Advertisement
১৬ জুন ২০২৪

সৃষ্টির আনন্দে দুর্গামূর্তি গড়ছেন নূরউদ্দিন, রহিম

শিল্পসৃষ্টির তাগিদে পিছনে পড়ে রইল ধর্ম, অসহিষ্ণুতা, গোঁড়ামো। সেই ছবিই বাস্তব গুয়াহাটির দুই মণ্ডপে। সেখানে নলবাড়ির নূরউদ্দিন আহমেদ আর পশ্চিম মেদিনীপুরের রহিম চিত্রকর সাজিয়ে তোলেন মাতৃমূর্তি।

রাজীবাক্ষ রক্ষিত
গুয়াহাটি শেষ আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০১৬ ০৪:২৭
Share: Save:

শিল্পসৃষ্টির তাগিদে পিছনে পড়ে রইল ধর্ম, অসহিষ্ণুতা, গোঁড়ামো। সেই ছবিই বাস্তব গুয়াহাটির দুই মণ্ডপে। সেখানে নলবাড়ির নূরউদ্দিন আহমেদ আর পশ্চিম মেদিনীপুরের রহিম চিত্রকর সাজিয়ে তোলেন মাতৃমূর্তি।

বিষ্ণুপুর হাইস্কুলের মাঠে বসে প্রায় চার ডজন কারিগরের মূর্তি তৈরির কাজ তদারক করছেন নূরউদ্দিন। তাঁর নেতৃত্বে রাত দিন কাজ করে গুয়াহাটির তিনটি তাবড় থিম পুজোর কাজ শেষ করছেন কারিগরের দল। বিষ্ণুপুর সর্বজনীন দুর্গাপুজো কমিটি, রেহাবাড়ি বিলপাড় আর খ্রিস্টানবস্তি সর্বজনীনের পুজোয় এ বার তাঁর হাতের জাদু নজর কাড়তে চলেছে। বিষ্ণুপুর এ নিয়ে ৬ বার নূরবাবুর উপরই ভরসা রেখেছে।

৫৯ বছরের নূরবাবুর কথায়, ‘‘শিল্পে আবার ধর্ম কিসের? এ তো সৃষ্টির আনন্দ। সকলে এই আনন্দের শরিক হতে পারে না। কপাল ভাল আজ পর্যন্ত কেউ আমার শিল্পের সঙ্গে আমার ধর্মকে গুলিয়ে ফেলেনি।’’

১৯৭৫ সালে লখিমপুর বাজারপট্টি এলাকার পুজোয় ঠাকুর তৈরি করে দু্গ্গা গড়ায় তাঁর হাতেখড়ি। নূরউদ্দিন মেনে নেন, ‘‘প্রথমে টাকার জন্য মূর্তি গড়লেও এখন এটা আমার নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে।’’ ১৯৮৩ সালে প্রথম বার গুয়াহাটি পাড়ি দেন তিনি। ১৯৮৫ সালে গণেশগুড়িতে মূর্তি গড়েন। গোটা রাজ্য এমনকী বাংলাতেও পটুয়াদের পরের প্রজন্ম এই শিল্পে আগ্রহ হারাচ্ছে, কিন্তু নূরবাবুর দুই ছেলে রাজ এবং দীপও বাবার মতোই মূর্তি তৈরিতে হাত লাগিয়েছেন। রাজ ভাল মাইনের চাকরি ছেড়েছেন বাবার সাহায্য করবেন বলে। দীপ ভিজুয়াল কমিউনিকেশনসে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পাওয়ার পরে মূর্তি গড়াতেই মন দিয়েছেন। নূরের মতে, রাজ্যে শিল্পীর অভাব নেই। তবু মণ্ডপ, মূর্তি, আলোকসজ্জায় সব কমিটি বাইরে থেকে শিল্পী আনে।

এ বারের পুজোয় নূরের চমক বিষ্ণুপুরে ৮২ ফুট উঁচু দুর্গা মূর্তি। থিমে থাকছে মাদক বিরোধী বার্তা। অসুরের চেহারায় নূর মাদক বিক্রেতার আদল এনেছেন। থাকছে মাদকের প্রভাবে ভেঙে পড়া মানব শরীরের প্রতিমূর্তি। তাঁর মতে, ‘‘পুজোয় লক্ষাধিক ভক্তের দশজনও যদি আমার থিম দেখে প্রভাবিত হন তাতেই আমি ধন্য।’’ বিলপাড়ের পুজোয় থিম গাছ বাঁচাও, পৃথিবী বাঁচাও। শুধু মূর্তি গড়াই নয়, মূর্তির ভিতরে থাকা দেবীর শক্তিকেও মানেন নূর। তিনি স্বীকার করেন, ‘‘আমি যে শিল্পে নিযুক্ত, সেখানে আধ্যাত্মিকতার বড় স্থান আছে। প্রতিমা তৈরির সময় বা মণ্ডপে আমিও হিন্দুদের রীতিনীতি পুরোপুরি মেনে চলি।’’ বিলপাড় পুজো কমিটি ও বিষ্ণুপুর পুজো কমিটির কর্তাদের বক্তব্য— ‘‘শিল্পী কোন ধর্মের তা নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। আমরা তাঁকে, তাঁর প্রতিভাকে সম্মান করি। তাঁর হাতেই প্রাণ পান মহামায়া। তিনি দেবীর আশীর্বাদধন্য। এই যথেষ্ট।’’

অন্য দিকে, আদাবাড়ির গোকূল নিবাসে পশ্চিম মেদিনীপুরের রহিম চিত্রকর পটচিত্র আঁকা প্রায় শেষ করে এনেছেন। তাঁর বসত নয়াগ্রামে। যে গ্রাম পটের জন্য বিখ্যাত। সেখানকার শিল্পী রহিমের আঁকা পট এবার গোকুল নিবার পুজো কমিটির পুজোয় সেরা আকর্ষণ। পট আঁকার সঙ্গে সঙ্গে রাম-সীতার কাহিনী গেয়েও শোনাচ্ছেন তিনি। রহিম জানান, আগে পটে শুধুই পুরাণকথা গাওয়া হত, কিন্তু এখন সাম্প্রতিক ঘটনাও পটে উঠে আসছে। তাঁর বাবা ৯/১১-র ঘটনাও পটে তুলে ধরে পালা বেঁধেছিলেন। গ্রামের জৈব রঙ এখানে না পেয়ে অ্যাক্রিলিক রঙেই পট আঁকছেন তিনি। সঙ্গে আছেন ছেলে লতিফুল ও বউ লতিফা। রহিম জানান, প্রায় ২০০ বছর আগে স্থানীয় জমিদার তাঁদের পূর্বপুরুষের হাতের কাজে খুশি হয়ে পিঠ চাপড়ে দিয়ে নাম জানতে চান। তখন তাঁদের কোনও পদবী ছিল না। পিঠ চাপড়ানো থেকেই জমিদার তাঁদের 'চাপাড়ি' পদবী দেন। পরে চাপাড়িদের অনেকে চিত্রকর পদবী নিয়ে পট আঁকার কাজ চালিয়ে যান। এখন তাঁদের গ্রামে প্রায় ২০০টি পরিবার এই কাজ করে। গোকূল নিবাস একইসঙ্গে বাংলার কাঠশিল্পী বিজয় সূত্রধরকেও এনেছে। তিনি তৈরি করছেন ২৩৭০টি কাঠের পুতুল। সম্পাদর সঞ্জয় সরকার জানান, পুজোয় মনসুর ফকিরের গান ও ছৌ নাচের আসর থাকবে গোকুল নিবাসে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

durga puja pandal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE