বিমান হাইজ্যাক হয়নি। কোনও হুমকি-ফোনও আসেনি।
তবু কলকাতা বিমানবন্দরের টারম্যাকে ঠায় বারো ঘণ্টা দাঁড়িয়ে রইল এয়ার ইন্ডিয়া-র দিল্লিগামী উড়ান, দেড়শো যাত্রীকে পেটের ভিতরে ভরে। রবিবার বিকেল থেকে সোমবার সকাল পর্যন্ত সেই ‘বন্দিদশা’র বৃত্তান্ত দিল্লি পৌঁছে শুনিয়েছেন যাত্রীরা। শুনে আম আদমির চোখ কপালে উঠলেও এয়ার ইন্ডিয়া কর্তৃপক্ষের বিশেষ তাপ-উত্তাপ নেই।
ঘটনা হল, ধুঁকতে থাকা সরকারি বিমানসংস্থাটিকে ভর্তুকির খুঁটি জুগিয়ে দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে কেন্দ্রীয় সরকার। সংস্থার কর্তারা আশ্বাস দিচ্ছেন, লোকসান কমিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে তাঁরাও বদ্ধপরিকর। অথচ দৈনন্দিন পরিষেবায় হামেশা প্রকট হয়ে উঠছে পরিকল্পনা ও পেশাদারিত্বের চূড়ান্ত অভাব। কখনও বিমানের কলকব্জা বিগড়ে যাচ্ছে, কখনও পাইলট মিলছে না।
রবিবার দুই সমস্যা হাতে হাত মিলিয়ে হাজির হয়েছিল। তাতে যাত্রীদের নাভিশ্বাস উঠেছে। একরাশ ক্ষোভ, অনিশ্চয়তা নিয়ে ওঁরা বিমানের ভিতরে রাতভর জেগে কাটিয়েছেন। অভিযোগ, অক্সিজেন ও বাতানুকূল ব্যবস্থা চালু থাকলেও মাঝে-মধ্যে দম বন্ধ হয়ে এসেছে। কর্তৃপক্ষ কান দেননি। যাত্রীদের মধ্যে ছিল কলকাতার কিশোরী বসুধা সোম। ডিজিসিএ-কে চিঠি দিয়ে বসুধার পরিবারের আক্ষেপ, ‘যাত্রীদের সঙ্গে কার্যত গরু-ছাগলের মতো ব্যবহার করা হয়েছে।’ অন্য দিকে এয়ার ইন্ডিয়া’র দাবি— যাত্রীদের বলা হয়েছিল বিমান থেকে নেমে অপেক্ষা করতে। তাঁরা রাজি হননি।
রবিবার বিকেলে ২৩৮ জনকে নিয়ে এয়ার ইন্ডিয়া’র উড়ানটির (এআই ৭০১) দিল্লি যাওয়ার কথা ছিল। যাত্রীদের মধ্যে ছিলেন পাক হাইকমিশনার আব্দুল বাসিত ও সিপিএম সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। সাড়ে পাঁচটায় বিমান গড়াতে শুরু করেও ফিরে আসে। কারণ, যান্ত্রিক ত্রুটি।
আব্দুল বাসিত ও ইয়েচুরি-সহ ৫২ জন তখনই নেমে যান। ইয়েচুরি ফিরে যান সোজা আলিমুদ্দিনে। পাক হাইকমিশনার ও আরও ১১ জনকে পরের উড়ানে দিল্লি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বাকি ১৮৬ জন বিকল বিমানের ভিতরে বসে থাকেন। সন্ধে সাড়ে সাতটায় তাঁদের খাবার দেওয়া হয়। আর রাত সাড়ে দশটায় ‘উড়ান বাতিল’ ঘোষণা করে ওঁদের নামিয়ে আনা হয়। এমতাবস্থায় কিছু যাত্রী সোমবার ভোরের উড়ান ধরার ইচ্ছে প্রকাশ করায় তাঁদের হোটেলে পাঠানো হয়। বাকি থাকেন বসুধার মতো ১৫৪ জন, যাঁরা রবিবারই দিল্লি যেতে চেয়েছিলেন। তাঁরা প্রতীক্ষা করতে থাকেন।
প্রতীক্ষার পালা যে রাত পেরিয়ে সকাল পর্যন্ত গড়াবে, কেউ ভাবতে পারেননি। রাত সাড়ে দশটায় দিল্লি থেকে যে বিমানটি আসে, রাত বারোটায় তাতে ওঁদের তোলা হয়। আশ্বাস দেওয়া হয়, তখনই বিমান ছাড়বে। ‘‘কিন্তু রাত দেড়টাতেও ছাড়ল না। রাত পৌনে দু’টোয় এয়ার ইন্ডিয়া’র অফিসারেরা এসে জানালেন, পাইলট নেই।’’— বলছে বসুধা।
অগত্যা ১৫৪ জনকে ভিতরে বসিয়ে সারা রাত টারম্যাকে দাঁড়িয়ে থাকে এআই ৭০১। পাইলট জোগাড় করে এ দিন সোমবার সকাল সাড়ে ছ’টায় তা বসুধাদের নিয়ে দিল্লি উড়ে গিয়েছে। এত বিভ্রাট কেন?
এয়ার ইন্ডিয়ার ব্যাখ্যা: দিল্লি থেকে আসা পাইলটের ডিউটির মেয়াদ ফুরিয়ে গিয়েছিল। তিনি ফের দিল্লি যেতে রাজি হননি। পাশাপাশি আগাম ঠিক না-থাকায় দ্বিতীয় পাইলটও মেলেনি। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তো বিলক্ষণ জানতেন যে, পাইলটের ডিউটির সময়সীমা ফুরোবে! তবু কেন বলা হল রাত বারোটায় বিমান ছাড়বে?
কর্তাদের যুক্তি, তেমনই পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু যাত্রী তুলে দ্বিতীয় বিমানটি প্রস্তুত করতে গিয়ে পাইলটের ডিউটির সময়সীমা পেরিয়ে যায়। স্রেফ দশ মিনিট দেরি হওয়ার কারণে এই বিপত্তি।
যদিও তাতে পেশাদারিত্বের ঘাটতি ঢাকা পড়ছে না। বসুধার বাবা কল্লোল সোম রবিবার সন্ধের বিমানে মেয়েকে তুলে দিয়ে বাঘাযতীনে বাড়ি ফিরে গিয়েছিলেন। রাত এগারোটা নাগাদ তিনি ফের বিমানবন্দরে যান। এয়ার ইন্ডিয়া’র কল সেন্টারে ফোনও করেন। কল্লোলবাবুর কথায়, ‘‘রাত দু’টোয় কল সেন্টার বলল, বিমান দিল্লি পৌঁছে গিয়েছে। অবাক হয়ে শুধোলাম, কী করে হয়? আমার মেয়ে তো কলকাতাতেই বসে রয়েছে!’’ কল্লোলবাবু জানিয়েছেন, তখন গুগ্লেও তিনি দেখেছিলেন, সন্ধের বিমান নাকি রাতেই দিব্যি দিল্লি পৌঁছে গিয়েছে! কী করে এমনটা হতে পারে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy