Advertisement
E-Paper

অগ্নি-সুরক্ষায় রেল কেন বারবার ফেল

প্রযুক্তি আসে। পুরনো হয়। আসে নতুনতর প্রযুক্তি। ট্রেনে আগুন লাগার ঘটনা তবু বন্ধ হয় না। কেন? তারিখটা ২০১৫ সালের ২১ এপ্রিল। সময় বিকেল সাড়ে ৪টে। নয়াদিল্লিতে যাত্রীরা নেমে যাওয়ার পরে ভুবনেশ্বর ও শিয়ালদহ দু’টি রাজধানী এক্সপ্রেসকেই নিয়ে যাওয়া হয়েছিল স্টেশন সংলগ্ন কারশেডে।

অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৫ মে ২০১৬ ০৩:৩০

প্রযুক্তি আসে। পুরনো হয়। আসে নতুনতর প্রযুক্তি। ট্রেনে আগুন লাগার ঘটনা তবু বন্ধ হয় না। কেন?

তারিখটা ২০১৫ সালের ২১ এপ্রিল। সময় বিকেল সাড়ে ৪টে। নয়াদিল্লিতে যাত্রীরা নেমে যাওয়ার পরে ভুবনেশ্বর ও শিয়ালদহ দু’টি রাজধানী এক্সপ্রেসকেই নিয়ে যাওয়া হয়েছিল স্টেশন সংলগ্ন কারশেডে। আচমকাই কারশেডের কর্মীরা দেখতে পেলেন, একটি রাজধানী এক্সপ্রেসের কামরার ভিতরে আগুন জ্বলছে। দমকল ডাকতে না-ডাকতেই ছ’টি কামরায় ছড়িয়ে পড়ল আগুন। আমজনতা, রেলকর্মী, দমকলকর্মী—সকলের চোখের সামনে পুরোপুরি ছাই হয়ে গেল ছ’টি কামরাই।

ঘটনার আকস্মিকতায় সকলেই হতবাক। চলন্ত অবস্থায় যাত্রী-ভর্তি ট্রেনে ওই অগ্নিকাণ্ড ঘটলে কী হতো, ভেবে শিউরে উঠছিলেন অনেক প্রত্যক্ষদর্শী। অনেকে আগুনের উৎস হিসেবে শর্ট সার্কিট বা গ্যাস-পেট্রোল-কেরোসিনের মতো দাহ্য পদার্থ বহন এবং জ্বলন্ত স্টোভের উপস্থিতি নিয়ে জল্পনায় মাতেন। এবং রক্ষণাবেক্ষণ বা নজরদারির ত্রুটিতেই ওই সব উৎস বা ইন্ধন থেকে আগুন ছড়িয়েছে বলে রায় দিতে থাকেন। কেউ কেউ প্রশ্ন তোলেন, রাজধানীর মতো নামীদামি ট্রেনেই যদি এই অবস্থা হয়, সাধারণ ট্রেনে নজরদারির উপরে নির্ভর করা যায় কী ভাবে?

প্রশ্নটা শুধু ওই রাজধানীর আগুন নিয়ে নয়। ট্রেনে আগুন লাগলেই ধেয়ে আসে এই রকম প্রশ্নবাণ। কিন্তু তাতে বিদ্ধ হয়ে রেল-কর্তৃপক্ষ সুরক্ষার যথেষ্ট বন্দোবস্ত করেছেন, এমন প্রমাণ এখনও মেলেনি।

যেমন বছর ঘুরে গেলেও মেলেনি রাজধানী এক্সপ্রেসের ওই অগ্নিকাণ্ডের তদন্ত রিপোর্ট। তাই ঠিক কী কারণে কারশেডে যাত্রী-শূন্য ট্রেনে আগুন লেগেছিল, সেটা স্পষ্ট হয়নি। তবে রেলকর্তাদের কাছে এটা মোটামুটি পরিষ্কার যে, শর্ট সার্কিট থেকেই আগুন লেগেছিল রাজধানীতে।

নতুন প্রশ্নের জন্ম সেখান থেকেই। সে-দিন রাজধানীর যে-সব কামরা পুড়ে গিয়েছিল, সেগুলি তৈরি করা হয়েছিল একেবারে নতুন প্রযুক্তিতে। অগ্নি-নিরাপত্তার যাবতীয় ব্যবস্থা ছিল সেই সব কামরায়। তা হলে শর্ট সার্কিট হল কী ভাবে? দেখভাল ঠিকঠাক হলে তো সেটা হওয়ার কথা নয়। তা হলে কি দেখভালেই ভুল? আর শর্ট সার্কিট যদি হয়েই থাকে, আধুনিক প্রযুক্তি সেই বৈদ্যুতিক বিভ্রাট থেকে লাগা আগুনের মোকাবিলাই বা করতে পারল না কেন? রেলের এক শ্রেণির কর্মী-অফিসার কবুল করছেন, প্রশ্নগুলো ট্রেনে আগুন লাগার সব ঘটনার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এবং উত্তর অধরা।

আসলে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার নিয়ে ঢক্কানিনাদ সত্ত্বেও ট্রেনে আগুন লাগার ঘটনা রুখতে পারছেন না রেল-কর্তৃপক্ষ। শেষ পাঁচ বছরে দেশ জুড়ে চলন্ত ট্রেনে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে ২৯টি। তাতে মৃত্যু হয়েছে বেশ কিছু যাত্রীর। রেলের বিপুল সম্পত্তির ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু তার পরেও কী ভাবে ট্রেনগুলিকে আগুন থেকে বাঁচানো যায়, সেই ব্যাপারে তেমন কার্যকর কোনও দিশাই দেখাতে পারছেন না রেল-কর্তৃপক্ষ।

রেলকর্তাদের অনেকেই জানাচ্ছেন, ট্রেনে আগুন লাগে সাধারণত বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে। অথবা ট্রেনে অবৈধ ভাবে নিয়ে যাওয়া জ্বলন্ত কেরোসিন স্টোভ (চা তৈরির জন্য) থেকে। মাঝেমধ্যে না-জানিয়ে নিয়ে যাওয়া গ্যাস সিলিন্ডার বা বাজির মশলা থেকেও আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। তবে তেমন দুর্ঘটনার সংখ্যা খুবই কম। বেশির ভাগ ঘটনাই ঘটেছে ট্রেনে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে।

অসুখ যখন মোটামুটি শনাক্ত হয়েই আছে, দাওয়াই ঠিকঠাক দিলেই তো প্রতিকার হয়। হচ্ছে না কেন?

রেলকর্তাদের একাংশের জবাব, ট্রেনে ঠিকঠাক নজরদারি চালালেই জ্বলন্ত স্টোভ আটকানো সম্ভব। এমনকী অন্যান্য দাহ্য পদার্থ এবং বিস্ফোরক বহনও রুখে দেওয়া অসম্ভব নয়। কিন্তু রেলের কারশেডে ট্রেন পরীক্ষার কাজটা নিয়মিত ঠিকঠাক না-হলে কোনও ভাবেই শর্ট সার্কিট ঠেকানো সম্ভব হবে না। এর জন্য রেলকেই তাদের পরিকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণে জোর দিতে হবে। কর্তাদের এই বক্তব্যে স্পষ্ট, শর্ট সার্কিট আটকানো যায় এবং ‘নিয়মিত ঠিকঠাক’ রক্ষণাবেক্ষণ হয় না। হলে শর্ট সার্কিটের সম্ভাব্য জায়গা চিহ্নিত করে আগাম প্রতিরোধ গড়াই যেত।

রক্ষণাবেক্ষণে উদাসীনতা এবং নজরদারিতে গাফিলতির যুগলবন্দি কী সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে, ২০১২ সালে তামিলনাড়ু এক্সপ্রেসের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডই তার প্রমাণ। গত পাঁচ বছরে ট্রেনে সব চেয়ে বড় আগুন লাগার ঘটনা ওটাই। সেটা ঘটেছিল ওই বছরের ৩০ জুলাই রাতে, অন্ধ্রের নেল্লোরে। চলন্ত অবস্থায় আগুন লেগে ওই ট্রেনের বি-১ এবং বি-২ কামরা দু’টি সম্পূর্ণ পুড়ে যায়। মৃত্যু হয় ৪৭ জনের। আহত হন ২৭ জন।

কী ভাবে লেগেছিল আগুন?

তদন্তে জানা যায়, ওই ট্রেনের লাগেজ ভ্যানে একটি পেট্রোল-ভর্তি মোটরসাইকেল নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। কোনও শর্ট সার্কিট থেকে প্রথমে আগুন লাগে। পরে লাগেজ ভ্যানের বাইকটি পড়ে যাওয়ায় তা থেকে তেল বেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ে। সেই তেলের ইন্ধনে আগুন দ্রুত গ্রাস করে দু’টি কামরা। তাতেই মৃত্যু হয় যাত্রীদের।

শর্ট সার্কিট আর ওই তেল-ভর্তি মোটরসাইকেল থেকেই প্রশ্নের আঙুল উঠছে দেখভালের ত্রুটি, নজরদারিতে ফাঁকি এবং রেলের এক শ্রেণির কর্মী-অফিসারের দুর্নীতির দিকে। প্রথমত, ট্রেনে দাহ্য বস্তু বহন তো নিষিদ্ধ। তা হলে লাগেজ ভ্যানে পেট্রোল-ভরা মোটরসাইকেল তুলল কে বা কারা? নিয়মবিধির তোয়াক্কা না-করে রেলের কিছু কর্মী-অফিসারই যে কাজটা করেছেন, সেই বিষয়ে সন্দেহ নেই রেলেরই অন্য কিছু কর্মী-অফিসারের। দ্বিতীয়ত, যাঁরা নজরদারির দায়িত্বে ছিলেন, লাগেজ ভ্যানে আস্ত বাইকটি সেই রেলকর্মীদের চোখ এড়িয়ে গেল কী ভাবে? তৃতীয়ত, প্রতিটি সফরের পরে দূরপাল্লার ট্রেনে বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা-সহ সব কিছু খুঁটিয়ে দেখা যাঁদের কাজ, সম্ভাব্য শর্ট সার্কিটের জায়গাটা সেই রেলকর্মীদের চোখে পড়ল না কেন?

জবাব মিলছে না। তবে সম্প্রতি সংসদে এক প্রশ্নোত্তর পর্বে রেল প্রতিমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন, ট্রেনে আগুন ঠেকাতে নতুন কয়েকটি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কী সেই ব্যবস্থা?

• কামরায় বসানো হবে এমসিবি অর্থাৎ মিনিয়েচার সার্কিট ব্রেকার। শর্ট সার্কিটের আশঙ্কা দেখা দিলেই যে-যন্ত্রাংশ বিদ্যুৎ সরবরাহ বিচ্ছিন্ন করে দেবে।

• প্রতিটি ক্ষেত্রে থাকবে তিন বা চার স্তরের সুরক্ষা ব্যবস্থা।
• সব কামরায় অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র রাখা হবে।

• ঢেলে সাজা হবে যন্ত্রপাতি-সহ বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা।

• কামরায় বসানো হবে ‘স্মোক ডিটেকশন (আগুন বা ধোঁয়ার ইঙ্গিতবাহী) অ্যালার্ম’।

• ট্রেনের জেনারেটর কামরায় থাকবে জলঝর্না।

• গ্যাস ও আগুনের ব্যবহার যেখানে হয়, সেই প্যান্ট্রিকারে থাকবে বিশেষ নজরদারি।

• ট্রেনে দাহ্য পদার্থ বহন রুখতে বিশেষ প্রচার চালানো হবে।

প্রশ্ন উঠছে, এর বেশির ভাগই তো পুরনো ব্যবস্থা। এত দিন সেগুলো নেওয়া হয়নি কেন? যে-সব ক্ষেত্রে নেওয়া হয়েছে, সেখানে কাজই বা হচ্ছে না কেন? প্রশ্নটা শুধু যাত্রিসাধারণের নয়, রেলের অনেক কর্মী-অফিসারেরও। কিন্তু জবাব দেওয়ার কেউ নেই বা যাঁরা আছেন, তাঁরা নিয়েছেন নীরবতার পথ।

আর মন্ত্রীর এই অগ্নি-দাওয়াইয়ের ব্যবস্থাপত্র দেখে রেলকর্তাদের একাংশের প্রতিক্রিয়া, ‘এ-সবই উত্তম প্রস্তাব। কিন্তু ক’বছরের মধ্যে ওই সব প্রস্তাব রূপায়ণ করা হবে, মন্ত্রী তার সময়সীমাটাও ধার্য করে দিন।’

অর্থাৎ না-আঁচালে বিশ্বাস রাখতে পারছেন না রেলকর্তারাও!

Fire Railway transport Passengers accident
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy