Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

অ্যাসিডে মুখই পুড়েছে, পোড়েনি জীবন

তীব্র অ্যাসিডে রক্ত-মাংস পুড়িয়ে দিয়ে প্রতিহিংসা মেটাতে চেয়েছিল কিছু লোক। কিন্তু মেয়েদের অপরিসীম প্রাণশক্তির কাছে আক্রমণকারীরা ক্রমশ হেরে যাচ্ছে। ধুমধাম করে বিয়ের পর সংসার পাতছেন এই মেয়েরা। কেউ আবার সুখে আছেন ভালবাসার মানুষের সঙ্গে লিভ-ইন সম্পর্কে। সোশ্যাল নেটওয়ার্কে, পরিচিত মহলে, সামাজিক অনুষ্ঠানে খোলাখুলি প্রকাশ করছেন সেই সম্পর্কের কথা। চেহারা নষ্ট করতে পারলেই একটি মেয়েকে জীবন্মৃত করে দেওয়া যায় এই চালু ধারণা ওলটপালট করে দিচ্ছেন তাঁরা।

বিয়ের দিন স্বামীর পাশে অর্চনা।

বিয়ের দিন স্বামীর পাশে অর্চনা।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ জুলাই ২০১৪ ০৩:৫৩
Share: Save:

তীব্র অ্যাসিডে রক্ত-মাংস পুড়িয়ে দিয়ে প্রতিহিংসা মেটাতে চেয়েছিল কিছু লোক। কিন্তু মেয়েদের অপরিসীম প্রাণশক্তির কাছে আক্রমণকারীরা ক্রমশ হেরে যাচ্ছে। ধুমধাম করে বিয়ের পর সংসার পাতছেন এই মেয়েরা। কেউ আবার সুখে আছেন ভালবাসার মানুষের সঙ্গে লিভ-ইন সম্পর্কে। সোশ্যাল নেটওয়ার্কে, পরিচিত মহলে, সামাজিক অনুষ্ঠানে খোলাখুলি প্রকাশ করছেন সেই সম্পর্কের কথা। চেহারা নষ্ট করতে পারলেই একটি মেয়েকে জীবন্মৃত করে দেওয়া যায় এই চালু ধারণা ওলটপালট করে দিচ্ছেন তাঁরা।

ছ’বছর আগে এক জনের ছুড়ে দেওয়া অ্যাসিডে মুখ, গলা, ঘাড়, হাত দলা পাকিয়ে মাংসপিণ্ডে পরিণত হয়েছিল উত্তরপ্রদেশের বুলন্দশহরের অর্চনা ঠাকুরের। বাঁ চোখ চিরকালের মতো নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তাঁর বয়স তখন মাত্র ১৮। দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ছিলেন। গত ১৪ মে ফরিদাবাদে পেশায় চিকিৎসক রোহিত সিংহের সঙ্গে ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে গেল তাঁর। এখন মথুরার কোশীতে স্বামী আর শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দের সঙ্গে হইহই করে দিন কাটাচ্ছেন তিনি।

আবার দিল্লির মেয়ে ২৪ বছরের লক্ষ্মী লিভ-ইন সম্পর্কে রয়েছেন প্রেমিক আলোক দীক্ষিতের সঙ্গে। ২০০৫ সালে ১৫ বছরের লক্ষ্মীকে ভরা বাজারে অ্যাসিড ছুড়েছিল দুই যুবক। মুখের সব চামড়া গলে গিয়েছিল লক্ষ্মীর। তাঁরও একটি চোখ নষ্ট হয়েছিল। এখন তাঁরা দু’জনে অ্যাসিডে পুড়ে যাওয়া মহিলাদের অধিকারের জন্য আন্দোলন করছেন, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন চালাচ্ছেন।

শেষ পর্যন্ত অর্চনা বা লক্ষ্মীর জীবন অ্যাসিডে ছারখার করা যায়নি। লক্ষ্মীর কথায়, “জীবনকে আমরা আলিঙ্গন করেছি। সহজে ছাড়ব না।” আর গলায় একরাশ হাসি নিয়ে টেলিফোনে অর্চনা বলেন, “ঈশ্বর তাঁকেই কষ্ট দেন যাঁর তা সওয়ার ক্ষমতা রয়েছে। এক জন পুরুষ আমার জীবন অ্যাসিডে পুড়িয়ে দিয়েছিল, আর এক জন পুরুষের হাত ধরে আমি জীবনে ফিরেছি।”

অর্চনা, লক্ষ্মীদের দেখে উচ্ছ্বসিত নারী আন্দোলন কর্মী শাশ্বতী ঘোষ। তাঁর মতে, মেয়েদের দৈহিক সৌন্দর্য নিয়ে সমাজের অদ্ভুত মোহ রয়েছে। অনেককেই দেখা যায় কোনও কারণে মুখ বা ত্বক নষ্ট হয়েছে বলে নিজেকে ঘরের কোণে আটকে ফেলেন। কিন্তু অ্যাসিডে মুখ পুড়ে যাওয়ার পরেও কুণ্ঠা, দ্বিধা ভেঙে মেয়েরাও যে সম্পর্কে জড়ানোর মতো মনের দৃঢ়তা দেখাচ্ছেন সেটা অভাবনীয়। “যারা মনে করত একটি মেয়ের মুখ ক্ষতবিক্ষত করে দিলেই তাঁর দুনিয়া অন্ধকার করে দেওয়া যাবে, তারা এ বার কী করবে?” মন্তব্য শাশ্বতীর।

একই ভাবে প্রশংসিত ভালবাসার পুরুষটির ভূমিকাও। সমাজতত্ত্ববিদ রামানুজ গঙ্গোপাধ্যায় অবশ্য এও মনে করিয়ে দিচ্ছেন, “সমাজের দৃষ্টিভঙ্গীতে একটা ইতিবাচক পরিবর্তন হচ্ছে সেটা নিশ্চিত। কিন্তু এমনও হতে পারে যে পুরুষ বিয়ে করছে, সে এখন প্রচুর বাহবা পাচ্ছে বলে অসুবিধা হচ্ছে না। কয়েক বছর পরে যদি তাঁর মনে হয়, অ্যাসিড-আক্রান্তকে বিয়ে করে আখেরে জীবন নষ্ট হল, তখন কী হবে?”

এই আশঙ্কায় অবশ্য অর্চনা-রোহিতরা আশঙ্কিত নন। বুলন্দশহরে অর্চনাদের বাড়ির উল্টে দিকে থাকত অনিল নামে এক যুবক। অর্চনা জানান, অনেক দিন থেকেই তাঁকে কুপ্রস্তাব দিত সে। তিনি বাবা-মাকে বিষয়টা জানালে তাঁরাও অনিলকে হুঁশিয়ারি দেন। ২০০৮ সালের নভেম্বরের এক বিকেলে আচমকা কোল্ড ড্রিঙ্কের বোতলে অ্যাসিড ভরে অর্চনাদের বাড়িতে ঢুকে পড়ে অনিল। অর্চনা রান্নাঘর থেকে চা নিয়ে আসছিলেন। তাঁর মুখে ওই অ্যাসিড ছুড়ে দিয়ে অনিল আত্মহত্যা করে।

এখনও পর্যন্ত ৩২টি অস্ত্রোপচার হয়েছে অর্চনার। পেশায় কৃষক অর্চনার বাবা রোহিত সিংহ কপর্দকশূন্য হয়ে পড়েছিলেন। এত কিছুর পরেও ঘুরে দাঁড়ানোর আশা ছাড়েননি অর্চনা। চাকরির চেষ্টা করছেন। এরই মধ্যে এক পারিবারিক অনুষ্ঠানে পরিচয় হয় বড় পিসির মেয়ের দেওর রোহিতের সঙ্গে। নষ্ট হওয়া চেহারা কিন্তু অর্চনা-রোহিতের সম্পর্কে বাধা হয়নি। বাধা হননি রোহিতের পরিবারের লোকেরাও। ১৪ মে বিয়ের দিন বিশেষ মেকআপ করেছিলেন অর্চনা। লাগিয়েছিলেন পাথরের চোখ। জানান, শ্বশুরবাড়িতে এখনও পর্যন্ত কেউ এক বারও তাঁর চেহারা নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি। তাঁর ভয় ছিল, বাড়ির বাচ্চারা হয়তো মুখ দেখে ভয়ে তাঁর কাছে আসবেন না। তা-ও ভুল প্রমাণিত হয়েছে। সব্বাই এখন তাঁর ন্যাওটা।


প্রেমিকের সঙ্গে লক্ষ্মী।

ধীর-স্থির-হাসিমুখের অর্চনা এখন ব্যস্ত রোহিতের নতুন চেম্বার সাজানো নিয়ে। স্বভাবগম্ভীর রোহিত দৃঢ় গলায় বলেন, “সবার মুখ তো বন্ধ করা যায় না। কিছু আত্মীয়স্বজন বলাবলি করেছে, আমি প্রচুর টাকা নিয়ে অর্চনাকে বিয়ে করেছি। তা না হলে কেউ অ্যাসিডে ক্ষতবিক্ষত মেয়েকে বিয়ে করে না। আমি এই সব আলোচনার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। গায়ে মাখিনি।” বলেন, “আমার প্রধান লক্ষ্য এখন অর্চনাকে আনন্দে রাখা। কী অমানুষিক কষ্ট ও পেয়েছে, আমরা কেউ ভাবতেও পারব না। ওর মনের জোরকে আমি শ্রদ্ধা করি। আর ওর মতো সুন্দর মনের মেয়ে আমি আর পেতাম না।”

অনেকটা একই কথা বলছিলেন আলোক। অ্যাসিড আক্রান্তদের দাবি নিয়ে আন্দোলন করতে গিয়ে সাংবাদিক আলোকের পরিচয় দিল্লির লক্ষ্মীর সঙ্গে। ন’বছর আগে দিল্লির এক বইয়ের দোকানে কাজ করতেন লক্ষ্মী। সেখানেই ৩২ বছরের এক ব্যক্তির সঙ্গে আলাপ হয়। লোকটি প্রেম নিবেদন করে। প্রত্যাখ্যান করেছিলেন কিশোরী লক্ষ্মী। তার পর এক বিকেলে কেনাকাটা করতে বেরিয়েছেন। রাস্তায় তাঁর দিকে অ্যাসিড ছুড়ে দিয়েছিল সেই লোক। লক্ষ্মীর কথায়, “দীর্ঘ একটা সময় পুরুষদের আমি ঘৃণা করতাম, ভয় পেতাম। আলোক আমার জীবনে আসার পর মানুষের প্রতি বিশেষ করে পুরুষদের প্রতি বিশ্বাস ফিরে পেয়েছি। অন্য আক্রান্তদের এখন বোঝাই, এক জন তোমার জীবন পোড়াতে চেয়েছে মানেই পৃথিবীর সবাই খারাপ নয়।” আর আলোকের বক্তব্য, “লক্ষ্মী আর আমার পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ আমাদের ভালবাসার ভিত। আমার জীবন পানসে ছিল। তাতে নতুন রং নিয়ে এসেছে লক্ষ্মী। আমার কাছে ও পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী মহিলা।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

parijat bandyopadhyay acid attack
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE