Advertisement
০১ মে ২০২৪

বৈঠক বাতিল করে পাকিস্তানকে কড়া বার্তা

আগেই ঘরোয়া ভাবে আপত্তি জানিয়েছিল বিদেশ মন্ত্রক। শুনতে চাননি ভারতে নিযুক্ত পাকিস্তানি হাইকমিশনার আব্দুল বাসিত। তাই আজ বিচ্ছিন্নতাবাদী হুরিয়ত নেতাদের সঙ্গে বাসিতের বৈঠকের পরেই দু’দেশের বিদেশসচিব পর্যায়ের বৈঠক বাতিল করল ক্ষুব্ধ ভারত। ওই সিদ্ধান্তকে নরেন্দ্র মোদী সরকারের পক্ষ থেকে পাকিস্তানকে প্রথম কড়া বার্তা হিসেবে দেখছেন কূটনীতিকরা।

পাকিস্তানের হাইকমিশনার আবদুল বাসিতের সঙ্গে দেখা করে বেরিয়ে আসছেন কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা সাবির শাহ। সোমবার নয়াদিল্লিতে। ছবি: পিটিআই

পাকিস্তানের হাইকমিশনার আবদুল বাসিতের সঙ্গে দেখা করে বেরিয়ে আসছেন কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা সাবির শাহ। সোমবার নয়াদিল্লিতে। ছবি: পিটিআই

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি ও শ্রীনগর শেষ আপডেট: ১৯ অগস্ট ২০১৪ ০৩:৩১
Share: Save:

আগেই ঘরোয়া ভাবে আপত্তি জানিয়েছিল বিদেশ মন্ত্রক। শুনতে চাননি ভারতে নিযুক্ত পাকিস্তানি হাইকমিশনার আব্দুল বাসিত। তাই আজ বিচ্ছিন্নতাবাদী হুরিয়ত নেতাদের সঙ্গে বাসিতের বৈঠকের পরেই দু’দেশের বিদেশসচিব পর্যায়ের বৈঠক বাতিল করল ক্ষুব্ধ ভারত। ওই সিদ্ধান্তকে নরেন্দ্র মোদী সরকারের পক্ষ থেকে পাকিস্তানকে প্রথম কড়া বার্তা হিসেবে দেখছেন কূটনীতিকরা।

পাকিস্তানের সঙ্গে মোদী সরকারের সম্পর্ক শুরু হয়েছিল অন্য সুরে। প্রধানমন্ত্রী পদে শপথগ্রহণের সময়ে পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন মোদী। শরিফও ভারতে এসে এড়িয়ে গিয়েছিলেন হুরিয়ত নেতাদের। কূটনীতিকদের মতে, নওয়াজের সেই সফরের ফলে সন্ত্রাসের জেরে থমকে থাকা আলোচনা শুধু নয়, ভবিষ্যতে ভারত-পাক বাণিজ্যিক সম্পর্কের রাস্তা খোলার সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছিল। কাশ্মীর সফরে গিয়ে পাকিস্তানকে ছায়াযুদ্ধ নিয়ে কড়া বার্তা দিয়েছিলেন মোদী। কিন্তু স্বাধীনতা দিবসের বক্তব্যে কিছুটা অপ্রত্যাশিত ভাবে পাকিস্তান নিয়ে কিছু বলেননি মোদী। মোদীর সেই পদক্ষেপকেও ইসলামাবাদের সঙ্গে নতুন সম্পর্কের ইঙ্গিত হিসেবে ধরা হচ্ছিল।

কিন্তু নওয়াজের সফরের তিন মাসের মধ্যেই সীমান্তে লাগাতার গুলিবর্ষণ, বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে পাক সরকারের বৈঠক বুঝিয়ে দিল-পাকিস্তান আছে পাকিস্তানেই।

পাকিস্তানও এখন অশান্ত। নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগে গত কয়েক দিন ধরেই প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের পদত্যাগের দাবিতে সরব বিরোধীরা। নতুন করে নির্বাচনের ডাকও দিয়েছেন তাঁরা। ইসলামাবাদে মিছিলে সামিল হয়েছেন ইমরান খান-সহ বিরোধী নেতারা। আজ পাকিস্তানের জাতীয় ও বেশ কয়েকটি প্রাদেশিক আইনসভা থেকে সরে গিয়েছেন ইমরানের তেহরিক-ই-ইনসাফ দলের সদস্যেরা। নওয়াজের পিএমএল-এন দলের তরফে বিরোধীদের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছনোর সব চেষ্টাই এখনও পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে। স্বভাবতই দেশের মাটিতে নড়বড়ে হয়ে পড়েছে নওয়াজ সরকার। বিদেশ মন্ত্রক সূত্রের মতে, নওয়াজ ব্যক্তিগত ভাবে চাইলেও, ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্কের প্রশ্নে পাক সেনাবাহিনীর বড় অংশের আপত্তি রয়েছে। দুর্বল নওয়াজের এখন তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখাও কঠিন। যার সুযোগে ফের সীমান্তে অশান্তি সৃষ্টি করতে চাইছে পাক সেনা ও আইএসআই। সাউথ ব্লকের তথ্য বলছে, গত দশ দিনে জম্মু-কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণরেখা ও আন্তর্জাতিক সীমান্তে ১১ বার সংঘর্ষবিরতি ভেঙেছে করেছে পাকিস্তান। নয়াদিল্লির আশঙ্কা, প্রয়োজনে নিজের গদি বাঁচাতে পাক সেনার ভারত-বিরোধী অভিযানে মদত দিতে পারেন নওয়াজ।

আজ কাশ্মীরি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে আলোচনায় বসে নয়াদিল্লির রক্তচাপ বাড়ান পাক হাইকমিশনার। আজ দুপুরে বাসিত প্রথমে বৈঠক করেন জম্মু-কাশ্মীর ডেমোক্র্যাটিক ফ্রিডম পার্টির নেতা সাবির আহমেদ শাহের সঙ্গে। আগামিকাল তাঁর হুরিয়ত নেতা সৈয়দ আলি শাহ গিলানির সঙ্গে বৈঠক করার কথা রয়েছে। হুরিয়ত কনফারেন্সের চেয়ারম্যান মিরওয়াইজ ওমর ফারুক বলেন, “ভারতের সঙ্গে বৈঠকের আগে পাকিস্তান কাশ্মীরের প্রকৃত অবস্থা কী তা জানতে চায়। তাই ওই বৈঠক।”

বিষয়টি নিয়ে মোদী সরকারকে আক্রমণ শুরু করেন বিরোধীরা। কংগ্রেস সাফ জানায়, বিরোধী আসনে থাকার সময়ে বিজেপি পাকিস্তান নিয়ে সরব ছিল। কিন্তু এখন সংঘর্ষবিরতি ভাঙা, বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে আলোচনা- সব কিছু নিয়েই চুপ মোদী সরকার। গত কাল রাতেও জম্মুতে মর্টার হামলা চালিয়েছে পাক সীমান্তরক্ষী বাহিনী রেঞ্জার্স। তাদের হামলায় আহত হয়েছেন এক গ্রামবাসী। কূটনীতিকদের মতে, এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানকে কড়া বার্তা না দিলে যে দেশেও রাজনৈতিক ভাবেও বেকায়দায় পড়তে হবে তা মোদী সরকার স্পষ্টই বুঝেছিল। তাই ২৫ অগস্ট ইসলামাবাদে প্রস্তাবিত বিদেশসচিব পর্যায়ের বৈঠক বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা। বরং বিদেশসচিব সুজাতা সিংহ পাক হাইকমিশনারকে জানিয়ে দিয়েছেন, বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে তাঁর বৈঠক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের পক্ষে আদৌ শুভ নয়। বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র সৈয়দ আকবরুদ্দিনের কথায়, “ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মাথা গলানো বরদাস্ত করা হবে না।”

তবে নওয়াজের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন নিয়েও সন্দেহ দানা বাঁধছে দিল্লিতে। সাউথ ব্লকের মতে, এখন নওয়াজের মুখে শান্তির বাণী শোনা যাচ্ছে। কিন্তু পাকিস্তানে কোনও সরকার দুর্বল হয়ে পড়লে ভারত-বিরোধী জিগিরে সামিল হয়। নওয়াজও যে সেই পথে হাঁটবেন না তা নিশ্চিত ভাবে বলা সম্ভব নয়। পাক সেনা-আইএসআইকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে তিনিও তাদের সুরে সুর মেলাতে পারেন। কূটনীতিকরা জানাচ্ছেন, কার্গিল যুদ্ধের সময়ে ইসলামাবাদের মসনদে যে নওয়াজই ছিলেন তা ভুললে চলবে না। পাক সেনা তাঁকে না জানিয়ে কার্গিলে অভিযানে নেমেছিল ঠিকই। কিন্তু পরে সেই পাক সেনাকেই রক্ষা করতে ওয়াশিংটন পর্যন্ত দৌড়েছিলেন নওয়াজ। প্রয়োজনে পাক সেনার সুরে গাইতে তাঁর অসুবিধে হবে না। ভারতীয় গোয়েন্দাদের দাবি, পাকিস্তানের পঞ্জাব প্রদেশে জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তইবার সঙ্গে যোগ আছে নওয়াজের দলের। আজ যে ভাবে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে বৈঠক নিয়ে এগিয়েছেন বাসিত, তাতে অশুভ সঙ্কেতই দেখছে বিদেশ মন্ত্রক। পাক বিদেশ মন্ত্রক জানিয়েছে, বিদেশসচিব বৈঠক বাতিল হওয়া ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে বড় ধাক্কা।

আজ কেবল বিদেশ মন্ত্রকই নয়, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সুর চড়িয়েছে মোদী সরকারের অন্য অংশও। আজ সেনাপ্রধান দলবীর সিংহ সুহাগের সঙ্গে অমৃতসরের কাছে আন্তর্জাতিক সীমান্ত পরিদর্শন করেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী অরুণ জেটলি। তিনি প্রচ্ছন্ন হুমকির সুরে বলেন, “গত কয়েক দিন ধরেই সংঘর্ষবিরতি ভেঙেছে পাক সেনা। তাদের জবাব দিতে ভারতীয় সেনা প্রস্তুত।”

মোদী সরকারের সিদ্ধান্তের পরে হতাশাই শোনা গিয়েছে জম্মু-কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদী ও মূলস্রোতের দলগুলির মুখে। হুরিয়ত নেতা সৈয়দ আলি শাহ গিলানি বলেছেন, “প্রমাণ হয়ে গেল কাশ্মীর নিয়ে দিল্লি সংঘর্ষের নীতি নিয়েই চলতে চায়।” হুরিয়তের গিলানিপন্থীরা জানিয়েছেন, তাঁরা পাক হাইকমিশনারের সঙ্গে দেখা করবেনই। রাজ্যের শাসক দল ন্যাশনাল কনফারেন্স ও মেহবুবা মুফতির পিডিপি-রও দাবি, মোদী সরকার ঠিক সিদ্ধান্ত নিল না। মেহবুবার কথায়, “কাশ্মীর নীতি কংগ্রেস ও বিজেপি-র মধ্যে ইঁদুর-বেড়াল খেলার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যারাই বিরোধী আসনে থাকে তারাই শান্তি প্রক্রিয়ায় বাধা দেয়। কাশ্মীরের ভাগ্যে জোটে ভোগান্তি।” ন্যাশনাল কনফারেন্সের প্রশ্ন, আগেও পাকিস্তানের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কথা হয়েছে। তা হলে এখন তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হল কেন?

কূটনৈতিক আশঙ্কা আর রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা মানতে হয় সব সরকারকেই। পাকিস্তান নিয়ে ভবিষ্যতে মোদী কোন পথে এগোন তা জানতে আগ্রহী সকলেই।

চিনা অনুপ্রবেশ

পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক উত্তাপ বাড়ার সময়েই ভারতীয় ভূখণ্ডে অনুপ্রবেশ করল চিনা সেনাও। সেনা সূত্রে খবর, লাদাখের বার্টসে এলাকায় ভারতীয় ভূখণ্ডের মধ্যে ২৫-৩০ কিলোমিটার ঢুকে এসে সেখানে শিবিরও তৈরি করেছে চিনারা। ভারতীয় সেনার টহলদারি দল ওই এলাকায় গেলেও চিনারা এখনও সরতে রাজি হয়নি। সরকারি ভাবে অবশ্য সেনাবাহিনী এই অনুপ্রবেশের কথা স্বীকার করেনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE