Advertisement
E-Paper

এই কাজে আরও শক্ত হবে মৌলবাদীদের হাত

শুনেছি দেশভাগের সময়ে বাংলাদেশে ঠিক করা হয়েছিল, যাঁরা স্কুল-কলেজ চালাচ্ছেন তাঁদের অন্য কোথাও যেতে দেওয়া হবে না। বলা হয়, সমস্ত নিরাপত্তা দেওয়া হবে। শিক্ষক-শিক্ষিকারা যেন থেকে যান। মাকে একটি বন্দুক দেওয়া হয়েছিল। স্কুলের সামনে মোতায়েন করা হয়েছিল রক্ষী। কিন্তু ওই অশান্ত সময়ে অতগুলি মেয়ের দায়িত্ব ছিল মায়ের কাঁধে।

সুনন্দা শিকদার (লেখক)

শেষ আপডেট: ০৩ অগস্ট ২০১৮ ০২:৩৯
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে শহরে এক উদ্বাস্তু পরিবার। ফাইল চিত্র

মুক্তিযুদ্ধের সময়ে শহরে এক উদ্বাস্তু পরিবার। ফাইল চিত্র

দেশভাগের কথা আমি শুনেছি অন্যদের মুখে। আমি তো জন্মেছি দেশভাগের চার বছর পরে। মা চাকরি করতেন বলে প্রথমে বাংলাদেশে পিসিমার কাছে বড় হচ্ছিলাম। পরে আমার পরিবার এখানে নিয়ে আসে। তাই আমার বাংলাদেশ থেকে চলে আসা ব্যক্তিগত কারণে। তবে বাধ্য হয়ে পালিয়ে আসার অভিজ্ঞতা রয়েছে আমার বাড়ির সদস্যদের। আমার মা-বাবা, ভাই-বোনেরা দেশভাগের পরে ভারতে চলে এসেছিলেন। ওঁদের খুব কষ্ট পেয়ে পালিয়েই আসতে হয়েছিল। আমার মা ময়মনসিংহের একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন। আর উল্টো দিকের স্কুলটির প্রধান শিক্ষক ছিলেন আমার বাবা। মা হস্টেলের সুপার ছিলেন, তাই পাশেই ছিল কোয়ার্টার্স।

শুনেছি দেশভাগের সময়ে বাংলাদেশে ঠিক করা হয়েছিল, যাঁরা স্কুল-কলেজ চালাচ্ছেন তাঁদের অন্য কোথাও যেতে দেওয়া হবে না। বলা হয়, সমস্ত নিরাপত্তা দেওয়া হবে। শিক্ষক-শিক্ষিকারা যেন থেকে যান। মাকে একটি বন্দুক দেওয়া হয়েছিল। স্কুলের সামনে মোতায়েন করা হয়েছিল রক্ষী। কিন্তু ওই অশান্ত সময়ে অতগুলি মেয়ের দায়িত্ব ছিল মায়ের কাঁধে। বন্দুক হাতে থাকলেই তো আর নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় না। হস্টেল আক্রান্ত হলে কী করবেন, তা ভেবে মা ভয় পেয়ে যান। গোপনে মা হস্টেলের মেয়েদের অভিভাবকদের চিঠি পাঠান। অনুরোধ করেন, যেন তাঁরা মেয়েদের নিয়ে যান। এর পরে মা পালিয়ে আসার ব্যবস্থা করেন। বারো, সাত আর তিন বছরের তিন মেয়েকে নিয়ে খিড়কির দরজা দিয়ে বেরিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে চেপে কোয়ার্টার্স ছেড়ে চলে আসেন। তার পরে গাড়ি বদলে বদলে পৌঁছন ঢাকা পর্যন্ত। কোনও ছাত্র-ছাত্রীকে দিয়েই হয়তো বিমানের টিকিট কাটিয়ে রেখেছিলেন। বিমানে চেপে মা কলকাতা চলে আসেন। এই পালিয়ে আসার ফলে আমার মায়ের সংসার রয়ে গেল বাংলাদেশে। তখন তো শিক্ষকদের মাইনে বেশি ছিল না। তা-ও কষ্ট করে সাজানো জীবন, আলমারি ভর্তি বই রয়ে গেল ময়মনসিংহে। রয়ে গেলেন আমার বাবা, দাদারাও। পরে অবশ্য বছরখানেকের মধ্যেই চলে এসেছিলেন সকলে।

আমার মা-বাবার মতো যাঁরা ভিটেমাটি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন, তাঁদের একটাই কথা মনে হতে পারে— একবার তো ছেড়েছি, আবার যদি সেই কষ্ট পেতে হয়? যদি এর পরে বিজেপি বলে, যাঁরা ১৯৪৭-এর পরে ভারতে এসেছেন তাঁদেরও চলে যেতে হবে? তা হলে তাঁরা যাবেন কোথায়? বাংলাদেশ তো তাঁদের ফিরিয়ে নেবে না। তবে বিষয়টি এত দূর গড়াবে বলে আমার মনে হয় না। এখনও সেই আশঙ্কা আমার মনে ঢোকেনি। তবে একটা অস্বস্তি তো থেকেই গেছে।

অসমে নাগরিকপঞ্জি তৈরির ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে, ১৯৭১-এর ২৫ মার্চের আগে থেকে যাঁরা সেখানে বসবাস করছেন, তাঁরা ও তাঁদের উত্তরসূরীদের নাগরিকত্ব পেতে কোনও অসুবিধা নেই। তবে এ ক্ষেত্রে তাঁদের প্রামাণ্য নথি দেখাতে হবে। এই শর্ত কি দরিদ্র, নিরক্ষর ভারতবাসীর উপর চাপানো চলে? মুসলমানেরা প্রধানত এসেছিলেন খেতমজুর বা শ্রমিকের কাজ নিয়ে। তাঁরা বংশানুক্রমে এই কাজই দীর্ঘদিন করে আসছেন। এই কাজ থেকে তাঁদের যেমন গ্রাসাচ্ছাদন হয়েছে, তেমনই তাঁরা দেশের উৎপাদনে অংশ নিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে কত শতাংশ লেখাপড়া শিখে নিজের নাগরিকত্ব প্রমাণের নথি দেখানোর মতো যোগ্যতা অর্জন করেছেন? যদি একটু মানবিকতা ও সহানুভূতি নিয়ে এঁদের কথা ভাবা হয়, তা হলেই বোঝা যাবে এঁরা নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে কতখানি অপারগ। এই অমানবিক সমস্ত সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে সীমান্তরক্ষার ব্যবস্থা কি একটু সুদৃঢ় করা যায় না? সীমান্তে নজরদারির দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁরা যদি সে দায়িত্ব পালনে অক্ষম হন, তা হলে এই সমস্যা চলতেই থাকবে। অনুপ্রবেশে যারা সহায়তা করে তাদের কঠোর শাস্তি হওয়া উচিত। সীমান্তরক্ষার ক্ষেত্রে কঠোর নীতি গ্রহণই এ ক্ষেত্রে সরকারের সবচেয়ে বড় কর্তব্য হওয়া উচিত।

কী পদ্ধতিতে নাগরিকপঞ্জি তৈরি হওয়া উচিত, তা নিয়ে এত আলোচনা চলছে। কিন্তু কেউ ভাবছেন না যে এই ৪০ লক্ষ মানুষ হঠাৎ নাগরিকত্ব হারালে যাবেন কোথায়? কোনও প্রতিবেশী রাষ্ট্র তাঁদের আশ্রয় দেবে না। রোহিঙ্গাদের মতো রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়বেন তাঁরা। বিজেপির এই বিপজ্জনক কাজে আরও শক্ত হবে মৌলবাদীদের হাত।

Assam NRC Refugee Bangladesh War
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy