Advertisement
০৭ মে ২০২৪

পাখিদের নিয়ে পরিবেশ বাঁচান শিল্পী

বিশ্ব পরিবেশ দিবসে শহরে আজ অনুষ্ঠানের ছড়াছড়ি। বৃক্ষরোপণ, পরিবেশ বিষয়ক ক্যুইজ প্রতিযোগিতা, বসে আঁকো, আলোচনা, আরও কত কী!

নিজের বাড়ির বাগানে বিধান লস্কর। ছবি: সানি গুপ্ত

নিজের বাড়ির বাগানে বিধান লস্কর। ছবি: সানি গুপ্ত

উত্তম সাহা
শিলচর শেষ আপডেট: ০৬ জুন ২০১৬ ০৩:৩২
Share: Save:

বিশ্ব পরিবেশ দিবসে শহরে আজ অনুষ্ঠানের ছড়াছড়ি। বৃক্ষরোপণ, পরিবেশ বিষয়ক ক্যুইজ প্রতিযোগিতা, বসে আঁকো, আলোচনা, আরও কত কী!

লোকসঙ্গীত শিল্পী বিধান লস্করের রুটিনে অবশ্য তাতে ফারাক নেই। পাখির ডাকে ঘুম থেকে ওঠা। প্রাতঃরাশের আগে পাখিদের খাবার দেওয়া। জল বদলানো। কাজের ফাঁকে ডেকে তাদের সঙ্গে দু-চার কথা বলা!

শিলচর শহর বা শহরতলিতে অনেকের পাখি পোষার শখ রয়েছে। খাঁচায় রং-বেরঙের পাখি রেখে সময় কাটান তাঁরা। নিজের ময়না, কাকাতুয়াকে দু-চার শব্দ শেখানোর কৃতিত্বও রয়েছে অনেকের। বিধানবাবু অবশ্য তাঁদের দলে নেই। তাঁর বাড়িতে খাঁচা কোথায়! পাখিদের ধরে রাখার কৃতিত্বও তিনি দাবি করেন না। তবু পাখিরা তাঁকে দেখলেই চিনে নেয়। গলির মুখে পৌঁছতেই দল বেঁধে তাঁর পিছু নেয় তারা। এ ডাল ও ডাল করে তাঁকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার পরই যেন স্বস্তি পাখিদের!

আবার তিনি ডাকলেই পাখিরা উড়ে আসে তাঁর বাড়ি। শালিক, ডাহুক, বুলবুলের সঙ্গে কত নাম না-জানা পাখি! প্রথমে গাছের ডালে। পরে বাড়ির উঠোন। খাবার জন্য বিশেষ কোনও আব্দার নেই তাঁর কাছে। কিছু না দিলেও বসে থাকে, ওড়ে-ঘোরে তাঁকে ঘিরে। দুটো বিস্কুট ভেঙে দিলে সবাই মিলে ভাগ করে খায়। কাড়াকাড়ি নেই। বরং শিশু-পাখিদের প্রতি অন্যদের মমত্ব দেখার বিষয়। মায়েরা বিস্কুটের টুকরো নিয়ে প্রথমে উড়ে যায়। নিজের বাসায় গিয়ে সন্তানদের খাইয়ে ফের আসে। তখনও কিছু পড়ে থাকলে নিজের পেটে দেয়। আবার শালিকের বাচ্চাকে পরম মমত্বে বুলবুলের খাইয়ে দেওয়ার দৃশ্যও দেখা যায়।

বিধান নীরবে সে সব দেখেন। আর বিস্মিত হন। আবার তাঁকে দেখেও কম বিস্মিত হন না প্রতিবেশীরা। তাঁকে নিয়ে শোনা গল্প চাক্ষুষ করতে যারা চন্দ্রপুরে তাঁর বাড়ি যান, তাঁদের মুখে একটিই কথা— পরিবেশ সচেতনতার এর চেয়ে বড় পাঠ আর কী হতে পারে!

শিলচর শহর থেকে কিলোমিটার তিনেক দূরে কাঁঠাল রোড পেরিয়ে কাছাড় জেলার চন্দ্রপুর গ্রাম। শহরের কোলাহল নেই। বাড়ি বাড়ি গরু-ছাগল, কুকুর-বেড়াল। প্রচণ্ড রোদেও গাছের ছায়ায় সুশীতল গ্রাম। পাড়ার ভিতরে নিজের মোটরসাইকেলের শব্দও যেন শ্রুতিকটু ঠেকে। পুকুরপার ধরে বিধানবাবুর বাড়ি ঢুকতে গিয়েই থমকে দাঁড়াতে হল। পাশের বাড়ির বারান্দায় শুয়েছিল কুকুর একটি। পাশে ছাগলছানা। জিভ দিয়ে চেটে আদর করছিল কুকুরটিকে। কী দৃশ্য! ক্যামেরা তাক করতেই উধাও এরা।

বিধানবাবুর পাখিরা কিন্তু উধাও হয় না। ডাকাডাকি করার পর যত ক্ষণ তিনি বাইরে দাঁড়িয়ে, এরাও বসে থাকে। এক ডাল থেকে আরেক ডালে ওড়ে বেড়ায়। আর কী সব কথা বলে যেন।

তাদের জন্য বাড়ির উঠোনে অগভীর গর্ত করে রাখা। গর্ত মানে মাটি খুড়ে দিয়ে দায়সারা কাজ নয়। সিমেন্ট বাঁধাই। খেয়াল করে বিশুদ্ধ জল ঢেলে দেওয়া হয় তাতে। সকালের জল শুধুই ঠোঁট দিয়ে টেনে নেয় খাওয়ার জন্য। দুপুর-বিকেলে সে-জলেই গা ডোবায় এরা।

কী করে এমন পক্ষীপ্রেম, বা পক্ষীদের বিধানপ্রেম। বিধানবাবু নিয়ে যান তাঁর ঘরের পিছনে। সেখানেও বিশাল এক পুকুর। আছে আম-লিচুর গাছ, বাঁশঝাড়। সেখানে বাসা প্রচুর ডাহুকের। নিজেদের মতো করে তারা ঘুরে বেড়ায়। বাচ্চা দেয়, বড় হয়। কেউ কেউ সেখান থেকে ডাহুক মেরে নিয়ে যেত। পাখি তাঁরা ধরেন না, খান না বলে কে কটা নিয়ে গেল, তা নিয়ে বাড়ির কেউ মাথা ঘামান না। কিন্তু এক দিন ঢিল খেয়ে ডাহুকের ছটফটানি দেখে বিধানবাবু স্থির থাকতে পারেননি। বাধা দেওয়া সে থেকে শুরু। এক বার তাঁর আপত্তিতে কান না দিয়ে একজন ডাহুক মেরে নিয়ে গিয়েছেন শুনে লাঠি হাতে লোকটির খোঁজে এক কিলোমিটারের বেশি ঘুরে বেড়ান। সেখান থেকেই ধীরে ধীরে পাখিদের প্রতি মমত্ব বাড়তে থাকে। কিন্তু পাখিদের যে কবে থেকে তাঁকেও ভাল লেগে গিয়েছে, তা বিধানবাবুরও জানা নেই। বললেন, ‘‘প্রথমে ডাকলে দেখতাম, দু-চারটি পাখি উড়ে আসত। বেশ মজা লাগত। শুরু হল ডাকাডাকি। একটু কিছু খেতে দেওয়া। এই করে তাদের মধ্যে ডুবে গেলাম। গান-বাজনার ফাঁকে তাদের নিয়ে সময় কাটাতে বেশ ভাল লাগে।’’ নিজের অনুভূতির কথা এ ভাবেই ভাগ করেন বিধান লস্কর।

পরিবেশ দিবসের কথা উঠতেই তিনি নিয়ে গেলেন তাঁর লেবুর খেতে। চতুর্দিক গন্ধে মাতোয়ারা। ফলনও মন্দ নয়। তিনি নিজের হাতে পরিচর্যা করেন এদের। বলেন, ‘‘ইট-কংক্রিটের ইমারত বাড়িয়ে লোক দেখানো দুয়েকটা বৃক্ষরোপণে লাভ নেই। বরং শহরের প্রতিটি বাড়িতে লেবু গাছের সীমানা-পাচিল তৈরি করা গেলে পরিবেশ সুরক্ষার বড় কাজ হবে। কাঁটাযুক্ত বলে চোরেদের হাত থেকেও রেহাই মিলবে।’’ তাঁর কথায়, ‘‘যত গাছ থাকবে, তত পাখি আসবে। প্রাণে প্রাণে গানে গানে বেঁচে থাকার আনন্দটাই আলাদা।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Bird World Environmnet Day
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE