স্মৃতি ইরানি যে দিন প্রথম ৩০ নম্বর পৃথ্বীরাজ রোডে লালকৃষ্ণ আডবাণীর বাড়িতে পা দিয়েছিলেন সেদিনই ওঁকে দেখে আডবাণী বলেছিলেন ‘এই মেয়েটার হবে’।
স্মৃতি ছিলেন আডবাণীর মেয়ে প্রতিভার বান্ধবী। এখনও সেই বন্ধুত্ব অমলিন।
দু’জনেই নানা ভাবে টেলিভিশন সিরিয়াল, রিয়েলিটি শো-সহ নানা অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত। বন্ধুত্বের প্রাথমিক সেতুবন্ধ ছিল ছোট পর্দা। প্রতিভা ব্যস্ত থাকতেন তাঁর প্রডাকশন হাউজ নিয়ে। তৈরি করতেন তথ্যচিত্র নানা বিষয়ে। এখনও তাই করেন। আর স্মৃতি ইরানি তখন ‘কিউকি সাঁস ভি কভি বহু থি’ সিরিয়ালের তুলসী ভিরানি হয়ে জনপ্রিয়তার শীর্ষে। ভিরানি পরিবারে বিয়ে হয়ে বধূ হিসেবে তাঁকে দেখে দর্শকের মনে হয়নি এই মেয়েই একদিন তাঁদের আটপৌরে জীবনের নিত্য সহচরী হয়ে উঠবে। তিলে তিলে তিলোত্তমা হয়েছিল তুলসী। কিন্তু আডবাণী তাঁকে প্রথম দিন দেখেই বুঝেছিলেন এই মেয়ের মধ্যে আগুন লুকিয়ে আছে।
সে দিন রাত্রে খাওয়াদাওয়ার আসরে স্মৃতির প্রাণবন্ততা, সপ্রতিভতা, উচ্ছলতা দেখে সিনেমা সিরিয়াল-প্রেমী আডবাণী বলেছিলেন, “তুমি রাজনীতিতে আসছ না কেন?” ঘটনাটা ২০০২ সালের। শেষমেশ আডবাণীর বাড়িতে প্রতিটা ঘরোয়া অনুষ্ঠান, সে কারও জন্মদিন হোক বা বিবাহবার্ষিকী, সাদর নেমন্তন্ন পেতেন স্মৃতি।
রাজনীতি আর বিনোদন দু’টো দুনিয়া আপাতভাবে আলাদা।
কিন্তু স্মৃতিকে দেখা যায় সব সময়ই এই দু’টি দুনিয়াতেই পা রেখে চলেছেন। সাজগোজ, বেশভূষা, এসব ব্যাপারেও স্মৃতির উৎসাহে কোনও দিন ঘাটতি দেখা যায়নি। সেন্ট্রাল হলে মধ্যাহ্নভোজনটা করতেন অনেক সময়ই হেমামালিনীর সঙ্গে। একদিন তো রসিকতা করে জিজ্ঞেস করেছিলেন এই প্রতিবেদককে“কাকে বেশি সুন্দর লাগছে তোমার?” ঝরঝরে বাংলায় বলা প্রশ্ন। পাশেই বসেছিলেন রাজ্যসভার আর এক সদস্য ডেরেক ও ব্রায়ান। ডেরেক আবার এই দুই সুন্দরী রাজনীতিকের ‘নির্ভরযোগ্য’ বন্ধু সতীর্থ সাংসদ।
স্মৃতির পিছনে লাগার জন্য ডেরেক বললেন, “এত বয়সেও হেমা কিন্তু স্মৃতির থেকে স্লিম।” উত্তরে বলা হল, “হতে পারে এটি মেল শভিনিস্টিক কথা, এখন কিন্তু বিদ্যা বালনের যুগ এসেছে (তখনও পরিণীতি চোপড়ার ‘শুদ্ধ দিশি রোম্যান্স’ বাজার মাত করেনি)। এখন করিনার জিরো সাইজ এরা ইজ ওভার। অতএব স্মৃতি ইরানি।” লাল শাড়ি লাল টিপ পরা স্মৃতি বলেছিলেন, “এ কথাটার পর আমাকে বালুসাই অর্ডার দিতেই হবে সবার জন্য!” কথায় কথায় মজা করা যেমন স্মৃতির অভ্যেস, তেমনই অন্য দিকে তিনি সিরিয়াস। এই দুইয়ের মেলবন্ধনই স্মৃতি ইরানির আকর্ষণ হয়ে উঠল আডবাণীর কাছে।
গোড়ায় আডবাণী এক দিকে মোদী, অরুণ জেটলি, সুষমা স্বরাজ প্রমুখ নেতাদের নিজে হাতে গড়ছেন। পার্টিতে তাঁদের গুরুত্ব বাড়াতে। অন্য দিকে ফিল্ম জগতের বিভিন্ন সেলিব্রিটিদের নিয়ে আসছেন যাতে বিজেপির ব্র্যান্ড ইক্যুইটি আরও বাড়ে। পার্টির একটা চুম্বকটান তৈরি করতে তিনি দলে টেনেছিলেন রামায়ণে যাঁরা রাম, সীতা, লক্ষ্মণের চরিত্রে অভিনয় করতেন তাঁদেরও। এসেছিলেন দারা সিংহ। এমনই এক সময়ে তুলসী-স্মৃতির আবির্ভাব। ঘটনাটা ২০০২ সালের। আর এটা ২০১৪ সাল।
এক যুগের তফাতে ছোট পর্দার জনপ্রিয় নায়িকা থেকে মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী হওয়ার এমন ঘটনা আগে ঘটেনি। যদিও রাজনীতির বৃত্তে সাংসদ স্তরে, রাজ্যসভার সদস্য পদে তারকাদের ছড়াছড়ি।
আসলে তথাকথিত শিক্ষাগত যোগ্যতার চাইতে আত্মবিশ্বাসই যে বড় সেটাই প্রমাণ করে দিলেন স্মৃতি ইরানি।
যদিও মানব সম্পদ উন্নয়নের মন্ত্রী হয়ে শিক্ষা মন্ত্রক হাতে পাওয়ার পর ৩৮ বছরের স্মৃতির শিক্ষা গত যোগ্যতা নিয়ে কটাক্ষ হেনে চলেছেন রোজই অন্য দলের লোকজন।
কিন্তু তাতে কী?
স্মৃতি বলছেন “মানবসম্পদ মন্ত্রক সামলানো মানে তো এই নয় যে নিজেকে পেল্লাই সব ডিগ্রিধারী হতে হবে। উচ্চশিক্ষা থাকতেই হবে। মানবসম্পদ মন্ত্রক চালানো প্রশাসনিক কাজ। সেই প্রশাসন চালাতে দরকার হলে আমি অমর্ত্য সেনর মতো বড় মাপের শিক্ষাবিদ-সমাজবিদ-অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে কথা বলব। যাঁরা আমাকে পরামর্শ দেবেন কী ভাবে শিক্ষার মাধ্যমে মানবসম্পদের উন্নতি করা যায় সে ব্যাপারে। শিক্ষার প্রসারেও।”
মন্ত্রিত্ব পাওয়ার পরই যেন বেরিয়ে এলেন আর এক স্মৃতি। যিনি নিজের ভূমিকা আর কর্তব্য সম্পর্কে ঠিক তেননটাই সচেতন যেমনটা ছিলেন ‘কিউকি সাঁস ভি কভি বহু থি’র ভিরানি পরিবারের বৌ হিসেবে। সেখানে তিনি পারিবারিক কর্তব্য, সংবেদনশীলতা, গৃহিণী, সচিব, সখা স্ত্রীয়ের ভূমিকায় সমান দাপটে অভিনয় করে জেলের কয়েদি সেজেও নজির রেখেছিলেন নারী হিসেবে তাঁর অস্তিত্বের মূল্যায়নে। মানবিকতা আর সততাই ছিল তুলসী চরিত্রের মেরুদণ্ড।
আর এই সততাটুকুই শুধু তুলসী নয়, স্মৃতিরও সব চেয়ে বড় পুঁজি। সাধারণত উপমন্ত্রী, রাষ্ট্রমন্ত্রী, রাজ্যমন্ত্রী, পূর্ণমন্ত্রী এই ভাবেই ওঠে ধাপে ধাপে মন্ত্রী হওয়ার সব সিঁড়ি। কিন্তু স্মৃতি পার্টির কর্মী থেকে সরাসরি মন্ত্রিত্বে অভিষিক্তা। এ বারের নির্বাচনে তিনি রাহুল গাঁধীকে হারাতে পারেননি। তা সত্ত্বেও তিনি মন্ত্রী হয়েছেন। এর পেছনে রয়েছে স্মৃতির লড়াকু মানসিকতা। পার্টি থেকে যে কাজই তাঁকে দেওয়া হয়েছে ছোট বড় না ভেবে করার চেষ্টা করেছেন।
তা নিয়ে রোষও কম নয়। মহিলা নেত্রী মধু কিসওয়ার যিনি ছিলেন একদা বামপন্থী সমাজকর্মী, সমকামীদের কল্যাণার্থে কাজকর্ম করতেন, তিনি হঠাৎ ভোল বদলে গুজরাত দাঙ্গা সংক্রান্ত কোনও অভিযোগ নরেন্দ্র মোদীর প্রতি আরোপ করা যায় না এই মর্মে একটি বই লিখে ফেলেন, যার নাম ‘মোদী অ্যান্ড মুসলিম’। মোদীর সান্নিধ্যে এতটা থেকেও যে কোনও গুরুত্ব পেলেন না তা নিয়েই হয়তো ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন টুইটারে স্মৃতি ইরানির শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে। অন্য দিকে বরুণ গাঁধী বিজেপির হয়ে নির্বাচনে জিতলেও যে কোনও মন্ত্রিপদ পাননি এবং স্মৃতি পেয়েছেন তা নিয়ে নিকট মহলে বিষণ্ণতা প্রকাশ করেছেন। অভিযোগ উঠেছে কংগ্রেসে নেতৃত্ব থেকেও স্মৃতির শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে।
তুলসীচরিত
মিস ইন্ডিয়ার দিনগুলোয়
‘কিঁউ কি...’র সেটে
কিন্তু ন্যূনতম স্কুল শিক্ষা নিয়ে নিজেকে পরিশীলিত করে তুলতে তুলতে স্মৃতি যে ভাবে গড়েছেন নিজেকে আসলে দেখার সেটাই। পার্টির কর্মী থেকে হয়ে উঠেছিলেন প্রথমে মহারাষ্ট্রের যুবনেত্রী। এক সময় বিজেপির যে সব নেতা সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন বলে নরেন্দ্র মোদীর প্রতি ভুরু কুঁচকান তাঁদের দলে ছিলেন স্মৃতিও। “বিজেপির যা ক্ষতি তা তো হয়েছে নরেন্দ্র মোদীর জন্য”, এমন কথাও বলেছেন স্মৃতি কোনও ভানভণিতা না করে। তখন নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে সাঙ্ঘাতিক টানাপড়েনের সম্পর্ক স্মৃতির। অন্য দিক থেকে পার্টি থেকে চাপ এল যে স্মৃতি যদি নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে কিছু বলেন তা হলে পার্টি তার বিরুদ্ধে ‘অ্যাকশন’ নেবে। এ হেন নরেন্দ্র মোদীই একদিন স্মৃতিকে পাঠিয়ে দিলেন গুজরাত থেকে রাজ্যসভার টিকিট দিয়ে। কী করে মিটল ঝগড়া? হদিশ জানেন আজকের কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। তিনিই তো স্মৃতিকে বুঝিয়ে বশে আনেন। বলেন ছেলেমানুষি না করতে। আর আশ্চর্য এই যে স্মৃতির নরেন্দ্র বিরোধিতাকে এক ধরনের ছেলেমানুষিই বা তারুণ্যের যোশ হিসেবেই ধরে নিলেন মোদী।
স্নেহসুলভ প্রশ্রয়েই মোদী এ বার স্মৃতিকে নিয়ে গড়লেন প্রথম মন্ত্রিসভা। কিন্তু কি আশ্চর্য। শপথ নেওয়ার দিন সকাল সকাল সকলেই হাজির গুজরাত ভবনে। সেখানেই জানা যাবে কে কোন মন্ত্রী হবেন। এসেছিলেন অরুণ জেটলি, রাজনাথ সিংহ, সুষমা স্বরাজেরা। স্মৃতি কিন্তু যাননি। সেদিন সকালে তিনি হিমাচল প্রদেশে এক পার্টি মিটিংয়ে ব্যস্ত। স্মৃতি না আসায় একটা চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছিল সেই জমায়েতে। সংশয় দেখা দিল সবার মনে স্মৃতি কি তা হলে এ বার বর্জিত? তিনি পৌঁছলেন দুপুর বারোটায়। জানলেন বটে তিনি মন্ত্রী হতে চলেছেন। কিন্তু কোন দফতর তা জানানো হল না। তিনি সকালে এলেন না কেন? যখন পার্টির সম্ভাব্য মন্ত্রীদের সকলেই হাজির। স্মৃতি বললেন, “মন্ত্রী যে হতেই হবে তার কোনও মানে নেই। কাজ যেমন পাব সেটা করে গেলেই হল।”
স্মৃতি এই রকমই। কোনও ব্যাপারে কোনও দিন অতিরিক্ত কৌতূহল দেখাননি। কিন্তু মাঝে মাঝে ফোঁস করেছেন। যেমন নির্ভয়া ধর্ষণ কাণ্ডের সময় পথে নেমেছিলেন তুমুল প্রতিবাদে। অমেঠিতে প্রিয়াংকার সচিব যখন বুথে ঢুকেছিলেন তখন হইচই বাধিয়েছিলেন এই স্মৃতিই। এই ভাবেই। এই ভাবেই অঘটনঘটনপটীয়সী নারী হিসেবে নরেন্দ্র মোদীর মনে স্নেহের ঠাঁই পেয়েছেন স্মৃতি।
অমেঠির জনসভায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে অন্তত তিনবার আমার ছোট বোন বলে সম্বোধন করেছেন। শপথ গ্রহণের দিন সর্বজনসমক্ষে স্মৃতি প্রণাম করলেন আডবাণীকে। বেশ খানিকটা গল্প করলেন প্রতিভার সঙ্গে। যেমনটা আগে করতেন তেমন ভাবেই।
আবার চা চক্রে অন্য দৃশ্য। সেখানে স্মৃতির সঙ্গে আলাপে ব্যস্ত হলেন মুকেশ অম্বানীর মতো শিল্পপতি থেকে বাবা রামদেবের মতো ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব। এ থেকে একটা ব্যাপার স্পষ্টই বোঝা যায় স্মৃতির জনসংযোগ খুব ছড়ানো। সমাজের সর্বস্তরে রয়েছে তাঁর শেকড়। ঠিক যে ভাবে তুলসীর ইমেজ ভাবাপ্লুত করেছিল নানা শ্রেণির দর্শককে। অনেকেই বলছেন স্মৃতিকে সামনে রেখে আসল পরিচালন ভার থাকবে মোদীর হাতে। এই অধিকারহীন নেতৃত্ব আর কত দিন মানবেন স্মৃতি?
আডবাণী বলেছিলেন, ‘এই মেয়েটার হবে’।
এই মেয়েটার কতটা হবে? উত্তর দেবে সময়। অনেকে আশাবাদী। আর অনেকেরই মুখে তেমনই বাঁকা হাসি। স্মৃতির সাফল্যের রহস্য লুকিয়ে আছে তুলসী চরিত্রেই যেন।
কিউকি স্মৃতি ভি কভি তুলসী থি!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy