তাজমহল হোটেলে জঙ্গিদের বিস্ফোরণ। —ফাইল চিত্র।
জলবায়ু পরিবর্তন ঠিক কী বস্তু, তখনও তা নিয়ে সচেতনা তৈরি হয়নি সেভাবে। অবশ্য তেমন প্রয়োজনও পড়েনি। কারণ নভেম্বরের শেষ দিকে শীতের আমেজ ভালই ছিল মায়ানগরীতে। তেমনই এক সন্ধ্যায় লণ্ডভণ্ডহয়ে গিয়েছিল গোটা শহর। যার নেপথ্যে ১০ পাকিস্তানি জঙ্গি।
নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আরব সাগর পেরিয়ে দক্ষিণ মুম্বইযে ঢুকে পড়ে তারা। তাও আবার কাঁধে বন্দুক ও গোলা–বারুদের ঝোলা নিয়ে। তার পর টানা তিনদিন ধরে সেখানে তাণ্ডব চালায়।রীতিমতো ঠাণ্ডা মাথায় ১৬৪ জনকে খুন করে। যাঁদের মধ্যে ২৮ জন বিদেশি নাগরিক ছিলেন। গুরুতর জখম হলেও বরাতজোরে বেঁচে যান ৩০০ জন।
সেই ঘটনার পর ১০ বছর কেটে গিয়েছে। তবে আজও দগদগে ২৬/১১–র স্মৃতি। ঠিক কী হয়েছিল সেই রাতে? আজমল কাসভের না হয় ফাঁসি হয়েছে। কিন্তু পড়শি দেশে ঘাঁটি গেড়ে থাকা আসল অপরাধীদের সাজা হয়েছে কি?
এক নজরে দেখে নিন গত দশ বছরের ঘটনাবলী—
হামলার প্রস্তুতি
জঙ্গি সংগঠন ‘লস্কর–ই–তৈবা’–র শীর্ষ নেতৃত্বের অধীনে চার দফা প্রশিক্ষণ দেওয়া হয জঙ্গিদের। সেপ্টেম্বরে মুম্বইয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় ১০ জঙ্গি। আরব সাগরে তাদের নৌকো ডুবে যাওয়ার উপক্রম হযেছিলএকবার। তবে কোনওক্রমে রক্ষা পায়। প্রথমে ৭ নভেম্বর হামলার ছক ছিল তাদের। তবে তাদের নিরাপদে ভারতে পৌঁছে দিতে অস্বীকার করে একটি ভারতীয় নৌকার ক্যাপ্টেন। জঙ্গিদের নাগাল থেকে পালিয়ে বাঁচেনতিনি। এক মৎস্যজীবীর ডিঙিতে চড়ে পরে মুম্বই এসে পৌঁছয় তারা। যদিও তাদের উদ্দেশ্য জানতেন না ওই মৎস্যজীবী।
তাজ হোটেলে তখন চলছে গুলির লড়াই। আর সারা বিশ্বের নজর ছিল মুম্বইয়ের দিকেই। —ফাইল চিত্র।
হামলা
মুম্বইয়ে পা রেখে ২৬ নভেম্বর রাত সাড়ে ৯টা নাগাদ প্রথমে ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ টার্মিনাস রেল স্টেশনে হামলা চালায় ইসমাইল খান ও আজমল কাসভ। তার পর একে একে কামা হাসপাতাল, লিওপল্ড ক্যাফে,তাজ হোটেল এবং ওবেরয রিসর্টের সদর দফতর এবং নারিমান হাউসে হামলা চালানো হয়। দীর্ঘ ৬০ ঘণ্টা গুলি বিনিময়ের পর জঙ্গিদের নিকেশ করতে সক্ষম হয় পুলিশ। আজমল কাসভ ছাড়া সকলেরই মৃত্যু হয়। ২৭তারিখ ভোরেই আহত অবস্থায় তাকে গ্রেফতার করে ফেলে পুলিশ। ৩০ নভেম্বর জেরায় অপরাধ কবুল করে সে।
আইনি প্রক্রিয়া
২৬/১১ হামলার শুনানির জন্য এমএল তহলিয়ানিকে বিশেষ বিচারপতি হিসাবে নিয়োগ করা হয়। আর্থার রোড সেন্ট্রাল জেলে কড়া নিরাপত্তাক মধ্যে রাখা হয় কাসভকে। ২০০৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ম্যাজিস্ট্রেটশ্রীমতী আরভি সাওয়ন্ত বাগুলের সামনে অপরাধ কবুল করে সে। ২২ ফেব্রুয়ারি সরকারপক্ষের আইনজীবী নিযুক্ত হন উজ্জ্বল নিকম। ২৫ ফেব্রুয়ারি কাসভ এবং আরও দু’জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট জমা পড়ে। শুরু হয়মামলার শুনানি। ২০ জুলাই কাসভকে দোষী সাব্যস্ত করেন বিচারপতি তহলিয়ানি। অন্যদিকে আমেরিকার শিকাগোয় গ্রেফতার হয় পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ডবল এজেন্ট ডেভিড কোলম্যান হেডলি। মুম্বইয়ের কোথায়,কীভাবে হামলা চালানো যায়, সেই পরিকল্পনায় সামিল ছিল সে। হামলার আগে মুম্বই-সহ ভারতের বিভিন্ন শহর ঘুরে করে গিয়েছিল। এমনকি তাজ হোটেলে রাতও কাটিয়ে গিয়েছিল। মামলা চলাকালীন ১৮ ডিসেম্বরবয়ান পাল্টে ফেলে কাসভ। অপরাধ অস্বীকার করে।
আরও পড়ুন: কাশ্মীরের সোপিয়ানে সেনার যৌথ অভিযান, নিহত ৬ জঙ্গি, মৃত্যু এক জওয়ানেরও
কাসভের ফাঁসি
২০১০ সালের ৬ মে কাসভকে ফাঁসির সাজা শোনায় ট্রায়াল কোর্ট। বম্বে হাইকোর্টে বিষয়টি গেলে ২০১১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ফাঁসির সাজা বহাল রাখে আদালত। মার্চ মাসে হাইকোর্টের রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিযে সুপ্রিমকোর্টের দ্বারস্থ হয কাসভ। দীর্ঘ তর্ক বিতর্কের পর ২০১২ সালের ২৯ অগস্ট কাসভের ফাঁসির সাজা বহাল রাখে শীর্ষ আদালত। সেপ্টেম্বর মাসে মহারাষ্ট্র সরকারের মাধ্যমে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়েরকাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করে কাসভ। কিন্তু তা খারিজ হয়ে যায়। ২১ নভেম্বর তাকে পুণের ইয়েরওয়াড়া জেলে নিয়ে গিয়ে ফাঁসি দেওয়া হয়। কবর দেওয়া হয় জেলের মধ্যেই।
আরও পড়ুন: ‘ভোটের আগে রামরাম, ভোটের পর আরাম’, অযোধ্যায় বিজেপিকে তোপ শিবসেনার
পাকিস্তান সরকার
নিহত জঙ্গিদের ডিএনএ পরীক্ষার রিপোর্ট, বেশ কিছু ছবি এবং তাদের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া কিছু জিনিসপত্র পাকিস্তানের হাতে তুলে দেয় ভারত সরকার, যাতে প্রমাণ হয় হামলাকারীরা পাকিস্তানি নাগরিক ছিলএবং লস্কর চাঁই জাকিউর রহমান লকভি এবং হাফিজ সঈদদের নির্দেশেই এ দেশে এসেছিল তারা। যার পর পাকিস্তানে মো্ সাতজনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের মধ্যে ছিল হামাদ আমিন সাদিক নামের একহোমিওপ্যাথি ওষুধ প্রস্তুতকারকও। জঙ্গিদের ব্যাঙ্ক খোলা এবং জঙ্গিদের রসদ জোগানোর দায়িত্বে ছিল সে। ২০০৯ সালের ৩ অক্টোবর তাদের শুনানি শুরু হয়। কিন্তু সেই মামলা বেশিদূর এগোয়নি। ২০০৮ সালেরডিসেম্বর মাসে পাকিস্তান সন্ত্রাস দমন আইনে লস্কর জঙ্গি জাকিউর রহমান লকভিকে গ্রেফতার করা হয়। দায়ের হয় মামলাও। কিন্তু তাকে ভারতচের হাতে তুলে দিতে অস্বীকার করে ইসলামাবাদ। পরে জামিনে মুক্তিওপেয়ে যায় সে।
এখনও পাকিস্তানে বহাল তবিয়তেই আছে মূল কুচক্রী হাফিজ সইদ। —ফাইল চিত্র।
পাকিস্তান সরকারের এমন আচরণের তীব্র প্রতিবাদ করেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। আসল অপরাধীদের বিরুদ্ধে তারা কোনও পদক্ষেপই করেনি বলে অভিযোগ তোলেন তিনি। পাকিস্তানিআইনজীবী ও তদন্তকারী আধিকারিকদের একটি দল অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে প্রমাণ জোগাড় করতে দু’–দু’বার ভারতে এসেছিল। যথেষ্ট প্রমাণও হাতে পেয়েছিলেন তাঁরা। তা সত্ত্বেও আজও সেখানে অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে২৬/১১–র চক্রীরা।
ডেভিড হেডলি
২০১৩ সালের ২৪ জানুয়ারি ডেভিড হেডলিকে ৩৫ বছরের কারাদণ্ড শোনায় মার্কিন আদালত। হামলার ষড়যন্ত্র সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য হাতে পেতে ২০১৫ সালের ১০ ডিসেম্বর তাকে রাজসাক্ষী করতে রাজি হয়মুম্বইয়ের বিশেষ আদালত। ২০১৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ভিডিয়ো কনফারেন্সের মাধ্যমে বম্বে হাইকোর্টে সাক্ষ্য দিতে শুরু করে সে। সরকারি আইনজীবী উজ্জ্বল নিকম তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। পরে সেই সব তথ্যপাকিস্তানের হাতে লস্করের বিরুদ্ধে প্রমাণ স্বরূপ তুলে দেওয়া হয়। ২০১৮ সালের ৮ জুলাই মার্কিন জেলে সহবন্দীর হাতে আক্রান্ত হয় হেডলি। গুরুতর জখম অবস্থায় তার চিকিৎসা শুরু হয়। তবে কে হামলা করেছে,কেন করেছে, তা জানাতে অস্বীকার করে মার্কিন প্রশাসন।
(দেশজোড়া ঘটনার বাছাই করা সেরা বাংলা খবর পেতে পড়ুন আমাদের দেশ বিভাগ।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy