Advertisement
১৬ মে ২০২৪

সুস্মিতা এখনও ঘুরে দাঁড়ানোর আশায়

আড়াই মাস আগে ভোট হয়েছে রাজ্যে। ফল বেরিয়েছে মাস খানেক আগে। এবং সেই ভোটে ভরাডুবি হয়েছে দলের। রাজ্যে ক্ষমতাচ্যূত হয়েছে কংগ্রেস সরকার। খোদ শিলচরে হেরে গিয়েছেন দেব-পরিবারের প্রতিনিধি। দলের অন্তর্কলহও তীব্র। নেতারা অনেকেই অনেককে বিশ্বাস করেন না। এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আনন্দবাজারের প্রতিনিধি উত্তম সাহার কাছে মুখ খুললেন শিলচরের কংগ্রেস সাংসদ, সন্তোষ-তনয়া সুস্মিতা দেব।সোমবার সকাল। ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের শিলচর-কলকাতা বিমানে উঠলেন সাংসদ সুস্মিতা দেব। নির্ধারিত ১-এ আসনে বসতে গিয়েই চোখাচোখি। আমি ছিলাম ৩-সিতে। বিমান যখন ছাড়তে চলেছে, তখনও তাঁর পাশের আসন ফাঁকা।

শেষ আপডেট: ২৩ জুন ২০১৬ ০৮:৪৬
Share: Save:

সোমবার সকাল। ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের শিলচর-কলকাতা বিমানে উঠলেন সাংসদ সুস্মিতা দেব। নির্ধারিত ১-এ আসনে বসতে গিয়েই চোখাচোখি। আমি ছিলাম ৩-সিতে। বিমান যখন ছাড়তে চলেছে, তখনও তাঁর পাশের আসন ফাঁকা। ‘চলে আসুন, আড্ডা মেরে যাওয়া যাবে’, এমন আহ্বানে আর দেরি করিনি। আসলে আড্ডাই হলো, সারাপথ সারাক্ষণ। কত কী বিষয়!

এ বার পাঁচদিনের জন্য বেরিয়েছেন সুস্মিতাদেবী। দিল্লির উদ্দেশে কলকাতার বিমানে চড়েছিলেন। রাজধানীতে পৌঁছে পরপর দুটো মিটিং। পরে যাবেন মুম্বই। সেখান থেকে ফিরে দিল্লিতে আবার আর একটি সভা। এর মাঝে আরও কত জায়গায় যে যেতে হবে, কে জানে! সুস্মিতাদেবীর আক্ষেপ, ‘‘সবাই চান, কোন গলির পাইপে আজ জল আসেনি, কাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেল, সেগুলো নিয়েই পড়ে থাকি। কিন্তু সাংসদ হিসেবে ও সব যেমন আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে, তেমনই আমাকে দেশের পলিসি তৈরিতেও অংশ নিতে হয়। বেশ কিছু কমিটির সদস্য আমি। বিরোধী সাংসদ বলে একটু বেশি করেই চোখ-কান খোলা রাখতে হয়।’’

তবে ‘পলিসি মেকিং’-এর অংশ হলেও তিনি নিজেও কখনও কখনও পলিসির শিকার হয়ে যান। উদাহরণ হিসেবে টেনে আনলেন গ্রাম অধিগ্রহণ বা দত্তক নেওয়ার কথা। লক্ষ্মীপুর মহকুমার লক্ষ্মীনগর গ্রামটিকে তিনি দত্তক নিয়েছিলেন। কিন্তু বর্তমান প্রক্রিয়ায় মাত্র এক বছরে সে গ্রামের জন্য বিশেষ কিছুই করার ব্যবস্থাই নেই। তাঁর মতে, দত্তক প্রতিপালনে অতিরিক্ত কোনও বরাদ্দ নেই। তাই তিনি যে দ্বিতীয় গ্রামের কথা এখনই ভাবছেন না, তা ক্ষোভের সুরেই জানিয়ে দেন। শিলচরের সাংসদের কথায়, এই সময়ে তাঁর দ্বিতীয় গ্রাম অধিগ্রহণের কথা। কিন্তু লক্ষ্মীনগর নিয়েই তিনি এখনও সমস্যায়। এক দিকে, অন্য গ্রামের মানুষদের অভিযোগ, তাঁদের বাদ দিয়ে লক্ষ্মীনগরকে বেশি আপন করে নিয়েছেন। অন্য দিকে, লক্ষ্মীনগরের মানুষও সন্তুষ্ট হতে পারছেন না। তাঁদের প্রশ্ন, দত্তক নিয়ে হলটা কী!

তাই তাঁর সিদ্ধান্ত, রাষ্ট্রপতিকে চিঠি লিখবেন। দত্তক গ্রামের জন্য পৃথক তহবিল বরাদ্দের আর্জি জানাবেন।

কিন্তু কংগ্রেসের ক্ষমতা হারানোর ৩০-৩২ দিনের মাথায় মানুষ কী শুধু দত্তকগ্রামের কথা শুনতে চাইবেন সুস্মিতা দেবের কাছে! মানুষের আগ্রহের জায়গাটা তিনিও বোঝেন। তাই একবার খুঁচিয়ে দিতেই বলতে শুরু করলেন, ‘‘কিছু নেতা হাইকম্যান্ডকে বুঝিয়েছিলেন, আমি বেশ কয়েকজন প্রার্থীর ভোট কাটার চেষ্টা করব। আমাকে বেশি ঘুরতে দেওয়া হলে মুশকিল হতে পারে। উপনির্বাচনে অন্তর্ঘাত করেছি বলে অহেতুক অভিযোগ করা হয়েছিল আমার বিরুদ্ধে। সে জন্য হাইকম্যান্ড শুরু থেকেই আমাকে এক জায়গায় বেঁধে ফেলতে আমার মা বা বোনকে টিকিট দিয়ে আমাকে অগ্নিপরীক্ষায় ফেলতে চায়।’’

সুস্মিতাদেবীর কথায়, ‘‘প্রথমে আমায় চেপে ধরে দিদির (ভারতী দেব) জন্য। কিন্তু দিদি কোনও মতেই রাজি হননি। শেষে মা-র কথা বলা হল। কমলনাথ ডেকে বললেন, সুস্মিতা তোমায় একটা কথা বলি, না করতে পারবে না। আমরা শিলচরে বীথিকা দেব-কে দাঁড় করাতে চাই। বুঝি, তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছেন। আপত্তি করে লাভ হবে না। তখনই নিজেকে তৈরি করতে শুরু করি। মা-কে রাজি করাতেও কম কষ্ট হয়নি। মা চাইছিলেন না দাঁড়াতে।’’

সুস্মিতার গলায় এ বার অভিমানের সুর, ‘‘শিলচরের মানুষকে না হয় বাধ্যবাধকতাটা বোঝাতে পারিনি। তার চেয়েও বড় দুঃখের, বোঝানো গেল না তমাল (বণিক)-দেরও। তাদের আমি অত্যন্ত কাছের মানুষ বলে ভাবতাম, এরা ভুল বোঝায় বেশি কষ্ট পেয়েছি।
তমালকে পুরসভার চেয়ারম্যান করা বা বাপ্টুকে (শৈবাল দত্তের ডাকনাম) শহর কংগ্রেসের সভাপতি করতে আমাকে কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি! কার কী গণভিত্তি বা জনপ্রিয়তা আছে সে সবে যাচ্ছি না। কিন্তু
রাজনীতিতে এত দ্রুত হতাশ হলে কি চলে!’’

বলতে থাকেন সুস্মিতা, ‘‘তমাল কি দাঁড়ালেই জিতে যেত? ব্রডগেজ, মহাসড়ক, রাস্তাঘাট, কী প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা! জেতার তো সম্ভাবনা ছিলই না। তাহলে শুধু টিকিট পাওয়ার জন্য সব ছেড়েছুড়ে দেওয়া, এমনটা তার কাছ থেকে আশা করিনি। টিকিটের জন্য কোথায় কোথায় গিয়েছে সে, সব খবর আমি জানি। তবু মনে করেছি, তাদের বাদ দিয়ে চলি কী করে! তাই ডাকলাম, কথা বললাম। কী কাজ করেছে জানি না! কিন্তু মায়ের হারের পর আজ পর্যন্ত একটা ফোনও করল না! এ বড় দুঃখের!’’

তবু সুস্মিতা আশাবাদী, সবাই সব বুঝবে। এক বছর পর তাঁর প্রতি সকলের ভুল বোঝাবুঝির অবসান হবে। সবাই একযোগে কাজ করবেন। তাই কাউকে দূরে সরাতে চান না তিনি।

নিজে রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। সেই কারণেই সুস্মিতাদেবী দলের সবাইকে আশ্বস্ত করেন, তিনি ছাড়া দেববাড়ির আর কেউ রাজনীতিতে আসছেন না। বাবা অসুস্থ। মা এবারই চাইছিলেন না। দিদি শিলচরের রাজনীতিতে একেবারেই আগ্রহী নন।

কিছুক্ষণ নীরব থাকেন সুস্মিতা। বিমান তখন মেঘের কোলে। ভাবছিলাম আড্ডায় নতুন প্রসঙ্গ আনা যাক। তার আগেই বলতে থাকেন সুস্মিতাদেবী, ‘‘এক বিপর্যয়ের সময় আমি রাজনীতিতে এসেছিলাম। বাবা হেরে গিয়েছেন। চতুর্দিকে অন্তর্কলহ। কে কাকে দাবিয়ে রাখবেন সবাই তাই নিয়েই ভাবছিলেন। সেই পরিস্থিতিতে আমার রাজনীতির শুরু। সেখান থেকেই আমার রাজনীতিরও পাঠ। তাই বিশ্বাস করি, সবাই মিলেই আবার কাজ করব। তাই বিদ্বেষ যত তাড়াতাড়ি ঝেড়ে ফেলা যায়, যত দ্রুত ভুল বোঝাবুঝির শেষ হয়, উঠে দাঁড়ানোর কাজটা তত সহজতর হবে।’’

অতীত আউড়ে সন্তোষ-কন্যা শোনান, ‘‘আজ আর বলতে আপত্তি নেই, রাজ্যে কংগ্রেসের সরকার ছিল। কিন্তু একজন কংগ্রেস সাংসদ হিসেবে কোন ক্ষমতা ছিল আমার! নিজের পছন্দের একজন অফিসারকে বদলি করে আনার সুযোগও ছিল না। তরুণ গগৈকে একটা ভাল কথা বললে তিনি ভাবতেন ষড়যন্ত্র হচ্ছে। করতেন উল্টোটা।’’ আর তখনকার বিধায়কদের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘আমি সাত বিধানসভা কেন্দ্রের সাংসদ। কিন্তু কারও এলাকায় একটা সভা করার সুযোগও পাইনি।’’ কারও নাম টানতে চাননি তিনি। শুধু জানান, ‘‘ঘনিষ্ট বলে পরিচিত বিধায়কও সভা করতে যাব বললে, এখন না, তখন করেছেন!’’

আবার কিছুক্ষণ চুপচাপ। ফের অভিমানের সুর, ‘‘এক একবার ভাবি, বিজেপির সরকার গড়া আমাদের জন্য মোটেও ভাল নয়। আবার ভাবি, আমাদের সরকার এলে ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে নিজেদের বিরুদ্ধে লড়েই অর্ধেক শক্তি নষ্ট হত।’’ তাঁর বক্তব্য, ‘‘মানুষের কাছে যাওয়ায় আমার সমস্যা নেই। আমি জানি, ভোটাররা আমায় বিশ্বাস করেন। আমার সততা প্রশ্নাতীত, এ আমি যেমন জানি, তেমনই জানেন কাছাড়ের মানুষ। ফলে ভোটের লড়াই আমার কাছে কঠিন নয়। কঠিন ঘরের কলহ থেকে বেরিয়ে আসা।’’

অন্য দিকে, এই কলহই অবশ্য তাঁকে স্বস্তিতে রাখে। সুস্মিতা দেব বলেন, বিজেপিও ভাল নেই। ডেপুটি স্পিকার করে দিলীপকুমার পালকে রাজনৈতিক সন্ন্যাসে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। রাজদীপ রায়কে ঠিকঠাক বিশ্বাস করতে পারছে না দলীয় নেতৃত্ব। কবীন্দ্র পুরকায়স্থ, কণাদ পুর়কায়স্থকেও রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক করে দিল। পরিমল শুক্লবৈদ্যও কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে। পূর্তমন্ত্রী হিসেবে তাঁর সফল হওয়া কঠিন। ফলে বিজেপি কাকে নেতৃত্বে তুলে আনতে চায়, কাকে দিয়ে কাজ করাতে চায়, সেটা লক্ষ্য রাখতে হচ্ছে।

বিধানসভা ভোটে শিলচরের সাংসদ সবচেয়ে বেশি সরব ছিলেন সর্বানন্দ সোনোয়ালের বিরুদ্ধে। এমনকী, তরুণ গগৈও যখন নিজের প্রতিপক্ষ হিসেবে নরেন্দ্র মোদীকেই তুলে ধরেছিলেন, সুস্মিতাদেবী তখন সর্বানন্দের বিরুদ্ধে ভোট চেয়েছেন। তবু এক মাসের সর্বা-সরকার সম্পর্কে কোনও মন্তব্য করতে চাইলেন না তিনি। বলেন, ‘‘এখনই বলার সময় হয়নি। ভালো করে দেখতে হবে, বুঝতে হবে।’’

হঠাৎই কানে এল মিষ্টি সুরের ঘোষণা, ‘নিরাপদেই আমরা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করলাম। ভেতরের তাপমাত্রা.......বাইরের তাপমাত্রা....।’ না, কোনটা কত বলেছিলেন, মনে রাখা গেল না। মাথায় যে তখন একটাই চিন্তা, কিছুই তো নোট করা হল না। শুধুই আড্ডা হল যে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Sushmita dev
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE