স্বাস্থ্যকর্তারা অভিযোগ করছেন, এ হল ডাক্তারদের ফাঁকি মারার অন্যতম পন্থা! আর সরকারি হাসপাতালের অধিকাংশ স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদের দাবি, মোটেই ফাঁকি নয়, এটা হল প্রয়োজন।
প্রসূতিদের সিজার করা নিয়ে এই মতবিরোধ মাথাচাড়া দিয়েছে স্বাস্থ্য দফতরের অন্দরেই। সত্যি কত জন মহিলার সিজার প্রয়োজন আর কত জনের তা করা হচ্ছে, তা নিয়ে চিকিৎসকদের সঙ্গে এক মত হতে পারছেন না চিকিৎসাকর্তারা।
সেপ্টেম্বরের ২৯ তারিখে রাজ্যের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কমিশনার সঙ্ঘমিত্রা ঘোষ প্রত্যেক সরকারি মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ও জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকদের কাছে একটি লিখিত নির্দেশ ( মেমো নম্বর— এইচ/এসএফডব্লিউবি/২১-০১-১১/৫৪৩৬(২)) পাঠিয়েছেন। তাতে বলা হয়েছে, যে সব ক্ষেত্রে সিজার করার কোনও প্রয়োজন নেই, স্বাভাবিক প্রসব সম্ভব সেখানেও অনেক চিকিৎসক সিজার করছেন। এর ফলে মা ও শিশু দু’জনেরই শারীরিক ক্ষতির আশঙ্কা থাকছে। কারণ, যে কোনও অস্ত্রোপচারেই সংক্রমণ, যন্ত্রণা, অ্যানেসথেশিয়া-জনিত জটিলতা, রক্ত জমাট বাঁধা এমনকী মৃত্যুর ঝুঁকি থাকে।
ওই নির্দেশে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এপ্রিল মাসের একটি বিবৃতি উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, মোট প্রসূতির মধ্যে ১০-১৫ শতাংশের বেশি মহিলার ক্ষেত্রে সিজার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু এই হার ক্রমশ বেড়ে চলেছে। এটা বন্ধ করতে হবে।
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, উদ্বেগের আসল কারণটা অবশ্য পরিবার কল্যাণ কমিশনারের সরকারি নির্দেশে উহ্য রয়েছে। সেটা হল, স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদের একটা বড় অংশের ফাঁকি মারার প্রবণতা। সেটাই হল অহেতুক সিজার বৃদ্ধির কারণ।
সেটা কীরকম? ব্যাখ্যা দিলেন রাজ্যের স্বাস্থ্যঅধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী—‘‘আমাদের কাছে খবর এসেছে, প্রাইভেট প্র্যাকটিস করবে বলে সিনিয়ার চিকিৎসকেরা তাড়াতাড়ি হাসপাতাল থেকে পালাতে চান। সাধারণ প্রসবে যে সময় লাগে অতক্ষণ অপেক্ষা করার ধৈর্যই নেই তাঁদের। কারণ, এতে তাঁদের লোকসান। তাই দরকার না থাকলেও সিজার করে দিচ্ছেন একের পর এক। এ বার আমরা কড়া হচ্ছি। আর এ সব করা যাবে না।’’ একই কথা বলেন স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘‘পরিসংখ্যানেই দেখা যাচ্ছে, বিশেষ করে মেডিক্যাল কলেজগুলিতে মাত্রাতিরিক্ত সিজার হচ্ছে। সেখানে খোঁজ নিয়ে জানা যাচ্ছে, দ্রুত কাজ শেষ করার জন্য গণহারে সিজার করে যাচ্ছেন ডাক্তারবাবুরা।’’ প্রসূতিদের চিকিৎসায় গঠিত স্বাস্থ্য দফতরের বিশেষ টাস্কফোর্সের প্রধান ত্রিদিব বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে আবার, ‘‘দফতর ভাবছে কিছুদিনের মধ্যেই নিয়ম করবে যে, হাসপাতালে কোনও সিজার করার আগে কেন সিজার হচ্ছে সেটা লিখিত ভাবে চিকিৎসককে জমা দিতে হবে।’’
এসএসকেএমের মতো হাসপাতালে মাসে যত স্বাভাবিক প্রসব হয় তার দ্বিগুণ-তিনগুণ সিজার হচ্ছে। আবার নীলরতন, আরজিকর বা কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে স্বাভাবিক প্রসব এবং সিজারের হার প্রায় সমান-সমান।
তা সত্ত্বেও স্বাস্থ্য দফতরের ‘ফাঁকি মারা’-র তত্ত্বের তীব্র বিরোধিতা করেছেন অধিকাংশ স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ। নিজেদের দাবির পক্ষে অনেকগুলি যুক্তি দেখিয়েছেন তাঁরা। এসএসকেএম এক চিকিৎসক যেমন জানান, মেডিক্যাল কলেজগুলিতে বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রধানত খারাপ কেস-ই রেফার হয়, দীর্ঘ পথ পেরিয়ে আসতে প্রসূতির অবস্থা আরও খারাপ হয় ফলে সিজার না-করে উপায় থাকে না। আরজিকর মেডিক্যাল কলেজের এক প্রবীণ স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের মতে, ‘‘১০-১৫ শতাংশ সিজারের তত্ত্ব এখন অকেজো। আমরা অনেক মেপে সিজার করি। তা-ও সেটা ৩০-৪৫ শতাংশ হয়ে যায়।’’
নীলরতন মেডিক্যাল কলেজের এক চিকিৎসকের কথায় আবার, অনেক প্রসূতি নিজেরাই ব্যথা সহ্য করতে পারবেন না মনে করে সিজার করার জন্য চাপ দিতে থাকেন। তখন আমরা কী করব? রোগীর কথা শুনব নাকি স্বাস্থ্য দফতরের নির্দেশ মাথায় রাখব?’’ ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের এক ডাক্তারবাবুর আবার যুক্তি, ‘‘যখন প্রয়োজন না থাকলেও প্রসূতি ব্যথার ভয়ে সিজার চাইছেন তখন তাঁকে কাউন্সেলিং করা দরকার, সাহস দেওয়া দরকার। কিন্তু হাসপাতালে ডাক্তার-নার্স এত কম আর রোগী এত বেশি যে সেই কাজ করা প্রায় অসম্ভব। ফলে অনেক ডাক্তারবাবু কথা না বাড়িয়ে সিজার করে দেন।’’
স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদের আরেকটি অংশ অবশ্য অকারণে সিজার করার কথা মেনে নিলেও তার পিছনে তাঁদের তাড়াতাড়ি প্রাইভেট প্র্যাকটিসে যাওয়ার কারণের কথা অস্বীকার করেছেন। তাঁদের দাবি, দরকার না থাকলেও তাঁরা প্রসূতির সিজার করে দেন কারণ তা না হলে পরের প্রসূতিকে ভর্তি নেওয়া যাবে না। এক-একটা মেডিক্যাল কলেজে মাসে দু’হাজারের বেশি প্রসব হয়। স্বাভাবিক প্রসবে যে সময়, শয্যা ও চিকিৎসক দরকার তা সরকারি হাসপাতালে নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy