসে মায়ের সঙ্গে যাওয়ার বায়না ধরার জন্য ঘুষ নকল ব্রাজুকা, এত খরচ কি আর মাইনের টাকায় হয়! অগত্যা ধার। এ বার অনিবার্য সে ধারের বোঝা নামল।

এক মাসের আন্তর্জাতিক বাঙালি ফের ঘুসুড়ি-নৈহাটি-বনগাঁতে ফিরল। ময়দান মার্কেট থেকে সস্তায় কেনা টেরিকটের ব্রাজিল জার্সি দিয়ে রতনের মা ক’দিন পরেই ঘর মুছবে। আর লোকাল ট্রেনের তর্কে আস্তে-আস্তে ফিরবে ঘরের ছেলেরা। মোহনবাগান আর ইস্টবেঙ্গল।

অবশেষে আমাদের মনে পড়বে যে এই গ্রহে মহেন্দ্র সিংহ ধোনি নামে কেউ আছেন এবং তিনি একটি খেলা, পটলডাঙার প্যালারাম যাকে ‘ঝিঁঝি খেলা’ বলেছিল, সেই ক্রিকেট খেলেন। বিশ্বকাপ শেষে বঙ্গজীবনে শেষ আইপিএল-এ নাইট-শোয়ের স্মৃতি এবং মাল্টিপ্লেক্সের নাইট শো— দু’টো স্বমহিমায় ফিরল বলে!

বাঙালি কথা ছেড়ে এ বার কাজে ফিরবে? ভুল। আসলে কথার কথা থেকে কাজের কথায় ফিরবে। নবান্নে ঘুমে ঢোলা, মাঝেমধ্যে তন্দ্রা ভাঙিয়ে ফুটবল-তর্ক চলছিল। এই বার ডিএ নিয়ে তরজা তীব্র হবে। তবে বাঙালির কর্মসংস্কৃতি শুধু চাকরি নয়, ব্যবসা ঘিরেও। আবার টিভির দোকানদার মাছি তাড়াবে। খেলা দেখে রোগাভোগা বঙ্গসন্তানের অম্বল, আর অম্বল তাড়াতে অ্যান্টাসিড— এ ভিশাস সার্কেল শেষে ওষুধের দোকানের বিক্রি কমবে। পাড়ার মোড়ে সিগারেটের দোকানটা আর রাত তিনটে অবধি খোলা থাকবে না। কাগজে স্কোর ধরাতে হবে না, তাই কাগজওয়ালার ঘন্টি বাজবে সাতসকালেই। পাড়ার বিল্টু-পল্টুরা নেইমার হওয়ার স্বপ্ন ভুলে আবার জগাদার কোচিংয়ে পড়তে যাবে। তবে দিঘা-বকখালিতে ছুটি কাটিয়ে এ বার কাজে ফিরবে নিশিকুটুম্বরা। মাইরি বলছি, ‘রাত জাগা তারা’র দিব্যি, বাঙালির ওয়ার্ক কালচার বাঁচিয়ে রাখবে এই ছিঁচকে চুরিই।

টিভি চ্যানেলের ফুটবল বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘশ্বাস ফেলবেন। আট বছর পাড়ার ক্লাব আর দেড় বছর বড় ক্লাবে খেলার অভিজ্ঞতা নিয়ে গড়ে একশো পঁয়তাল্লিশ ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে থাকা দেশের বাংলার বাঘেদের মেসি-রোনাল্ডিনহোর ভুল ধরতে আবার অপেক্ষা চার-চারটে বছরের!

কলকাতার দেওয়ালে-দেওয়ালে, ক্লাবে-ক্লাবে, ফ্ল্যাগে-ফ্ল্যাগে ব্রাজিল-আর্জেন্তিনার রংমিলান্তি উধাও। গ্রাফিতিতে ফের ‘ভোট দাও’ আর ‘নিপাত যাও’-এর জয়জয়কার। বাড়িতে নীল-সাদা রং করালে পুরসভা করছাড় দেবে বটে, তবে তাতে মেসির ম্যাচের তৃপ্তি মিলবে না।

১০

শেষে নিজেদের কথা। বিশ্বকাপের অক্টোপাস পল আর কৃষ্ণনগরের তাপস পলের যুদ্ধ শেষ। সংবাদমাধ্যম অবশেষে বিশ্বকাপের রাহুমুক্ত হবে। রোজ সকালে হেডলাইনে অনুব্রত বনাম আর্জেন্তিনা, মেসি বনাম মইদুলের মাথা ঠোকাঠুকি শেষ। নিউজরুমে নাইটশিফ্ট করতে আবার কলমচিদের মুখ বেজার হবে। তবে ব্রেকিং নিউজ ফের বুক বাজিয়ে সকার থেকে সারদায় ফিরবে। চাপের কাপ বিশ্বজয়ীদের হাতে। মিডিয়াতে চায়ের কাপ শেষ।

বাপ্ রে বাপ্!

fifaworldcup suman dey
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy