Advertisement
E-Paper

হায় স্বর্ণযুগ

সে ছিল একদিন আমাদের যৌবনে কলকাতা’— কী কুক্ষণে এই অসামান্য লাইনখানা লিখেছিলেন শঙ্খবাবু। এ টু জেড পঞ্চাশোর্ধ্ব বাঙালির মনের অন্তরতম বাক্যি এই লাইনে এফোঁড়-ওফোঁড় গাঁথা হয়ে গিয়েছে। শুধু কলকাতার জায়গায় ইচ্ছেমত শব্দ বসালেই মনের ভাব ঠিক ঠিক প্রকাশ হয়ে যাচ্ছে। ফুটবল থেকে ইলিশ, মূল্যবোধ থেকে পুরীর বিচ— কিছু একটা বসিয়ে নিলেই হল। ছন্দে মিলবে না, কিন্তু বক্তব্য পারফেক্ট। একমাত্র প্রথম বিয়েটা ছাড়া, বাঙালির সব কিছুই অতীতে ভাল ছিল। এখন আর ঠিক জমছে না।

শ্রীজাত

শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:৪১
ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

সে ছিল একদিন আমাদের যৌবনে কলকাতা’— কী কুক্ষণে এই অসামান্য লাইনখানা লিখেছিলেন শঙ্খবাবু। এ টু জেড পঞ্চাশোর্ধ্ব বাঙালির মনের অন্তরতম বাক্যি এই লাইনে এফোঁড়-ওফোঁড় গাঁথা হয়ে গিয়েছে। শুধু কলকাতার জায়গায় ইচ্ছেমত শব্দ বসালেই মনের ভাব ঠিক ঠিক প্রকাশ হয়ে যাচ্ছে। ফুটবল থেকে ইলিশ, মূল্যবোধ থেকে পুরীর বিচ— কিছু একটা বসিয়ে নিলেই হল। ছন্দে মিলবে না, কিন্তু বক্তব্য পারফেক্ট। একমাত্র প্রথম বিয়েটা ছাড়া, বাঙালির সব কিছুই অতীতে ভাল ছিল। এখন আর ঠিক জমছে না। এমনকী প্রেমও, সেই যে সেই প্রথমটি, আহা, তেমনটি আর হল না। তার পর যত জন এল গেল, ঠিক ওই ব্যাপারটা আর যেন ফিরে পাওয়া গেল না। বিয়ের অবশ্য গুণগত রকমফের হয় বলে শুনিনি, কিন্তু অনিবার্য কারণে এগজিস্টিং বিয়েকেই সেরার শিরোপা দিতে বাধ্য বাঙালি। পৃথিবীর বাকি সঅব কিছু স্বর্ণযুগ সিনড্রোমের আওতায়।

‘আহা, ঘনশ্যাম চক্কোত্তির মতো শ্যামাসঙ্গীত, কে গাইবে বলতে পারো আজ?’ অথবা ‘উফ, ’৬৩-র মলিনা ট্রফির সেমিফাইনালে হরিৎ পোদ্দারের সেই লং পাস। এখন ভাবা যায়?’ যে কোনও পাড়ার যে কোনও প্রৌঢ় আড্ডায় এ-জাতীয় বাক্যের কোনও অভাব নেই এই বঙ্গে। সঙ্গে একগুচ্ছ সুদূরগামী দৃষ্টি, যা ব্যাক করে আসার পরেই মুখে একরাশ বিরক্তি, যার একমাত্র কারণ আজকের বাংলা ও বাঙালির চূড়ান্ত অপদার্থতা। হতভাগ্য পরের প্রজন্মের লোক-হাসানো পারফরম্যান্স, যারা আসলে কিস্যু পারে না। আর তারা না-পারার ফলেই টোটাল সমাজ-সংস্কৃতি ব্যাপারটা অধঃপতনের পথে দ্রুত গতিতে ধাবমান। মজা হচ্ছে, প্রত্যেক প্রজন্মের প্রৌঢ়রাই বিকেলের দিকে বাঙালির গৌরবের শেষ দিগন্তটা দেখতে পান, যেটা আজও পেরনো হয়নি।

সন্ধ্যা মুখুজ্জের মতো দরদ, স্যর আশুতোষের মতো মরদ, আলি আকবরের মতো সরোদ, আর বিয়ের পাঞ্জাবির মতো গরদ— কোনওটাই আজ আর নেই। যে-জাতির কবির হাত থেকে গীতবিতান বেরিয়েছে, সেই জাতির উচ্ছন্নে যাওয়া ছোঁড়াছুঁড়িরাই গিটার হাতে চুল ঝাঁকাচ্ছে। যে-জাতির নেতার মাথা থেকে আজাদ হিন্দ ফৌজ বেরিয়েছে, সেই জাতির নেতারা এখন ব্যক্তিগত বাইট-কাদায় মাখোমাখো। যে-জাতির পরিচালক সিনেমাকে নিজের থেকেও উঁচু হাইটে নিয়ে গিয়েছেন, সেই জাতির প্রায় সকলেই এখন ডিরেক্টর। অতএব, বাঙালিকে বাঁচাতে পারে, এমন দম অন্য গ্রহের প্রাণীদেরও নেই। এই সিদ্ধান্তে বহু আগেই উপনীত হয়েছেন আজকের পঞ্চাশপার বাঙালিরা, কেবল রকে, চা-দোকানে, বিয়েবাড়িতে বা পার্টিতে দেখা হয়ে গেলে সেই সিদ্ধান্তটাই আর এক বার ঝালিয়ে নেওয়া। তার পর চির-আক্ষেপের ভঙ্গিতে দু’দিকে মাথা নেড়ে দীর্ঘতম শ্বাসটি ফেলে সলিলোকি— ‘উফ! এ-ও দেখতে হল!’ নাহ্, মোটেই একতরফা নয় এই লেখা। হাফ সেঞ্চুরি পেরিয়ে যাওয়া সকলেই অতীতমুখো হয়ে বসে রয়েছেন, এমন একপেশে ভাবনা পুষে রাখার মতো বোকামিও ঠিক নয়। কাজের সূত্রে বহু বয়স্ক মানুষের সঙ্গেই আলাপ হয়, যাঁরা বাঙালির তথাকথিত স্বর্ণযুগ পেরিয়ে এসেও এই সময়ের সব রকম চেষ্টাগুলোকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন, প্রশংসা করছেন মন থেকেই। রক ব্যান্ডের গান যে-কথা বলছে, ফেসবুক যে-কবিতা বিলি করছে, কলেজ-পাস মেয়েটি যে-সিনেমা বানাচ্ছে— সে-সবই তাঁরা আগের মতো উৎসুক মন নিয়েই বোঝার চেষ্টা করছেন। ‘কিস্যু পারে না’ বলে দেখার আগেই উড়িয়ে দিচ্ছেন না। কিন্তু একটা কথা বোধ হয় ঠিক, তাঁরা সংখ্যায় বেশ কম। স্বর্ণযুগ সিনড্রোমটা বাঙালি ইনহেরিট করে, সুতরাং অধিকাংশ লোকজন জন্মগত ভাবেই পরের দিকে হতাশ হয়ে যাওয়ার জন্যে প্রোগ্রাম্ড। জানতে ইচ্ছে করে, লালনের গানে মেতে ওঠা মানুষজন রবীন্দ্রসংগীতে কী ভাবে রিঅ্যাক্ট করেছিলেন? ‘কিস্যু পারে না’ বলেছিলেন কি? কিংবা বঙ্কিমের উপন্যাসে বেড়ে ওঠা পাঠকেরা বিভূতিভূষণের এন্ট্রিতে তওবা তওবা করেছিলেন কি না ভাবি। কেননা তখন এই ‘সে ছিল একদিন আমাদের’ ব্যাপারটা শুরু হয়নি, এটা মানতে মন চায় না। বরং পুরনোকে অন্ধ স্যালুট জানানোটা বাঙালির এতখানি মজ্জাগত যে ‘সোনার কেল্লা’ ছবিতে মুকুলের আগের জন্মটাই বেটার ছিল বলে দাবি করেন অনেকে। আর গৌরবোজ্জ্বল অতীত যে কেবল বাঙালি ক্রেডিটপূর্ণ হতে হবে তা নয়। বরং উজ্জ্বলতার আওতায় তামাম বিশ্বকে ইনক্লুড করেও ইদানীংকার বাঙালির ছোটত্ব প্রমাণে এক অদ্ভুত সুখ রয়েছে। তাই বিষয়ভিত্তিক তালিকা অনেক সময়ে এই রকমও হতে পারে: সেরা সৎ মানুষ— নিজের ঠাকুরদা এবং গৌতম বুদ্ধ, সেরা সুন্দরী— নিজের পুরনো প্রেমিকা এবং ক্লিওপ্যাট্রা, সেরা সিনেমা— পথের পাঁচালী এবং যিশু ছবি বানালে যা হতে পারত, সেরা প্রতিমা— বাগবাজার সর্বজনীন এবং ডেভিড, এমনকী সেরা সারমেয়— অরণ্যদেবের সঙ্গী বাঘা এবং যুধিষ্ঠিরের পেছনে যমরাজ। এর নীচে বাঙালি নামবেই না। কনটেম্পোরারিও হবে, সেরাও হবে... এর চাইতে সোনার পাথরবাটি বললেই হয়! ভাগ্যিস সিনেমা, অর্থনীতি আর ক্রিকেটে বাঙালির লেগ্যাসি কম দিনের, নইলে সত্যজিৎ রায়, অমর্ত্য সেন আর সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে তুলনায় লম্বা ফর্দ’র সামনে নিরুপায় দাঁড়াতে হত। তবে কিনা, এই তিন ফিল্ডে বাঙালির স্বর্ণযুগ তাঁরাই এস্ট্যাবলিশ করলেন। সুতরাং পরের লোকজনের চাপ আছে। জার্সি খুলে ওড়াতে না-পারলে, সাইকেল করে শান্তিনিকেতন টহল না-দিলে, নিদেন পক্ষে পাইপমুখে পিয়ানো না-বাজালে পাতে দেওয়ার মতো হওয়া মুশকিল। চেষ্টা চলবে, তবে সমস্যা একটাই। আকিরা কুরোসাওয়া একবারই হয়। বাকিরা কুরোসাওয়া হওয়ার চেষ্টা করে। সারা জীবন ধরে।

তবে হ্যাঁ, মাঝেমধ্যে যে আমিও এট্টু অতীতচারী হয়ে উঠি না, তা নয়। লং ড্রাইভে রেডিয়োয় টানা এখনকার গানবাজনা শুনতে শুনতে হুট করে কোনও কারণে পঞ্চাশের দশকের কোনও গান বেজে উঠলে নিজের অজান্তেই ‘আহা’ বেরিয়ে আসে মুখ দিয়ে। এমনিতে চেঁচিয়ে ফাটিয়ে দিলেও, এই চল্লিশ ছুঁই-ছুঁই আমি বা আমরা কি মনে মনেও অস্বীকার করতে পারব যে, রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ, আলি আকবর-রবিশংকর, সত্যজিৎ-ঋত্বিক, সলিল-নচিকেতা বা সুনীল-শক্তির রিপিট হয়নি? সময় যত গড়িয়েছে, মিডিয়া বেড়েছে। তুলনায় মেধা কি একটু... যাক গে। আমরা তবু একটা সুমন চাটুজ্জে আর একটা সৌরভ নিয়ে শেষ বয়সে রক গরম করতে পারব। তার পরের ছেলেমেয়েদের কী হবে?

আমার এই প্রশ্নের মধ্যেও কিন্তু ওই স্বর্ণযুগ সিনড্রোমের ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে। আগামীকে দুর্ভাগা না-ভাবলে অতীতকে দিগ্বিজয়ী ভাবাটা কি তা হলে বাঙালির পক্ষে দুষ্কর? এত ক্ষণ তো রক্তমাংসের মানুষ আর তার পারফরমেন্সের খতিয়ান চলল। তার বাইরেও যা-যা হয় এবং হতে পারে, সে-সবও ওই আগেই ভাল ছিল। এখন গোল্লায় গেছে। যেমন, আগেকার বিয়েবাড়ির মেনু, আগেকার সাইকেল রিকশা, আগেকার রেডিয়ো, আগেকার চিড়িয়াখানা, আগেকার পেঁপেগাছ, আগেকার চৌবাচ্চা, আগেকার অন্ধকার, আগেকার ইত্যাদি। সে দশ বছর আগের হতে পারে, একশো বছর আগেরও হতে পারে। মোদ্দা কথা, আগের হতে হবে। তবেই না এখনকার তুলনায় তার প্রশ্নাতীত ভালত্ব! কখনও সময়ের এতখানি ব্যবধানে ‘আগের’ না-হলেও চলবে। ‘আগের ব্যাচে মাছের পিসগুলো বেটার ছিল’ বা ‘আগের বাসটায় ভিড় কম ছিল’... এও সেই এক সিনড্রোম। সবটাই আগে ছিল। এবং আমি সেই আগেভাগে শামিল হয়ে থাকতে পারলাম না বলে বুকফাটা আক্ষেপ। সেই সঙ্গে এই মুহূর্তের খোকলা আবহাওয়ায় বেঁচে থাকতে হচ্ছে বলে ভাগ্যকে তিরস্কার। অর্থাৎ, আমি বিলং করি স্বর্ণযুগে, কিন্তু লং হতে হতে এই প্রস্তরযুগে এসে ঠেকেছি। সুতরাং বাঙালির সব সোনা-ই আগের জাহাজে বন্দর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে, বাকি জীবন সে ঘাটে বসে থাকবে আনমনা... বয়ে যাওয়া সুসময় নিয়ে কথা বলবার জন্যে।

এমনকী আমি যে আমি, কুড়ি কুড়ি বছরের পার একটানা কবিতা লেখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, সেই আমাকেও আমারই স্বর্ণযুগের কথা মনে করিয়ে দিয়ে এই তো সে দিন মেসেজ করলেন এক পাঠক— ‘দাদা, আপনার এখনকার কবিতাগুলো পড়ছি, কিন্তু ঠিক আগের মতো হচ্ছে না।’ বার্তা এক দিক থেকে স্বস্তিরই, কেননা আগের মতোই লিখলে আর লেখার দরকারই বা কী? কিন্তু পরক্ষণেই ব্যাখ্যাও চলে এল— ‘আসলে আগে আপনার কবিতাগুলোয় চাইলেই সুর দেওয়া যেত। কিন্তু এখন যেগুলো লিখছেন, সুর দিতে পারছি না। খুব অসুবিধে হচ্ছে।’ অর্থাৎ কিনা, সেই পাঠকের কাছে আমার কবিতারও একটা স্বর্ণযুগ রয়েছে, যার এক্সপায়ারি ডেট ইতিমধ্যেই ওভার।

আসলে আর একটু তলিয়ে ভেবে দেখলে, আমরা প্রত্যেকেই হয়তো একটু হলেও পিছিয়ে যেতে চাই। কেউ কি দিব্যি কেটে বলতে পারবে, এই যে এখন বেঁচে আছি, তার চাইতে ছোটবেলাটা ভাল ছিল না? সেই শীতকালের ক্রিকেট, সেই মা’র বকুনি, সেই দিদিমণির পড়াতে আসা, সেই ছোট পাড়ার দুপুরবেলায় আচারওলার ডাক, সেই কোচিং থেকে ফেরার পথে আলগা চাউনি-বিনিময়, সেই হাতখরচ থেকে টাকা বাঁচিয়ে কবিতার বই কেনা, সেই লোডশেডিঙের সন্ধেবেলায় রেডিয়োয় রহস্য-নাটক শোনা, সেই রেনি-ডে ডিক্লেয়ার করার পর স্কুলের মাঠে ভিজতে ভিজতে ঝাঁপিয়ে পড়া... এমন কতশত কুচো সোনা তো ছড়িয়ে রয়েছে আমাদের ভেতরেই। আমরা প্রত্যেকে নিজেদের বুকের মধ্যে, মাথার মধ্যে যার যার ব্যক্তিগত স্বর্ণযুগ বয়ে বেড়াচ্ছি। তার হাত থেকে নিস্তার কোথায়? আর এই যে, এই মুহূর্তে পা রেখে পার হচ্ছি যে-সময়টা, ভুলে গেলে চলবে না, সেটাও কিন্তু আদতে স্বর্ণযুগই। ভবিষ্যতের।

সুতরাং, মানুষমাত্রেই অতীতচারী। কিন্তু এও সত্যি, বাঙালি তাতে স্পেশাল ফ্লেভার অ্যাড করেছে। তাই বাঙালিকে এই অংকে কনস্ট্যান্ট ধরলে সব যুগই স্বর্ণযুগ, যে সব যুগ তাদের বর্তমান সময়ে পারফেক্টলি অপদার্থ ছিল। এ-বিষয়ে একটা ঘটনার কথা বলি। তখন কলকাতা জুড়ে জুরাসিক-জ্বর চলছে। স্পিলবার্গের তাক-লাগানো ছবিটি শোলে-র রেকর্ড ভেঙে দেয় আর কী! এই রকম সময়ে আমার পাড়াতুতো এক দাদা সিনেমাটা দেখে খুব বিষণ্ণ হয়ে ফিরে এলেন। আমার আগেই দেখা। জিজ্ঞেস করলাম, তাঁর কেমন লাগল। তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘ওই সময়টাই ভাল ছিল রে...’। বুঝলাম, জুরাসিক এজ-এর কথা বলছেন। আমি কারণটা বুঝতে না-পেরে জানতে চাইতেই আরও দীর্ঘ একটা শ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘কেন আবার! মানুষ ছিল না।’ পৃথিবীর স্বর্ণযুগের এর চাইতে লাগসই সংজ্ঞা আমি আর শুনিনি।

bangali srijato
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy