Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

স্মোকিং-জয়ী

যুদ্ধটা কঠিন। কিন্তু অমিতাভ-প্রসেনজিত্‌-ব্র্যাড পিট তো পেরেছেন। তা হলে এই ১৪২১-এ আপনি আর শাহরুখ কেন সাদাকাঠির প্রেমে পড়ে থাকবেন? লিখছেন ইন্দ্রনীল রায়।আমেরিকা থেকে হোয়াটস্‌অ্যাপে কথা হচ্ছিল পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। প্রচুর ঘুরছেন, খাচ্ছেন, ফেসবুকে হাজার হাজার ছবি আপলোড করছেন। ফুসফুসে ইনফেকশনের পর এ যেন এক অন্য সৃজিতকে দেখছি আমরা।

শেষ আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০১৪ ০০:০২
Share: Save:

আমেরিকা থেকে হোয়াটস্‌অ্যাপে কথা হচ্ছিল পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। প্রচুর ঘুরছেন, খাচ্ছেন, ফেসবুকে হাজার হাজার ছবি আপলোড করছেন। ফুসফুসে ইনফেকশনের পর এ যেন এক অন্য সৃজিতকে দেখছি আমরা।

আগের মতো সিরিয়াস ভাব নেই। অনেক স্বতঃস্ফূর্ত। আড্ডা মারতে মারতে সাংবাদিকসুলভ কৌতূহল থেকেই এই বদলে যাওয়া, ‘সৃজিত কি পিছে রাজ ক্যয়া হ্যয়’ জানতে চাইলে ‘অটোগ্রাফ’য়ের পরিচালক লিখলেন, “এটার বড় কারণ সিগারেট ছেড়ে দেওয়া। আই ফিল ফ্রি। কোনও বন্ডেজ নেই। এটা একটা অদ্ভুত সাইকোলজিকাল সিচুয়েশন। শরীরটা তো ভাল লাগেই কিন্তু মনটা আরও বেশি।”

সৃজিতের সিগারেট ছেড়ে দেওয়াতে যদি ফুসফুসে ইনফেকশনের হাত থাকে, তা হলে সম্পূর্ণ অন্য কারণে সিগারেট ছেড়ে দিয়েছিলেন নবনীতা দেবসেন।

“আমি তখন যাদবপুরে পড়াই। ওখানে ভবানী বলে একজন ছিল যে চা-সিগারেট এনে দিত। সেই সময় তো মেয়েরা এত সিগারেট খেত না। আমার কয়েকজন বন্ধু ছিল ওদের সঙ্গে আমি দরজা বন্ধ করে সিগারেট খেতাম। একদিন ভবানীকে বললাম, আমার জন্য একটু সিগারেট নিয়ে আসবে? ভবানী সটান বলল, ‘আমি পারব না, যে জিনিস নিজে দোকান থেকে কিনতে পারেন না, সেই জিনিস খান কেন ?’ ব্যস, ভবানীর এক কথায় আমি সিগারেট ছেড়ে দিলাম,” হাসতে হাসতে বলেন নবনীতা দেবসেন।

অন্য দিকে একদিন সকালে উঠে প্রসেনজিত্‌ চট্টোপাধ্যায় নিজেই ঠিক করেন আর সিগারেট খাবেন না। এক সময় দিনে ১০০টা সিগারেট খেতেন তিনি। কিন্তু ডাক্তারের পরামর্শে সেই যে সিগারেট ছাড়লেন, তার পর থেকে আর ধরেননি তিনি।

“আমি কিন্তু তার পর ‘২২শে শ্রাবণ’য়ে এমন একটা চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম যে চেন স্মোকার, কিন্তু সেই রোল করার সময়ও আমার আর ইচ্ছে হয়নি সিগারেট খেতে,” সে দিন আড্ডা মারতে মারতে বলছিলেন প্রসেনজিত্‌।

নবনীতা, প্রসেনজিত্‌, সৃজিত এঁরা কিন্তু আজকে আর সংখ্যালঘু নন। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের মানুষ আজকে সিগারেট ছাড়তে উঠেপড়ে লেগেছেন।

নেশা ছাড়তে কেউ নিকোটিন প্যাচ ব্যবহার করছেন। কেউ নিকোটিন গাম খাচ্ছেন, কেউ ইলেকট্রনিক সিগারেট ব্যবহার করছেন। আর সিগারেট ছাড়ার এই বিরাট ইচ্ছে কিন্তু শুধু কলকাতাতে সীমাবদ্ধ নয়।

অমিতাভ বচ্চন তো কবেই ছেড়ে দিয়েছেন। এই মুহূর্তে মুম্বইতে হৃত্বিক রোশন পাঁচ বার চেষ্টা করে অবশেষে ছাড়তে পেরেছেন সিগারেট। কী করে করলেন হৃত্বিক? তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মতে অ্যালেন কার-এর লেখা বই ‘ইজি ওয়ে টু কুইট স্মোকিং’য়ের জন্য নাকি এটা হয়েছে।

অন্য দিকে ক্যানসার আক্রান্ত বাচ্চাদের সঙ্গে হাসপাতালে দেখা করতে গিয়ে মানসিক ভাবে প্রচণ্ড ধাক্কা খান বিবেক ওবেরয়। ব্যস, সে দিন হাসপাতাল থেকে বেরনোর পর থেকে আর সিগারেট ছুঁয়ে দেখেননি সুরেশ ওবেরয়ের ছেলে। আমির খান অবশ্য ছেড়ে দিয়েছেন ছেলে জুনেইদ ও দ্বিতীয় স্ত্রী কিরণ রাওয়ের অনুরোধে।

যাঁর যে কারণই হোক না কেন, সিগারেট যাঁরা ছাড়তে পেরেছেন তাঁদের দলে এক্ষুনি নাম লেখাতে চান আমাদের আশেপাশের অনেক স্মোকার।

যেমন রণবীর কপূর, অজয় দেবগন বা শাহরুখ খান। কলকাতাতেও রয়েছেন কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় বা কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়।

“সিগারেট খাওয়া শুরু করেছিলাম কিন্তু স্টাইল মারার জন্য। আজকে আমি ছেড়ে দিতে পারলে বাঁচি,” সোমবার বিকেলে বলছিলেন শাশ্বত।

ঋতুপর্ণ ঘোষ মারা যাওয়ার দিন থেকেই সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়। কিন্তু তিন মাস পর আবার যে কে সেই।

“রোজ চাইছি সিগারেট ছাড়তে। কিন্তু পারছি না। আসল কথা হল, আউটডোর যাওয়ার সময় যে মুহূর্তে শিয়ালদহ থেকে দার্জিলিং মেল-টা ছাড়ে, মনটা কী রকম হয়ে যায়। তার পর বাথরুমের কাছে দাঁড়িয়ে যখন নো স্মোকিংয়ের বোর্ডটা দেখি, ট্রেনের দুলুনির সঙ্গে সিগারেট খাওয়ার ইচ্ছেটা আরও বেড়ে যায়,,” নিজস্ব ভঙ্গিতে বলেন কৌশিক।

ডাক্তার হয়েও পরিচালক কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় হার্ট অ্যাটাকের পরেও সিগারেট ছাড়তে পারেননি। “সব চেষ্টা করেছি । নিকোটিন প্যাচ, নিকোটিন গাম, ই-সিগারেট কিন্তু কাজ করেনি। সিগারেটটা একটা সাইকোলজিকাল ডিপেন্ডেন্স। আর ছাড়ার জন্য একটা সলিড মোটিভেশন লাগে। আমি সেই মোটিভেশন জোগাড় করতে পারিনি তার কারণ আমি পাপী মানুষ,” ‘মহাভারত’য়ের স্ক্রিপ্ট লেখার ফাঁকে হাসতে হাসতে বলেন কমলেশ্বর।

তা হলে কমলেশ্বর, কৌশিক-দের মতো যাঁরা স্মোকার, তাঁরা সিগারেটটা ছাড়বেন কী করে?

এর সহজ উপায় বাতলাচ্ছেন অরুণ লাল। এক সময় এই প্রাক্তন ক্রিকেটার দিনে ২৫ থেকে ৩০টা সিগারেট খেতেন। তার পর একদিন সকালে উঠে ঠিক করেন আর খাবেন না।

“ছাড়ার পিছনে সাঙ্ঘাতিক ফোকাস থাকা জরুরি। এমন ফোকাস যে নিজেকে বারবার বলতে হবে, ভগবান এসে সিগারেট দিলেও আমি খাব না। এটা যদি হয় প্রথম ধাপ, তা হলে দ্বিতীয় ধাপ রিয়ালিস্টিক টার্গেট সেট করা। ‘আমি সারাজীবন খাব না’-র থেকে ‘আমি আর ছ’মাস খাব না’-র টার্গেট অনেক রিয়ালিস্টিক। এই দু’টো জিনিস রপ্ত করতে পারলেও ছাড়াটা সহজ হতে পারে,” বলেন অরুণ।

অন্য দিকে সিগারেট ছাড়ার পর ওজন বেড়ে যাওয়া যে সমস্যা হতে পারে, এ কথাও স্বীকার করছেন অরুণ লালও। “সিগারেট ছাড়ার পর একটা আর্টিফিশিয়াল হাঙ্গার হয়। খিদে পেলেই অর্ধেক কলা বা অর্ধেক পেয়ারা খেয়ে জল খাওয়া উচিত। তার পর পাঁচ মিনিট ওয়েট করুন, দেখবেন খিদের ইচ্ছেটাই চলে যাচ্ছে,” বলেন অরুণ লাল।

সিগারেট ছাড়তে না পেরে লো টার-লো নিকোটিন সিগারেট বহু দিন ধরেই খাচ্ছেন অভিনেতা রজতাভ দত্ত। রজতাভ দত্তের এই সিগারেটের দিকে এখন টলিউডের অনেকেই ঝুঁকেছেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় ও শ্রীলেখা মিত্র।

অন্য দিকে হলিউডেও চলছে নো স্মোকিং ক্যাম্পেন। গুয়েনেথ প্যালথ্রো থেকে উমা থুরম্যান, ব্র্যাড পিট থেকে চার্লিজ থেরন সবাই নিজের নিজের পদ্ধতিতে সিগারেট ছেড়ে দিয়েছেন। উমা থুরম্যান নিকোটিন গামের দ্বারস্থ হয়ে সিগারেট ছেড়েছেন, ব্র্যাড পিট ছেড়েছেন নিকোটিন প্যাচের দৌলতে।

তবে বিশ্ব জুড়ে স্মোকিং-জয়ী হওয়ার এই বৃহত্‌ প্রচেষ্টার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে শেষ কথাটা বলছেন কমলেশ্বরই।

“আমি একটা জিনিস বুঝেছি, সিগারেট ছাড়তে হলে মার্ক টোয়েনকে ভুলে যেতে হবে। সেই যে উনি লিখেছিলেন না, ‘সিগারেট ছাড়া কত সোজা.. আমি নিজে তো বহু বার ছেড়েছি’, ওই একটা কোট শুনলেই আর যা-ই হোক স্মোকিং-জয়ী হওয়া যাবে না,” শেষমেশ সিগারেটে টান মারতে মারতেই বলেন কমলেশ্বর।

ছাড়তে তো চাই...কিন্তু কী করে

টেনশন হলে ওষুধ খান, সিগারেট নয়

মোটিভেশন: সিগারেট ছাড়ার সব চেয়ে বড় হাতিয়ার মোটিভেশন। এখানে নো এক্সকিউজ।

টেনশন হলে ওষুধ খান, সিগারেট নয়: অনেকে আছেন, যাঁরা টেনশন হলে কী স্ট্রেস বাড়লে সিগারেট খান। এটা তাঁদের অনেক দিনের অভ্যেস। সিগারেট ছেড়ে দিলে যে তাঁদের টেনশনের মুহূর্ত আসবে না, তা তো নয়। তখন তাঁকে সিগারেট না খেতে দিলে তো আরও ইরিটেশন বাড়বে। আমার মতে এখানে প্র্যাকটিকাল অ্যাপ্রোচ নেওয়া উচিত। স্ট্রেস রিলিভার অনেক ওষুধ পাওয়া যায়। যাঁরা সিগারেট ছেড়ে দিয়েছেন তাঁরা স্ট্রেসের মুহূর্তে এই ওষুধ খেতে পারেন।

স্মোকার বন্ধুদের অ্যাভয়েড করুন: অনেক সময় বন্ধুরা সঙ্গে থাকলে সিগারেট খাওয়া বেড়ে যায়। আমার অ্যাডভাইস হল, স্মোকিং ছাড়ার সময় সেই বন্ধুদের অ্যাভয়েড করাই ভাল।

এমন জায়গা অ্যাভয়েড করুন, যেখানে আগে সিগারেট খেতেন: অনেক জায়গার সঙ্গে আমাদের স্মোকিংয়ের নানা ভাল-মন্দ মেমরি থাকে। সেটা কোনও হোটেল হতে পারে, কোনও এয়ারপোর্টের স্মোকিং লাউঞ্জও হতে পারে। সিগারেট ছাড়ার সময় এই জায়গাগুলোকে যতটা পারা যায় অ্যাভয়েড করাই ভাল।

(পরামর্শ: মনোচিকিত্‌সক রিমা মুখোপাধ্যায়)

পরিবারের সাহায্য মাস্ট

আমি প্রথমে দেখি যে সিগারেট ছাড়তে চাইছে, সে কতটা মন থেকে চাইছে। যদি দেখি প্রসেনজিতের মতো কেউ সত্যিই আগ্রহী, তবে আমার কাজটা অনেক সহজ হয়ে যায়। আজকাল বাজারে অনেক অ্যান্টি স্মোকিং জিনিস বেরিয়েছে, যেমন স্মোকিং গাম, স্মোকিং প্যাচ। কিন্তু আমি আমার এক্সপেরিয়েন্স থেকে বুঝেছি এগুলোর সাকসেস রেট খারাপ। এর মধ্যে একটা নতুন ওষুধও বেরিয়েছে, যার কেমিক্যাল নাম ভ্যারেনাইকলিন। কিন্তু সত্যি বলতে সেটার সাকসেস রেটও ভাল নয়। এখানে আর একটা কথা বলি, সিগারেট ছাড়তে হলে কিন্তু পরিবারের সাহায্যটা খুব দরকার। অনেক সময় সিগারেট ছাড়ার পর লোকে বিরক্ত হয়ে যায়। এ সময় পরিবারের সাপোর্টটা সব চেয়ে বেশি দরকার পড়ে।

(পরামর্শ: ডা. রাজীব শীল)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

smoking indraneel roy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE