Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

সস্তার প্লাস্টিক-পাত্রে রান্না ডাকছে ডায়াবেটিস

উত্তরে হাতিবাগান, কিংবা দক্ষিণে গড়িয়াহাট। ছবিটা একই রকম— ফুটপাথের উপর লাল-নীল-হলুদ, নানা রঙের প্লাস্টিকের থালা-গ্লাস-বাটি সাজিয়ে বসেছেন দোকানি। দাম অল্পই। ক্রেতাদের তাঁরা জানাচ্ছেন, শুধু সুন্দর দেখতেই নয়, মাইক্রোওয়েভেও বসাতে পারেন এই সব পাত্র। আর তার ফলে দেদার বিকোচ্ছে সস্তার বাসন।

সোমা মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ অগস্ট ২০১৫ ০২:২৩
Share: Save:

উত্তরে হাতিবাগান, কিংবা দক্ষিণে গড়িয়াহাট। ছবিটা একই রকম— ফুটপাথের উপর লাল-নীল-হলুদ, নানা রঙের প্লাস্টিকের থালা-গ্লাস-বাটি সাজিয়ে বসেছেন দোকানি। দাম অল্পই। ক্রেতাদের তাঁরা জানাচ্ছেন, শুধু সুন্দর দেখতেই নয়, মাইক্রোওয়েভেও বসাতে পারেন এই সব পাত্র। আর তার ফলে দেদার বিকোচ্ছে সস্তার বাসন।

তাতেই চিন্তিত ডাক্তাররা। তাঁদের হুঁশিয়ারি, নিম্নমানের প্লাস্টিকের বাসন মাইক্রোওয়েভে ব্যবহার করলে, তা থেকে বাসা বাঁধতে পারে ইনসুলিন প্রতিরোধী ডায়াবেটিস-এর মতো মারাত্মক রোগ।

কেবল এই রোগটিই নয়। চিকিৎসকদের বক্তব্য, পুরনো, রং চটে যাওয়া প্লাস্টিকের পাত্রে খাবার নিয়ে নিয়মিত মাইক্রোওয়েভে যাঁরা গরম করে খান, তাঁদের বিভিন্ন ধরনের রোগের আশঙ্কা অনেক বেশি। বন্ধ্যত্বের সমস্যা দেখা দিতে পারে। রক্তচাপ বেড়ে যায়। ধাক্কা খেতে পারে শিশুদের বাড়বৃদ্ধি। আর এর কারণ, প্লাস্টিক থেকে নির্গত হয় ‘বিসফেনল এ’ (বিপিএ) নামের এক ধরনের রাসায়নিক। যা শরীরের পক্ষে খুবই ক্ষতিকর। দেহের বিভিন্ন ধরনের হরমোনের কাজকর্ম পুরোপুরি গুলিয়ে দেয় রাসায়নিকটি।

সম্প্রতি একাধিক গবেষণায় ডায়াবেটিসের বিষয়টি সামনে আসায় নড়ে বসেছেন এন্ডোক্রিনোলজিস্টরা। এন্ডোক্রিন সোসাইটির আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিতও হয়েছে এই গবেষণার ফলাফল।

বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, প্লাস্টিক নরম জিনিস। সেটি শক্ত করতে বিপিএ নামের রাসায়নিকটির প্রয়োজন। প্লাস্টিকের বাসনে তাই স্বাভাবিক ভাবেই বিপিএ-র ব্যবহার বেশি। এ ছাড়া ওই রাসায়নিক প্লাস্টিকের পাইপ, সাবান তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। ডাক্তারদের মতে, ওই রাসায়নিকের বেশি প্রভাব পড়ে শিশুদের উপরে। ‘নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি স্কুল অব মেডিসিন’ শিশুদের মূত্রে ওই রাসায়নিকের মাত্রা নির্ণয় করে প্রমাণ করেছে শিশু-স্বাস্থ্যের পক্ষে তা কতটা বিপজ্জনক। রং চটে যাওয়া পাত্রগুলি আরও ভয়ের। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, এর অর্থ ওই বাসনের ‘প্রোটেকটিভ লেয়ার’ নষ্ট হয়ে গিয়েছে।

এন্ডোক্রিনোলজিস্ট সতীনাথ মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন, বিপিএ-র ক্ষতিকর দিকগুলি সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) বহু দিন ধরেই হুঁশিয়ারি দিয়ে আসছে। তিনি বলেন, ‘‘এই ধরনের রাসায়নিককে বলা হয় ‘এন্ডোক্রাইন ডিসরাপটর’। দেহে যত হরমোন আছে, তার প্রত্যেকটিরই নির্দিষ্ট কাজকর্ম গুলিয়ে যেতে পারে এর জেরে। ইনসুলিন প্রতিরোধী ডায়াবেটিস তারই এক চরম নমুনা।’’

শুধু মাইক্রোওয়েভে প্লাস্টিকের বাসন ব্যবহার নয়। হু বহু দিন ধরেই প্লাস্টিকের বোতলে জল খাওয়ারও বিরোধিতা করেছে। হু-র বক্তব্য, বোতলের গা থেকে নিঃসৃত রাসায়নিক জলে মিশে রোগ ছড়াতে পারে। প্লাস্টিকের জলের বোতল ফ্রিজে রাখাটাও ক্ষতিকর। কারণ অতিরিক্ত ঠান্ডাতেও রাসায়নিকটি নির্গত হয়। বাজারে বোতলবন্দি যে জল কিনতে পাওয়া যায়, অনেকেই সেই বোতল পরবর্তী সময়েও ব্যবহার করেন। সেটাও খুবই ক্ষতিকর।

এন্ডোক্রিনোলজিস্ট তীর্থঙ্কর চৌধুরী মনে করেন, প্লাস্টিকের মান যদি ভাল হয়, তা হলে শারীরিক ক্ষতির ঝুঁকি তুলনামূলক ভাবে কম থাকে। তিনি বলেন, ‘‘আর একটা বিষয়ে সতর্ক করতে চাই সকলকে। বাসনে মাইক্রোওয়েভেবল ছাপ মারা না থাকলে কোনও ভাবেই তা মাইক্রোওয়েভে ব্যবহার করবেন না।’’ তবে এ-ও সত্যি, বাজারে ‘মাইক্রোওয়েভেবল’ ছাপ মারা সস্তার নিম্নমানের বাসনও রয়েছে।

রেস্তোরাঁয় যে ধরনের প্লাস্টিকের কৌটোতে ভরে খাবার দেওয়া হয়, অনেকেই বাড়িতে আনার পরে সেই কৌটোগুলি একাধিক বার ব্যবহার করেন। ওই পাত্রে মাইক্রোওয়েভে খাবার গরমও করেন। এক চিকিৎসকের কথায়, ‘‘রেস্তোরাঁয় ওই পাত্রের জন্য অতিরিক্ত পাঁচ-ছ’টাকা দাম নেওয়া হয়। ওই দামে যে বাসন পাওয়া যাচ্ছে, সেটা তো এক বার ব্যবহার করেই ফেলে দেওয়ার কথা!’’

প্লাস্টিকের বাসন বা বোতলকে ঘিরে এমন স্বাস্থ্য-হুঁশিয়ারি অবশ্য নতুন কিছু নয়। বছর দশেক আগে প্লাস্টিকের মধ্যে থাকা আর একটি রাসায়নিক নিয়ে তোলপাড় হয়েছিল। চিকিৎসকেরা জানিয়েছিলেন ডিইএইচপি নামে ওই রাসায়নিকটি থেকে ক্যানসার হতে পারে। প্রবল চাপের মুখে পড়ে প্লাস্টিক বিক্রেতারা তখন ওই রাসায়নিকের ব্যবহার বন্ধ করে দেন। তবে এখনও বিচ্ছিন্ন ভাবে কোনও কোনও প্রস্তুতকারক রাসায়নিকটি ব্যবহার করছেন বলে অভিযোগ ওঠে মাঝেমধ্যেই।

রাজ্য প্লাস্টিক ফেডারেশনের তরফে প্রদীপ নায়ার অবশ্য নতুন এই সমস্যার কথা পুরোপুরি মানতে চাননি। তাঁর বক্তব্য, ‘‘কিছু দিন আগে বিষয়টা কানে এসেছে। কিন্তু প্লাস্টিকের পাত্রে খাবার গরম করলে কোনও রাসায়নিক বেরোবে, আর তা থেকে রোগ বাড়বে, এখনই এতটা আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই। এ নিয়ে আরও চর্চা দরকার। তবে খুব সস্তার জিনিস না কেনাই ভাল।’’ প্লাস্টিকের পাত্র নিয়মিত পরিষ্কার করার উপরেও জোর দিয়েছেন তিনি। তাঁর মতে, অপরিষ্কার পাত্র থেকে নানা ধরনের সংক্রমণ হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অপরিচ্ছন্নতাই রোগ ছড়ানোর মূল উৎস হয়ে ওঠে বলে তাঁর অভিমত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE