Advertisement
০২ মে ২০২৪

কাশ্মীরে জঙ্গি হানায় নিহত ৭ সেনা, উরির আতঙ্ক ফেরাল নাগরোটা

উরি হামলার পরে পাক-অধিকৃত কাশ্মীরে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক চালিয়েছিল ভারতীয় সেনা। সীমান্ত সন্ত্রাসে বড়সড় আঘাত হানা গিয়েছে, এমন দাবি শোনা গিয়েছিল তখন। দু’দিন আগেও প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পর্রীকর সে কথার প্রতিধ্বনি করে বলেছেন, দেশের সীমান্ত এখন সুরক্ষিত।

নিশানায় জঙ্গি। নাগরোটায় ছাউনির কাছে সেনারা। ছবি: পিটিআই।

নিশানায় জঙ্গি। নাগরোটায় ছাউনির কাছে সেনারা। ছবি: পিটিআই।

সাবির ইবন ইউসুফ
শ্রীনগর শেষ আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০১৬ ০৩:২৭
Share: Save:

উরি হামলার পরে পাক-অধিকৃত কাশ্মীরে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক চালিয়েছিল ভারতীয় সেনা। সীমান্ত সন্ত্রাসে বড়সড় আঘাত হানা গিয়েছে, এমন দাবি শোনা গিয়েছিল তখন। দু’দিন আগেও প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পর্রীকর সে কথার প্রতিধ্বনি করে বলেছেন, দেশের সীমান্ত এখন সুরক্ষিত। নোট বাতিল করে জঙ্গি কার্যকলাপে একটা বেশ বড় ধাক্কা দেওয়া হয়েছে।

মঙ্গলবার ভোরে আরও এক বার সেনা ঘাঁটিতে জঙ্গি আক্রমণের ঘটনা বুঝিয়ে দিল, অবস্থাটা কিন্তু বদলায়নি। বরং কাশ্মীরের নাগরোটা আরও এক বার ফিরিয়ে আনল উরির স্মৃতি। এ বারে প্রাণ গেল দুই অফিসার-সহ সাত সেনার। সাম্বায় জঙ্গি অনুপ্রবেশ রুখতে গিয়েও এ দিন আহত হন বিএসএফের এক ডিআইজি-সহ সাত জন।

ঘটনাচক্রে এ দিনই আনুষ্ঠানিক ভাবে পাক সেনাপ্রধানের দায়িত্ব নিয়েছেন জেনারেল কমর জাভেদ বাজওয়া। অনেকের মতে, পাক সেনা যে জঙ্গিদের মদত দেওয়ার নীতি থেকে সরছে না, নাগরোটা ও সাম্বার ঘটনাই তার বার্তা।

জম্মু-শ্রীনগর সড়কের উপরে নাগরোটা-য় সেনার ১৬ কোরের সদর দফতর। পাশেই রয়েছে ১৬৬ মিডিয়াম আর্টিলারি রেজিমেন্টের শিবির। আজ ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকে ছ’টার মধ্যে সেই শিবিরেই ঢুকে পড়ে চার ফিদায়েঁ জঙ্গি। সেনা সূত্রে খবর, পুলিশের উর্দি পরে আসায় প্রথমে তাদের চিনতে ভুল করেছিলেন সেনা শিবিরের রক্ষীরা। গেটের কাছে পৌঁছে প্রথমে গ্রেনেড ছোড়ে হামলাকারীরা। তার পরে সোজা ঢুকে পড়ে শিবিরে। শুরু হয় এলোপাথাড়ি গুলিবর্ষণ। গেটের কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলেন বছর ছত্রিশের মেজর গোসাভি কুনাল মান্নাদির। জঙ্গিদের গুলিতে আহত হন তিনি। ততক্ষণে চমক কাটিয়ে সেনারাও জবাব দিতে শুরু করেছেন। দু’তরফে গুলিবর্ষণের মাঝে দীর্ঘক্ষণ আহত মেজরকে উদ্ধার করা যায়নি। শেষ পর্যন্ত মৃত্যুই হয় তাঁর। ল়ড়াইয়ের মধ্যেই গেটের পাশে এল-আকৃতির অফিসার্স মেসে ঢুকে পড়ে জঙ্গিরা। সেখানে প্রাতরাশ খেতে আসা রাষ্ট্রীয় রাইফেলসের তিন জওয়ান কদম শম্ভাজি যশবন্তরাও, উথাপা ও অসীম রাই তাদের গুলিতে নিহত হন।

ঘণ্টাখানেক লড়াই চলার পরে নাগরোটা পৌঁছয় প্যারা কম্যান্ডোর দল। সেনা সূত্রে খবর, অফিসার্স মেসের মধ্যে তখন জনা বারো সেনা ছাড়াও দুই অফিসারের স্ত্রী ও সন্তান আটকে ছিলেন। ফলে কার্যত পণবন্দি পরিস্থিতি তৈরি হয়। জঙ্গি হামলার মধ্যেও মাথা ঠান্ডা রেখে দুই অফিসারের স্ত্রী তাঁদের কোয়ার্টারের দরজা জিনিসপত্র দিয়ে বন্ধ করে দেন। ফলে জঙ্গিরা ঘরে ঢুকতে পারেনি।

মেসের প্রতিটি ঘর খুঁজে জঙ্গিদের খতম করতে সময় লাগবে বুঝে নিয়ে নতুন ভাবে অভিযান শুরু করে সেনা। প্রায় আট ঘণ্টা পরে দুপুরে শেষ হয় লড়াই। ততক্ষণে খতম হয়েছে তিন জঙ্গি। নিহত হয়েছেন মেজর অক্ষয় গিরীশ কুমার এবং দুই জওয়ান সুখরাজ সিংহ ও রাঘবেন্দ্র সিংহ। আহত হয়েছেন তিন সেনা। তবে আটকে পড়া সেনা ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের অক্ষত অবস্থাতেই উদ্ধার করেছেন কম্যান্ডোরা।

সেই সঙ্গে আজ ভোরেই সাম্বার রামগড় সেক্টরের চামলিয়ালে সীমান্ত পেরোতে গিয়ে বিএসএফের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় এক দল জঙ্গি। তাতে তিন জঙ্গি খতম হয়। আহত হন বিএসএফের ডিআইজি বি এস কাসানা-সহ সাত জওয়ান। রাতে আবার উরি সেক্টরেই সংঘর্ষবিরতি ভাঙে পাকিস্তান।

নাগরোটার ঘটনার সঙ্গে উরি ঘাঁটিতে হামলার মিল খুঁজে পাচ্ছেন অনেকেই। ঠিক এ ভাবেই ভোরে উরির সেনা ঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছিল জঙ্গিরা। ঘাঁটির ভিতরের ছক ও নানা তথ্য ছিল হামলাকারীদের নখদর্পণে। নাগরোটার ক্ষেত্রেও যে ভাবে হামলা চালানো হয়েছে, তাতে জঙ্গিদের কাছে নির্দিষ্ট তথ্য ছিল বলে নিশ্চিত গোয়েন্দারা। সেনা-গোয়েন্দা সূত্রে খবর, নাগরোটায় জঙ্গি গতিবিধি কার্যত নেই। তাই ওই এলাকায় সেনা শিবিরে নিরাপত্তাও কিছুটা শিথিল। তা জেনেই জঙ্গিরা হামলা চালিয়েছে বলে মনে করছেন গোয়েন্দারা।

কেন্দ্রীয় সরকারের কিছু সূত্রের মতে, বিদায়ী পাক সেনাপ্রধান রাহিল শরিফ সরে দাঁড়ানোর আগে ভারতে কয়েক দফা জঙ্গি হামলা চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। আজ এক দিকে সেটা যেমন করে দেখাল জঙ্গিরা, অন্য দিকে জেনারেল কমর বাজওয়া দায়িত্ব নেওয়ার দিনেই প্রমাণ করা হল যে, পাক সেনা আগ্রাসী মনোভাব থেকে নড়বে না। কাশ্মীর সম্পর্কে অভিজ্ঞ বাজওয়া নিয়ন্ত্রণরেখায় ছায়াযুদ্ধের পরিধি বাড়াতে পারেন বলেও আশঙ্কা মোদী সরকারের অন্দরে। প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রসচিব ও বিজেপি সাংসদ আর কে সিংহের কথায়, ‘‘বাজওয়া শুরুতেই ভারতকে একটি বার্তা দিলেন।’’ কিন্তু দেশে তার চেয়েও বড় প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে মোদী সরকার। বিরোধীরা জানতে চাইছেন, জঙ্গি হানা, অনুপ্রবেশ কিছুই কমেনি। তা হলে পাক-অধিকৃত কাশ্মীরে পাল্টা হানা চালিয়ে লাভ কী হল?
কংগ্রেস মুখপাত্র রণদীপ সূর্যেওয়ালার প্রশ্ন, ‘‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের পর থেকে ২৯ জন সেনা ও ১০ জন সাধারণ মানুষ জঙ্গি হানায় প্রাণ হারিয়েছেন। মোদীজি কি আদৌ এ নিয়ে মাথা ঘামান?’’

নাগরোটা ও সাম্বার ঘটনা নিয়ে আজ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে কথা বলেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পর্রীকর ও সেনাপ্রধান দলবীর সিংহ সুহাগ। প্রত্যাশিত ভাবেই নয়া হামলার জবাবে আরও কড়া পদক্ষেপ করতে চাপ বাড়ছে সরকারের উপরে। জঙ্গি ঘাঁটিতে বিমানহানার প্রস্তাবও শোনা গিয়েছে কয়েকটি শিবির থেকে। তবে এক প্রাক্তন সেনা কর্তার কথায়, ‘‘এর অর্থ যুদ্ধ। সে দিকে এগোনো কার্যত অসম্ভব।’’ তবে আপাতত সামরিক ও অর্থনৈতিক, দু’রকম ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার যতটা সাফল্যের দাবি করছিল, তা নিয়ে বড়সড় প্রশ্ন উঠেই গেল।

(সহ-প্রতিবেদন প্রেমাংশু চৌধুরী)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE