Advertisement
E-Paper

বর-কনে যখন মডেল

বিয়ের ছবিতে নতুন স্বাদ। ছাদনাতলার সাত-সতেরো পেরিয়ে আরও অনেক দূর। লিখছেন সুচন্দ্রা ঘটক।বিয়ের ছবিতে নতুন স্বাদ। ছাদনাতলার সাত-সতেরো পেরিয়ে আরও অনেক দূর। লিখছেন সুচন্দ্রা ঘটক।

শেষ আপডেট: ২০ মার্চ ২০১৪ ১৬:৪৩

মাঝে একটা মাইল স্টোনে লেখা ‘দিল্লি’। দু’দিকে রাকস্যাক নিয়ে দাঁড়িয়ে এক তরুণ ও এক কিশোরী। বিয়েবাড়িতে ঢোকার মুখে বিশাল ফ্রেমে এই ছবি দেখে থমকে যাচ্ছেন বেশির ভাগই। তার পরেই মুখে আলগা একটা হাসি। ওরাই যে অনুষ্ঠানের হিরো-হিরোইন।

বিয়ের ছবি তোলার ধারাটাই যে বদলে দিয়েছেন এখনকার ফোটোগ্রাফাররা। বিয়েবাড়ির ফোটোশু্যট শুরু হয়ে যায় আসল অনুষ্ঠানের দিন কয়েক আগে থেকেই। যেমন হয়েছিল মুম্বইয়ের ওই বিয়েবাড়ির ক্ষেত্রে।

কলকাতায় বিয়ের আগের ছবি বিবাহ আসরে খুব একটা না দেখা গেলেও নতুন বর-বৌয়ের ঘরে কাচের ফোটো ফ্রেমে বিয়ের সাজের ছবি এখন ইতিহাস। ঢুকেছে অভিনব সব রেওয়াজ। কখনও ডিভানের মাঝের ভেলভেটের কুশন-কভারে তাঁদের ছবি। কখনও তাঁদের বারোটা বিশেষ মুহূর্তের ছবি দিয়ে তৈরি ক্যালেন্ডার ঝুলছে বেডরুমে। ওয়েডিং ফোটোগ্রাফির ভোলটাই বদলে দিয়েছেন এখন ফোটোগ্রাফাররা।

বিয়ে মানে তো শুধু মাত্র কতগুলো রীতি-রেওয়াজ নয়, জেন ওয়াইয়ের কাছে আংটি বদল আর বিদাই তো গোটা স্যালাডটার একটা অংশ মাত্র। “তার কত দিন আগে থেকে শুরু হচ্ছে বলুন তো গোটা গল্পটা!” বললেন মুম্বইয়ের চিত্রশিল্পী কণিষ্কা সোনথালিয়া। বিয়ের সময়ে অনেকেই চাইছেন রকমারি মুহূর্ত নিয়ে অ্যালবামটা তৈরি করতে। দিচ্ছেনও ফোটোগ্রাফাররা।

আর এক চিত্রশিল্পী বিনয় অরবিন্দের ছবিতে দেখা যায় করিডরের মাঝে হ্যাঙ্গারে কিছুটা অগোছালো ভাবে ঝোলানো ওয়েডিং গাউন। সেটাও এক জনের বিয়ের অ্যালবামের অংশ।

বৌভাতের দিন তাঁর শাড়ি পরার দৃশ্যও বাদ দেননি ফোটোগ্রাফার। জানালেন, সদ্য বিবাহিতা মুম্বইবাসী বাঙালি বধূ সায়ন্তনী সেনগুপ্ত। এই নিয়ে নাকি রাগারাগি শুরু করে দিয়েছিলেন কলকাতার আত্মীয়েরা। কিন্তু অ্যালবাম দেখে সকলেই হতবাক। বেনারসির আঁচল গোছানোর ছবিই তখন সবচেয়ে হিট।

দেশ জুড়েই এখন এমন নানা মেজাজের ছবিতে বিয়ের অ্যালবাম সাজানো নিয়ে চলছে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। আর ওয়েডিং ফোটোগ্রাফি হয়ে উঠছে ততই চ্যালেঞ্জিং, গ্ল্যামারাস।

পিছিয়ে নেই কলকাতাও। যুগের দাবি মেনে পরীক্ষামূলক ছবিতে গা ভাসিয়েছেন শহরের চিত্রশিল্পীরা।

বদলে যাওয়া চাহিদা

বান্ধবীর বিয়ের দিন এক নামী মেক আপ আর্টিস্টের স্টুডিওয় প্রথম দেখা গিয়েছিল সেই অবাক ঘটনাটা। আগে কনে পার্লারে সাজতে গেলে পাশে থাকতেন মা-কাকিমা-দিদি-বৌদি গোছের কোনও এক মহিলা। সে দিনও অধিকাংশ কনের সঙ্গে তেমন কেউই বসে ছিলেন গয়না আগলে। এক সুন্দরী শুধু আলাদা। তাঁর পাশে এক যুবক। হাতে ক্যামেরা। চিন্তা কাটল কিছু ক্ষণেই। ঘিরে ধরল বিস্ময়। কনের চুল বাঁধা শুরু হতে না হতেই হাতে অস্ত্র নিয়ে অ্যাকশনের জন্য তৈরি যুবক। চলল সাজের প্রতিটি ধাপের ফোটোশু্যট। হঠাৎ চোখে ভেসে উঠল, কোনও এক ফরাসি নভেলের কভারের একটা ছবি। সাদা ফুল দিয়ে কনের চুল বেঁধে দিচ্ছেন মা। তখনও তো ক্যামেরা নিয়ে উল্টো দিকে দাঁড়িছিলেন কেউ। এ বার বাঙালির কন্যাদানেও পশ্চিমী হাওয়া। বহু ফোটোগ্রাফারই জানালেন, কনের সঙ্গে মেক আপ আর্টিস্ট বা বেনারসির দোকানে যাচ্ছেন তাঁরা। ক্লায়েন্টের সঙ্গে বন্ধুত্বও হয়ে যায় সেই সুবাদে। বিয়ের আসরের ছবি তাতে আরও প্রাণোজ্জ্বল হয়।

তোলা হচ্ছে বিয়ের আগের দিন, পরের দিনের বর-কনের কিছু হাল্কা আড্ডার ছবিও। বিয়ের আগেই আবার দু’জনকে নিয়ে ফোটোগ্রাফাররা বেরিয়ে পড়েন শহরের বিশেষ কিছু জায়গার সফরে। ভিক্টোরিয়া থেকে নলবন-রবীন্দ্র সদন-গঙ্গাপাড়, বিভিন্ন জায়গায় রকমারি সাজে-মেজাজে নবদম্পতির ছবিও ঠাঁই পাচ্ছে অ্যালবামে। জানাচ্ছেন কণিষ্কা।

বিয়েকে কেন্দ্র করে যেন একটা গোটা গল্প বলে অ্যলবামটা, এমনই চান এখনকার বর-বৌয়েরা। জানালেন শহরের এক ওয়েডিং ফোটোগ্রাফার অনির্বাণ ব্রহ্ম। মধ্যবিত্ত-রক্ষণশীল বাড়ির ছেলেমেয়েরাও এখন বেরিয়ে পড়ছেন বিয়ের আগের ফোটোশু্যটে।

অতিথির অপেক্ষায় বিবাহ আসরের খালি চেয়ার থেকে শুরু করে বিয়ের আংটি, মুম্বই-দিল্লির বড় বাজেটের বিয়ের ছবিতে সাবজেক্ট এখন সবই। কখনও মেহেন্দিতে সুসজ্জিত কনের পা দুটোই জুড়ে থাকছে গোটা ফ্রেম। গলার হার আর বিয়ের আংটিকে প্রাধান্য দিতে ছবি থেকে বাদ যাচ্ছে কনের মুখটাও। তবে এত দূর এখনও যায় না কলকাতা। জানান চিত্রশিল্পী ঋষিকা দাস। বলেন, “বর-কনের চুম্বন দৃশ্যে এখনও রাজি হন না বাঙালি অভিভাবকেরা।”

ক্যান্ডিড ধারা

রোজের জিনস্-টি শার্টের কনে ভারতীয় সাজে বান্ধবীদের সঙ্গে কী ভাবে মেতে থাকলেন, তার প্রতিটি ক্ষণের রেকর্ড রাখা তাঁর কাছে সিঁদুর দান, মালা বদলের থেকে কোনও অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। হ্যাঁ, এই ধারার ছবির পোশাকি নামই এখন ক্যান্ডিড ফোটোগ্রাফি। পোজ না দিয়ে স্বাভাবিক কোনও মুহূর্তকে ক্যামেরা-বন্দি করার ধারাকেই বলা হয় ‘ক্যান্ডিড’ ছবি। জীবন যেমন চলছে, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে হবে ছবির অ্যালবাম। বিয়ের ছবিগুলো তাই হবে বর-কনে-পরিবার বিশেষে, আলাদা মেজাজের। যেমন হয় কোনও বুটিকে। ইউনিক।

বিশ্ববিখ্যাত চিত্রগ্রাহক অঁরি কার্তিয়ে ব্রেসোঁ এই ধারার ছবিকে গোটা বিশ্বে জনপ্রিয় করে তুলেছেন বলে শোনা যায়। গত দু-তিন বছরে এই মেজাজের ছবি জায়গা করে নিয়েছে ভারতীয় বিয়েতেও। “আগে বিয়েবাড়িতে মজার কোনও মুহূর্তের ছবি তুললে অবাক হতেন ক্লায়েন্টরা। এখন তেমন ছবির চাহিদাই বেশি।” বলেন শহরের আর এক ওয়েডিং ফোটোগ্রাফার আরম্বিক ঘোষ।

কাজে নতুন চ্যালেঞ্জ

পরপর দাঁড়ানো মাসি-পিসিদের ছবি দিয়ে গোটা অ্যালবামটা ভরাতে রাজি নয় জেন ওয়াই। তাই বিয়ের ছবি তোলার কাজ এখন বেশি চ্যালেঞ্জিং। ক্লায়েন্টের রুচি বুঝে ছবি তুলতে হচ্ছে। বলেন আরম্বিক। শহরের আর এক ফোটোগ্রাফার অভিজিৎ ভৌমিক জানান, ট্রেন্ড বদলাতে শুধু ছবির ধারাই নয়, অ্যালবামেও চমক আসছে এখন। সেকেলে ভেলভেট মোড়া ছবির বই থেকে বেরিয়ে চামড়া, সেরামিকের বাইন্ডিং দিয়েও ক্লায়েন্টের নজর কাড়ার দস্তুর রয়েছে।

এই কাজ করতে হলে

সবচেয়ে প্রয়োজন বিশেষ অনুভূতিগুলো ক্যামেরায় তুলে ধরার ইচ্ছে। এমনই বলছেন শহরের সব ক্যান্ডিড ফোটোগ্রাফার। কার কাছে কোন মুহূর্তটা বেশি আনন্দের, তা চিনতে হবে। তার জন্য কোনও অভিজ্ঞ চিত্রগ্রাহকের কাছে শিক্ষানবিশি অথবা কোনও ফোটোগ্রাফি ইনস্টিটিউটে লাইস্টাইল ছবির কোর্স করা যেতে পারে। কলকাতায় এই ধরনের ছবির চাহিদা বাড়ছে। দেশের অন্যান্য মেট্রো শহরে ইতিমধ্যে বহু সংস্থাই ক্যান্ডিড ফোটোগ্রাফার নিয়োগ করছে বিয়ের ছবি তোলার জন্য। আর সেই তরুণ আলোকচিত্রীদের হাতেই রোজ একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে বাঙালি বিয়ের সংজ্ঞাটা!

নয়া প্যাকেজ

• লাইফস্টাইলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ই-অ্যালবামও তৈরি করে দিচ্ছেন কোনও কোনও চিত্রগ্রাহক। লিঙ্ক পাঠালেই ছবি দেখছেন ভিন্ দেশের আত্মীয়-বন্ধুরা

• বিয়ের অ্যালবাম বানাতে পুরনো প্রিন্টের জায়গায় ব্যবহার করা হচ্ছে ডিজিটাল প্রিন্ট

• ছবি দিয়ে বানিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিয়েব বইও

• চামড়ার ব্রিফ কেসে ভরে দেওয়া হচ্ছে তিন-চার খণ্ডের অ্যালবাম

• হ্যান্ডমেড কাগজ থেকে প্লাস্টিক, চামড়া নানা ধরনের জিনিস দিয়ে তৈরি হচ্ছে অ্যালবামের কভার

ছবি: অনির্বাণ ব্রহ্ম
www.theweddingsalad.com

suchandra ghatak
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy