ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী
পড়ন্ত বিকেলে পাড়ার ছেলেরা ফুটবল খেলে ফিরছে, রাস্তার আলো দু-একটা জ্বলে ওঠার চেষ্টায় দপদপ করছে, শাঁখ বাজছে প্রায় সব বাড়িতে আর হারমোনিয়মে উছলে পড়ছে আশাবরি বা বিলাবল রাগ। ফুটবল আর হারমোনিয়ম খুবই কেতার সঙ্গে বয়ে নিয়ে চলেছে বাঙালির ঐতিহ্য। আশাবরি বা বিলাবল দুটোর কোনওটাই হয়তো সান্ধ্য রাগ নয়। কিন্তু তাতে কী? সুরেলা হয়ে উঠতে হলে তো রাগ সাধনা করতেই হবে। সঙ্গে থাকবে রবীন্দ্রসংগীত কিংবা নজরুলগীতি শেখার ক্লাসও, কিন্তু ক্লাসিকালই আসল। শনি আর রবিবার পাড়ার গানের ইস্কুল দুই-বিনুনিদের কলকলানিতে মুখরিত হয়ে উঠবে। কখনও কখনও বিকেলের দিকে কোনও না কোনও বাড়িতে রিকশা চড়ে আসবে হারমোনিয়ম বা তবলা। পঁচিশে বৈশাখ আর বাইশে শ্রাবণ কিংবা পাড়ার বিচিত্রানুষ্ঠানে কদর পাবে পাড়ার বেস্ট হারমোনিয়ম, যার কিনা ‘অরিজিনাল জার্মান রিড’। সঙ্গে বহু রিহার্সাল দেওয়া উদ্বোধনী সংগীত। নির্ধারিত তবলা-বাজিয়ের অনুপস্থিতিতে পাড়ার কেল্টুদা মাত করে দেবে আসর। কলার- তোলা বাহবা পাবে, কারণ কেল্টু তো শুধু বাইরে থেকে রির্হাসাল শুনেছিল, তাতেই বাজিমাত! ‘আসলে কেল্টুর সুরের একটা সেন্স আছে না!’ গাঙ্গুলিজ্যাঠার পিঠ চাপড়ানো আর কেল্টুর ছাতি পুরো ৩৪।
এই দিনগুলো হয়তো চলে গিয়েছে, কিন্তু বাঙালির এই নন্দনবোধ, এই রুচি রক্তে বয়ে চলে। এত সমৃদ্ধ ইতিহাস খুব কম ভাষাভাষী লোকজনের মধ্যে পাওয়া যায়। আর তাই, ডিএনএ-গত সংস্কৃতিমনস্কতার জন্যই হয়তো বাঙালিরা এত সুরেলা আর গানপাগল হয়। আপনি কোনও বাঙালিকে দেখেছেন, যে প্রায় প্রতিটি রবীন্দ্রসংগীতের প্রথম দু-লাইন গাইতে পারে না? কোনও আড্ডার আসরে বা পিকনিকে দশ জনে ন’জন কিন্তু দু-কলি সন্ধ্যা-মান্না-হেমন্ত-লতা অনায়াসে গেয়ে দেবে। বাঙালির মস্তিষ্ক এমন ভাবে প্রোগ্রাম্ড, মনে হয় গান শিখতে হবে বা গান জানতে হবে নয়— ব্যাপারটা হল, জন্মালেই গান গাইতে হয়, গান জানতে হয়। বিবর্তনের ফলে মানুষের যেমন লেজ খসে গেছে, দু’পায়ে হাঁটতে পেরেছে, ঠিক তেমন ভাবে বাঙালির মধ্যে সুর ঢুকে গেছে। কত মহান বাথরুম-সিংগার গান না শিখে অবিকল হেমন্ত বা সোনু নিগমের মতো গাইতে পারে বলুন তো? আপনিও চেনেন তাদের, আমিও চিনি।
বাঙালি সুরেলা না হলে অমন শীতের রাতে ডোভার লেন মিউজিক কনফারেন্স কিংবা শতরঞ্চির ওপর বসে, বঙ্গসংস্কৃতি সম্মেলনে বছরের পর বছর বসে থেকে, চুল পাকিয়ে ফেলল? সুরের মিড় ধরে ফেলল? আমি অনেককে জানি যাঁরা কোনও দিন ক্লাসিকাল গান বা বাজনা শেখেননি। কিন্তু দূর থেকে ভেসে আসা কোনও রাগ বাজলে ‘মালকোষ না?’ কিংবা ‘গজল, আখতারি বাঈ’ চিনে নিতে ভুল হবে না। রবিশঙ্কর কোন রাগটা ভাল বাজান কিংবা বিলায়েত খানের হাতে কোন ঝালাটা ভাল খেলে, এ-সব বাঙালি মন দিয়ে আয়ত্ত করেছে। আত্মা সুরেলা না হলে কি এ ভাবে সংগীতকে আপন করা যায়?
আসলে বাঙালি মনে করে, সুরের ওপর তার জন্মগত অধিকার। গান আর গানের তথ্য তার চেয়ে বেশি কেউ জানতেই পারে না। ‘অমুক গানটা অনুপম ঘটকের সুর।’ ‘কখনও না, ওটা নচিকেতা ঘোষ।’ ‘নেভার।’ ‘ওকে, চল তা হলে, বাজি?’ ‘হ্যাঁ বাজি।’ ‘কী বাজি বল?’ ‘সাবিরের রেজালা।’ ‘ওকে, ডান।’ আগেকার দিনে তো এমনও দেখেছি, বাজিতে কে জিতবে, ডিসাইড করতে বন্ধুদের জটলা চলে গেল তক্ষুনি রেকর্ড বা ক্যাসেট কিনতে। এমন বাঙালি বাড়ি নেই যেখানে এই ঝগড়াটা হয়নি। শুধু কি বাজি? কত সম্পর্ক ভেঙে গেল কিংবা কত সম্পর্ক গড়ে উঠল কেবল গানে ভর করে। আমার এক বান্ধবী তো প্রেমের প্রস্তাব নাকচ করল স্রেফ ওই ছেলেটা গান গাইতে পারে না বলে। বলল, ‘যে গাইতে পারে না, সে আবার রোম্যান্টিক হয় না কি?’ সে আর আমরা বসন্ত কেবিনে রাত দশটা অবধি চুপ করে বসেছিলাম। কেউ টেবিল বাজাইনি, গান গাইনি।
কলকাতায় আমার বাড়িতে একটা গানের স্কুল ছিল। আমার তো মনে পড়ে না কেউ বিলো অ্যাভারেজ সুরে গান গাইত। আজও যখন কোনও রিয়েলিটি শো’তে জাজমেন্ট-এ বসি, মোটামুটি গড় হিসেবে দেখা যায় কলকাতা অডিশনটার স্ট্যান্ডার্ড সব সময় একটু উঁচুর দিকেই থাকে। ইন্ডাস্ট্রিতেও একই চেহারা। আমার কাছে নতুন যারা আসে, দেখেছি, পূর্ব ভারতের ছেলেমেয়েদের মধ্যে অন্যদের থেকে মিউজিকাল ওরিয়েন্টেশন অনেক বেশি। মাঝে মাঝে ভাবি, বাঙালি বাড়িতে জন্মেছিলাম বলেই হয়তো এত গানপাগলা হলাম, না কি ঈশ্বর আমাকে দিয়ে গানবাজনা করাবেন বলেই বাঙালি বাড়িতে জন্ম দিলেন
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy