Advertisement
১৬ মে ২০২৪

মানসিক ভাবে আমরা সুস্থ তো? নাকি মনুষ্যত্ব বলে আর কিছু নেই?

‘মন ভাল নেই, মন ভাল নেই, মন ভাল নেই। কেউ তা বোঝে না, সকলই গোপন, মুখে ছায়া নেই। চোখ খোলা, তবু চোখ বুজে আছি...’ কবির এই পঙ্‌ক্তিগুলো আজ মনে পড়ছে খুব। মনটা সত্যিই ভাল নেই। কারণ, মনটাই বোধ হয় আর নেই।

ভিডিও ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, মতিবুলকে ধাক্কা মারে একটি ভ্যান।

ভিডিও ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, মতিবুলকে ধাক্কা মারে একটি ভ্যান।

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১২ অগস্ট ২০১৬ ০৩:১৬
Share: Save:

‘মন ভাল নেই, মন ভাল নেই, মন ভাল নেই।

কেউ তা বোঝে না, সকলই গোপন, মুখে ছায়া নেই।

চোখ খোলা, তবু চোখ বুজে আছি...’

কবির এই পঙ্‌ক্তিগুলো আজ মনে পড়ছে খুব। মনটা সত্যিই ভাল নেই। মাঝে-মধ্যে মনে হচ্ছে, মনটাই বোধ হয় আর নেই।

মন বলে কিছু অবশিষ্ট থাকলে মতিবুলের সঙ্গে এমনটা ঘটতে পারত আদৌ? উত্তর দিনাজপুরের মানুষ। কর্মসূত্রে দিল্লিতে থাকতেন। নাইট ডিউটি সেরে ভোরের রাজপথ ধরে ফিরছিলেন বাসার দিকে। পিছন থেকে অনিয়ন্ত্রিত বেগে আসা গাড়ি জোর ধাক্কা মেরে মতিবুলকে ছিটকে দিল পথের ধারে। গুরুতর জখম হয়েছিলেন ঠিকই। কিন্তু মতিবুল তখনও জীবন থেকে ছিটকে যাননি। রক্তাক্ত, বিধ্বস্ত শরীরে কাতরাচ্ছিলেন। পরবর্তী দেড় ঘণ্টায় যে নিদারুণ ঔদাসীন্য দেখা গেল আমাদের মধ্যে, তাতে জীবন থেকে ছিটকে যাওয়া ছাড়া মতিবুলের আর কিছু করার ছিল না। কিম্বা বাঁচার সুযোগ থাকলেও বিতৃষ্ণাতেই হয়তো আর বাঁচতে চাইতেন না মতিবুল।

সিসিটিভিতে দেখা গেল, ঘাতক গাড়ির চালক এক বার নামলেন। মতিবুলের অবস্থা দেখার উৎসাহ খুব বেশি ছিল না। নিজের গাড়ির কোনও ক্ষতি হয়েছে কি না, দেখে নিলেন ঝলকে। তার পর গাড়ি নিয়ে সরে পড়লেন।

ধরে নিলাম, ঘাতক গাড়ির চালক ভয়ে সরে পড়েছেন। কিন্তু তাঁর পরে যাঁরা ওই পথ গিয়ে এলেন-গেলেন, তাঁরা কী করলেন? যে দেড় ঘণ্টা রাস্তার ধারে কাতরাতে কাতরাতে মতিবুল অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের জেরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন, সেই দেড় ঘণ্টায় দ্বিশতাধিক গাড়ি বেরিয়ে গিয়েছে মতিবুলের পাশ দিয়ে। ডজন ডজন পথচারী হেঁটে গিয়েছেন মতিবুলের পাশ দিয়ে। পুলিশের আপৎকালীন সেবাযানও গিয়েছে মতিবুলের পাশ দিয়ে। সকলেই দেখেছন, রক্তাক্ত অবস্থায় এক জন মানুষ রাস্তার ধারে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। কিন্তু কেউ এগিয়ে যাননি।

এ কোনও স্বাভাবিক ঘটনা নয়। আমরা যদি স্বাভাবিক মানসিক স্থিতিতে থাকি, তা হলে সহ-নাগরিককে চোখের একদম সামনে এমন মর্মান্তিক ভাবে মরতে দেখে হঠাৎ উদাস হয়ে বেরিয়ে যেতে পারি না কিছুতেই। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে সে রকমই আমরা করলাম। আজ দিল্লিতে হতে দেখছি, গতকাল কলকাতাতেও এই রকম ঘটনা ঘটতে দেখেছি। আগামিকাল হয়তো মুম্বই, বেঙ্গালুরু, চেন্নাই বা হায়দরাবাদেও এরই পুনরাবৃত্তি দেখব।

আমরা যে দিন দিন অস্বাভাবিক হয়ে উঠছি, মনটা যে আর নেই, থাকলেও যে পুরোপুরি ভারসাম্যে নেই, তা কিন্তু আমাদের দেখে বোঝা যায় না। রোজ সকালে নিয়মমতো আমরা হাজারে হাজারে, লাখে লাখে, কোটিতে কোটিতে কর্মস্থলে যাই। কাজ সেরে নিয়মমতোই বাড়ি ফিরি। জীবন নিয়ে নানা স্বপ্ন দেখি। সপ্তাহান্তে পরিজনদের নিয়ে, ঘনিষ্ঠদের নিয়ে বিলাসী সময়ে ডুব দিতে চাই। আমাদের চালচলন, কথাবার্তা, সাজপোশাক, আচার-আচরণ দেখে সবাই ভাবে আমরা স্বাভাবিক, সুস্থ। কেউ বোঝে না, ভিতরে সাংঘাতিক একটা জিনিস নেই— মনটা আর নেই।

কবি স্বাভাবিক ভাবেই অনেক আগে টের পেয়েছিলেন এই অসুস্থতাটা। বলেছিলেন, ‘...কেউ তা বোঝে না, সকলই গোপন, মুখে ছায়া নেই।’ বলেছিলেন, ‘...চোখ খোলা, তবু চোখ বুজে আছি।’

এই রকমই কি চলতে থাকবে? আশপাশের জগতটা কি এমনই নির্মম, নিষ্ঠুর, উদাসীন হয়ে উঠবে ক্রমে? কেউ কারও বিপদে এগিয়ে যাব না আর? খোলা চোখেও চোখ বুজে থাকব? এর নাম সভ্যতা? এর নাম অগ্রগতি? নিজের জীবনে এত মগ্ন আমরা, এতই আত্মকেন্দ্রিক যে জীবন-মরণের সীমান্তে পড়ে কাতরাতে থাকা সহ-নাগরিকের দিকেও সাহায্যের হাতটা বাড়িয়ে দেব না?

তবু আশা ছাড়ছি না। মনুষ্যত্ব মুছে গিয়েছে এ সভ্যতা থেকে, এমনটা ভাবছি না। মনুষ্যত্বের একটা দারুণ নমুনা শীঘ্রই কোথাও চোখে পড়বে, আশায় আশায় থাকছি। আর কবির পঙ্‌ক্তিগুলো আবার আওড়াচ্ছি মনে মনে— ‘...প্রতি দিন কাটে, দিন কেটে যায়/ আশায় আশায়, আশায় আশায়, আশায় আশায়।/ ...আমিও মানুষ! আমার কী আছে, অথবা কী ছিল?/ আমার কী আছে, অথবা কী ছিল?/ ফুলের ভিতরে, বীজের ভিতরে, ঘুনের ভিতরে, যেমন আগুন/ আগুন আগুন, আগুন আগুন, আগুন আগুন...।’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

anjan bandyopadhyay death on a road in Delhi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE