—ফাইল চিত্র।
অযোধ্যাকাণ্ডের ক্ষত শুকোতে না শুকোতেই বোম্বাই শহরে এ আবার কী তাণ্ডব শুরু হল! বাসের এক প্রৌঢ় যাত্রী ভাঙা রেকর্ডের মতো থেকে থেকেই এই কথাটি বলছিলেন। অন্যান্য যাত্রীর আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল একই। কারণ স্টক এক্সচেঞ্জ বিল্ডিং, সেঞ্চুরি বাজার, ওরলি, দাদার এবং মসজিদ বন্দরের বোমা বিস্ফোরণের খবর ততক্ষণে পৌঁছে গিয়েছে সকলেরই কানে। কিন্তু কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই আরও একটি ভয়াবহ বিস্ফোরণ যে ঘটতে চলেছে, সে কথা কেউ কল্পনাও করতে পারেননি। চার্চগেট স্টেশন থেকে বাসটি নরিমান পয়েন্টে ঢোকার মুখেই শোনা গেল সেই বিকট শব্দ। কেঁপে উঠল পুরো বাস।
ঘড়িতে তখন বেলা পৌনে তিনটে। দুশো গজ দূরেই এয়ার ইন্ডিয়ার সদর দফতর। বিস্ফোরণটা যে সেখানেই ঘটেছে, বুঝতে কারও অসুবিধে হল না। কারণ সেখান থেকে শয়ে শয়ে ভয়ার্ত মানুষ ছুটে চলেছেন নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। প্রায় প্রত্যেকে ক্ষতবিক্ষত। কারও মাথা ফেটে চৌচির। রক্ত ঝরছে কারও কান থেকে, কারও হাত থেকে। তাও পড়িমরি করে সবাই ছুটছেন। কোথায় নিরাপদ আশ্রয়? কেউ জানেন না। চল্লিশোর্ধ এক বিদেশিকে দেখা গেল রাস্তায় শুয়ে ছটফট করতে। বাস থেকে নামতেই ছবিটা আরও পরিষ্কার হল।
এয়ার ইন্ডিয়ার প্রবেশদ্বারে তখনও দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। বিস্ফোরণ ঘটেছে বিশতলা বিল্ডিং-এর একেবারে উপরতলায়। আশপাশের অফিস থেকে অনেকেই এসে পড়েছেন সাহায্যের জন্য। এয়ার ইন্ডিয়া বিল্ডিং-এর দুশো গজ দূরে মহারাষ্ট্র সরকারের মন্ত্রণালয়। বিস্ফোরণের শব্দ মন্ত্রীদের কানেও পৌঁছেছে।... আগুনে ঝলসে যাওয়া দেহ দেখে চেনার কোনও উপায় নেই। কোনটি পুরুষের, কোনটি মহিলার শনাক্ত করা কঠিন...
এয়ার ইন্ডিয়া বিল্ডিং থেকে একটি একটি করে দগ্ধ দেহ বাইরে আনা হতে থাকল। মিনিট কয়েক পরেই এক পুলিশকর্মী বিল্ডিং-এর ভিতর থেকে বেরিয়ে এলেন। তাঁর হাতে একটি ঝলসানো পা। একটু দূর থেকে যাঁরা এতক্ষণ দাঁড়িয়ে সব দেখছিলেন, তাঁরা আচমকা আঁতকে উঠলেন। দেখা গেল, দু’জন পুলিশ একটি মাথা হাতে করে বেরিয়ে আসছেন।... শেষ অবধি হয়তো এই পা এবং মাথার সংখ্যা গুনেই মৃতের হিসেব জানা যাবে।
... বোম্বাই পুলিশের যুগ্ম কমিশনার এম এন সিংহ উদ্বিগ্ন জনতাকে কিছুটা শান্ত করেই আসরে নেমে পড়লেন। একটু দূরেই জীবন বিমার সদর দফতরের সামনে দাঁড়িয়ে পুলিশের আর এক বড় কর্তা তখন মারাঠি, হিন্দি এবং ইংরেজিতে ঘন ঘন ঘোষণা করে যাচ্ছেন। ‘যাঁরা দেশের এই বিপদের মুহূর্তে নিজের ভাই, বোন বা আত্মীয় মনে করে আহতদের জীবন বাঁচানোর জন্য রক্ত দিতে চান। তাঁরা নির্দিষ্ট গাড়িগুলিতে চটপট উঠে পড়ুন। মনে রাখবেন, এই মুহূর্তে আপনার এক বোতল রক্ত একটি মানুষকে বাঁচিয়ে তুলতে পারে।’ সামনে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িগুলির কাছে মুহূর্তের মধ্যে ভিড় জমে যায়। কুড়ি বছরের তরতাজা যুবক থেকে শুরু করে ষাট বছরের প্রৌঢ়— কে নেই সেই লাইনে। কিছু গাড়ি আহতদের নিয়ে দ্রুত রওনা হল হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। তার পিছন পিছন রওনা দিল রক্তদাতাদের গাড়ি। পুলিশের গাড়িতে সকলের জায়গা হচ্ছিল না দেখে অনেকে নিজের গাড়ি করেই আহতদের পৌঁছে দিতে গেলেন হাসপাতালে।
এ রকমই একজন, আসলাম মার্চেন্ট। বয়স পঞ্চাশের উপর। আহতদের হাসপাতালে পৌঁছে দিতে নিজের দু’টি গাড়ি নিয়ে হাজির হয়েছেন সেখানে।... বিস্ফোরণস্থলের কিছুদূরে কয়েকজন ডাক্তার এবং নার্স প্রাথমিক চিকিৎসাকেন্দ্র খুলে বসেছেন। যাঁদের আঘাত ততটা গুরুতর নয় প্রাথমিক চিকিৎসার পরেই তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে।...
এয়ার ইন্ডিয়া বিল্ডিং-এর ঠিক গায়ে গায়েই সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের অফিস। বিস্ফোরণের ধাক্কায় ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছে সেই অফিস। সেই ধ্বংসস্তূপের সামনে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন অফিসের বত্রিশ বছরের একজিকিউটিভ নিল।... বিস্ফোরণের কথা তুলতেই নিল বললেন, ‘শুধু একটা বিকট শব্দ। টাইপরাইটারটা মাথায় এসে পড়ল। ব্যস আর কিছু মনে নেই।’ শহরতলি মালাড এলাকা থেকে খবর পেয়েই নরিম্যান পয়েন্টে চলে এসেছেন ষাট বছরের এক প্রৌঢ়। তাঁর ত্রিশ বছরের ছেলে জীবিত না মৃত, তখনও তা তাঁর জানা নেই। পুলিশের ইউনিফর্ম পরা কাউকে দেখলেই বৃদ্ধ তাঁর হাতে পায়ে ধরছেন। তাঁর মতো অনেকেই ছুটে এসেছেন নিজের ছেলে বা মেয়ের খোঁজ নিতে।...
বিস্ফোরণে মোট কতগুলি অফিসের ক্ষতি হয়েছে, তার পুরো হিসাব পেতে হয়ত দু-এক দিন সময় লেগে যাবে। এয়ার ইন্ডিয়ার আশেপাশের সব কটি অফিসই যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত।...
এয়ার ইন্ডিয়া বিল্ডিং-এর কাছ থেকে ভিড় যখন ক্রমশ পাতলা হয়ে আসছে, ঠিক সেই সময়ে খবর এল— জাভেরি বাজার, প্লাজা সিনেমা, সিরক হোটেলেও বিস্ফোরণ ঘটেছে। মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল কথাটা। বহুতল ভবনগুলি থেকে হুড়মুড়িয়ে নেমে আসতে লাগলেন সমস্ত কর্মী। দাঁড়িয়ে পড়লেন রাস্তার উপর। ভাবখানা যেন, আর নয়, এখনই বাড়ি ফিরতে হবে। নরিম্যান পয়েন্ট যেন আর নিরাপদ নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy