Advertisement
০৬ মে ২০২৪

বিহুর ডাকে ঘরে ফেরা, মেতেছে অসম

ভোটের লড়াই, কেলেঙ্কারির কড়চা, মূল্যবৃদ্ধিকে সঙ্গী করেই এসে গেল সংক্রান্তি আর উড়ুকা। রাত পোহালেই গরু বিহু। আপাতত সব মন খারাপ, কাজিয়াকে দূরে ঠেলে ধুবুরি থেকে শদিয়ার রং তসর-লাল। গুয়াহাটির সিংহভাগ মাঠে মণ্ডপের কাজ শেষ। গ্রামে-গ্রামে তাঁত, ঢেঁকি চলছে। ক্লাবে-স্কুলে মাস খানেক ধরে চলতে থাকা বিহু কর্মশালাও শেষ পর্যায়ে। এ বার বিহু আনন্দিয়া, বিহু বিনন্দিয়ার তালে কোমর মেলাতে তৈরি আট থেকে আশি।

বিহুর তালে। সোমবার উজ্জ্বল দেবের তোলা ছবি।

বিহুর তালে। সোমবার উজ্জ্বল দেবের তোলা ছবি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
গুয়াহাটি শেষ আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:৩৮
Share: Save:

ভোটের লড়াই, কেলেঙ্কারির কড়চা, মূল্যবৃদ্ধিকে সঙ্গী করেই এসে গেল সংক্রান্তি আর উড়ুকা। রাত পোহালেই গরু বিহু। আপাতত সব মন খারাপ, কাজিয়াকে দূরে ঠেলে ধুবুরি থেকে শদিয়ার রং তসর-লাল।

গুয়াহাটির সিংহভাগ মাঠে মণ্ডপের কাজ শেষ। গ্রামে-গ্রামে তাঁত, ঢেঁকি চলছে। ক্লাবে-স্কুলে মাস খানেক ধরে চলতে থাকা বিহু কর্মশালাও শেষ পর্যায়ে। এ বার বিহু আনন্দিয়া, বিহু বিনন্দিয়ার তালে কোমর মেলাতে তৈরি আট থেকে আশি। আগামী কাল গবাদি পশুর কল্যাণে সমবেত ভাবে গরুকে স্নান করিয়ে পুজো করা হবে। গান ধরা হয়— ‘লাও খা, বেঙেনা খা, বছর বছর বাড়ি যা।’ বিহুতে হাঁসের ডিম দিয়ে ১০১ রকমের শাক, দই-চিড়া খাওয়া নিয়ম। কালো ডাল দিয়ে মাথা, হলুদ দিয়ে গা ধুয়ে নতুন পোশাকে আম কাটা হয়। তা হল প্রতীকি শত্রু কাটা।

আগুন-বাজারে এ দিন চলছে শেষ দিনের কেনাকাটা। ফুলাম গামোছা, জোহা চিড়া, কপৌ ফুল, মেখলার দাম আকাশ ছোঁয়া। তবু চড়া দামের চোখ রাঙানির সঙ্গে আপোস করতেই হয়। নাচনিদের মাথায় দিতে কপৌ (সাদা-বেগনি রং-এর ডাভ অর্কিড) ফুলের বড় চাহিদা, হাতে লাগবেই গামখারু, গলায় জোনবিরি, ঢোলবিরি। দেশি গয়নার বাজার গ্রাস করতে বিহুর ফুল-গয়নার পসরাতেও চলেছে চিনা আগ্রাসন। ফাঁসিবাজার, গণেশগুড়ি বা শিলপুখুরিতে সস্তা ও নকল গয়না-ফুলের রমরমা। ১৫ থেকে ৫০ টাকায় মিলছে জোনবিরি, ঢোলবিরি। গামখারুর দাম ৫০-১০০ টাকা। বিশ টাকায় নকল কপৌ ফুলের গোছা। যেখানে স্থানীয় শিল্পীদের তৈরি জিনিস কিনতে গেলে দাম পড়বে তিন গুণ। অবশ্য আমবাড়িতে আত্মসহায়ক সংগঠনের উদ্যোগে যে বিহুর মেলা বসেছে, সেখানে তিনসুকিয়া থেকে আনা আসল কপৌ ফুলের গোছা ১০০-৩০০ টাকার বিক্রি হচ্ছে। নকল গামছার মতোই, আমদানি করা নাড়ু-পিঠেরও রমরমা চলছে। তাতে স্বাদ থাকছে না, কেবল সস্তায় নিয়মরক্ষা হচ্ছে। অবশ্য বিভিন্ন সংগঠন মহিলাদের তৈরি নাড়ু-পিঠে বিক্রি করছে। গামছার সাদা-লাল রঙে ঢেকেছে ফুটপাথ। কাজ করা গামছার দাম অন্তত সাড়ে তিনশো টাকা। নকল গামছার বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে প্রশাসন ফ্যান্সিবাজার থেকে কয়েকশো গামছা বাজেয়াপ্ত করেছে।

বিহু উপলক্ষে এ দিন বহু মানুষ শহর ছেড়ে নিজের জেলায় ফিরছেন। বিহু গাইয়ে-নাচিয়ের দলেরও দৌড় শুরু। বিহু উপলক্ষে অটো থেকে ফেরি—সর্বত্র বেশি ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ ওঠায়, প্রশাসন নজরদারি বাড়িয়েছে।

বিভিন্ন নামকরা বিহুটুলিতে বাজেটের সিংহভাগই যাবে নামী-দামী গায়ক-গায়িকার সম্মান দক্ষিণায়। এই বাজারে সব চেয়ে বেশি চাহিদা জুবিন গর্গ ও অঙ্গরাগ মহন্তর। তার পরেই রয়েছেন মানস রবীন, সীমান্ত শেখর, কৃষ্ণমণি চুতিয়া, প্রিয়াঙ্কা ভরালি, দিক্ষু, বাবুরা। ইতিমধ্যেই আলফা সতর্কবাণী দিয়ে দিয়েছে, বিহুর মঞ্চে হিন্দি গান বা অপসংস্কৃতি চলবে না। সদ্য রঙালি উৎসবের মঞ্চে পিস্তল হাতে তুলে বিতর্ক তৈরি করা জুবিন অবশ্য সাফ জানিয়েছেন, কারও নির্দেশ মেনে তিনি গাইবেন না। কোচ-রাজবংশী ছাত্র সংগঠন আক্রাসুও বিহুতে হিন্দি গান গাওয়ার উপরে নিষেধ চাপিয়েছে। সম্প্রতি প্রকাশিত বেশ কিছু অসমীয়া গানে ‘কদর্য’ শব্দের প্রয়োগ হওয়ায় তীব্র সমালোচনা হয়েছে। তাই, বিহু কমিটিগুলি শিল্পী নির্বাচনে সতর্ক।

সব বিহুটুলিতেই বিহু কুঁয়রী, বিহুরানি, বড় বিহুবতী, মৌ কুঁয়রী প্রতিযোগিতার আসর বসছে। অনেক জায়গায়, বহু রাউন্ড পার করে বিহুর মঞ্চে হবে গ্রান্ড ফিনালে। থাকবে জ্যাং বিহু, দিহানাম, বিয়ানামের আসর।

মাজুলিতে বিশ দিন আগে থেকেই সত্রগুলিতে বিহুর প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। এ দিন সত্রের নামঘর, মণিকূট, পদশিলাঘর, গুরুগৃহসহ সব স্থান পরিষ্কার করা হল। আগামী কাল দেওয়া হবে সপর্জা (নৈবেদ্য)। আউনিআটি সত্রে তিন দিন ধরে গায়ন-বায়ন-নটুয়া, অপ্সরা, হিয়ানাম, ওজাপালি পরিবেশিত হবে।

বিহু কেবল নাচ-গান নয়, বিভিন্ন খেলারও উৎসব। এই সময় গ্রামে-গ্রামে মানুষ বৌগুদু, টেকেলি ভাঙা, ধরা গুদু, হৈ গুদু, পাশা, বাঘ-গরু, মঙ্গলপাত, টাংগুটি, খেলিগুটি খেলায় মাতেন। বুধবার মানু বিহুর দিন সকালের মজা কাদার মধ্যে খেলা।

গুয়াহাটিতে বিহুর বর্ণাঢ্য সূচনা মানেই জজ ফিল্ডে আসুর মুকলি বিহু। ঢোল-পেপা-গগনার সুরে সেখানে এ বারের অনুষ্ঠানে থাকছে মিসিং গুমরাগ ও গোয়ালপাড়ার ওয়াংগালা নৃত্য। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা বিহুর দল তো থাকছেই. রাজ্যের নামকরা ব্যক্তিত্ব, গায়ক-অভিনেতাদের মিলনস্থল হয়ে ওঠা মুকলি বিহুর মাঠে পদ্মভূষণ প্রাপ্ত জহ্নু বরুয়া, পদ্মশ্রী প্রাপ্ত যাদব পায়েং, লক্ষ্মীনন্দন বরা-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসমের নাম উজ্জ্বল করা ব্যক্তিত্বদের সম্মানিত করা হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE