উম্মুল খের।—ফাইল চিত্র
১৪ বছরে হাড় ভেঙেছে ১৬ বার। তার মধ্যে আট বার অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে। ঠিক ভাবে হাঁটাচলা করতে পারেন না। কিন্তু, লড়াই থেকে একটি বারও সরে আসেননি উম্মুল খের।
মনের জোরেই তিনি হারিয়ে দিয়েছেন আর্থিক ও শারীরিক সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকে। আর তাতেই মিলেছে সাফল্য। আঠাশ বছরের লড়াকু তরুণী ইউপিএসসি-র সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় গোটা দেশের মধ্যে ৪২০তম স্থান দখল করে নিয়েছেন। প্রথম বার পরীক্ষায় বসেই এই সাফল্য।
উম্মুলের এই সাফল্যের পিছনে রয়েছে দীর্ঘ দিনের লড়াই। কখনও শরীরের সঙ্গে যুঝে, কখনও বা আর্থিক অনটনকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে এগিয়ে যাওয়া!
কী রকম?
উন্মুল তখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। স্কুলে যাওয়ার পথে পড়ে গিয়ে ডান পা ভেঙে যায়। সেই সময় সকলে ভেবেছিলেন, এটা নিতান্তই পড়ে গিয়ে ভেঙে যাওয়া। চিকিৎসকেরাও তাই প্রথম দিকে খুব একটা গুরুত্ব দেননি। আর পাঁচটা সাধারণ পা ভেঙে যাওয়ার ক্ষেত্রে যেমনটা চিকিত্সা হয়, উন্মুলেরও তা-ই হয়েছিল। কিন্তু, কয়েক মাসের মধ্যে, ঘরের ভিতরেই অসাবধনতাবশত পড়ে যায় সে। বাঁ হাত ভেঙে যায়! এ বার চিকিত্সকদের মনে প্রশ্ন তৈরি হয়। সামান্য পড়ে গিয়ে এ ভাবে হাত-পা ভেঙে যাওয়াটা তো খুব একটা স্বাভাবিক নয়!
এর পরেই তার শারীরিক নানা পরীক্ষা করা হয়। আর তাতেই ধরা পড়ে, হাড়ের জটিল ক্ষয় রোগে আক্রান্ত চোদ্দ বছরের উম্মুল! ওই কিশোরীর বাবা সেই সময়টায় রাস্তায় জামাকাপড় ফেরি করে বেড়ান। মেয়ের জটিল রোগের খবরে যেন তাঁর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে!
উন্মুলের বয়স তখন পাঁচ বছর। কাজের সন্ধানে রাজস্থান থেকে দিল্লিতে চলে এসেছিলেন উম্মুলের বাবা। রাজধানীর হজরত নিজামুদ্দিন রেল স্টেশনের কাছে এক বস্তিই হয়ে ওঠে তাঁদের ঠিকানা। শত কষ্টের মধ্যেও মেয়েকে দীনদয়াল উপাধ্যায় ইনস্টিটিউটে ভর্তি করেন তিনি। বরাবরই লেখাপড়ায় মেধাবী উম্মুল সহজেই শিক্ষকদের সুনজরে চলে আসে। পড়াশোনার জন্য স্কলারশিপও পায় সে। টাকার অভাবে মেয়ের স্কুলের মাইনে মাসের পর মাস দিতে পারেননি বাবা। সেই সময়ে স্কুল কর্তৃপক্ষ এবং শিক্ষকেরা ওই পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছেন। এর মধ্যে ছিল উন্মুলের শারীরিক অসুস্থতাও। সব মিলিয়ে পড়াশোনায় যথেষ্ট বাধা এসেছে। কিন্তু, লেখাপড়ার ইচ্ছা এক বারের জন্যও মরে যায়নি।
আরও পড়ুন: সুষমা-ছোঁয়ায় ভিসা, আপ্লুত পাক বাবা
লেখাপড়ার খরচ চালাতে প্রাইভেট টিউশন শুরু করে উম্মুল। দিনে চারটি ব্যাচ পড়াত, দুপুর তিনটে থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত। তার কাছে পড়তে আসত বস্তির ছেলেমেয়েরাই। প্রত্যেকের কাছ থেকে ৫০-১০০ টাকা করে নিত কিশোরী উন্মুল। রোজগারের টাকার একটা বড় অংশ বাবার হাতে তুলে দিত ওই কিশোরী। সংবাদ মাধ্যমকে উন্মুল বলেছেন, ‘‘ওই টাকা সংসার এবং আমার চিকিৎসার খরচ চালানোর জন্য বাবাকে দিতাম।’’ কলেজ পরবর্তী জীবনেও একই ভাবে টাকা উপার্জন করতেন তিনি।
কিন্তু, এত কিছুর মধ্যে পড়াশোনা কখন করতেন?
সিভিল সার্ভিসে সফল উম্মুল জানিয়েছেন, রাতই ছিল তাঁর পড়ার একমাত্র সময়। প্রায় সারা রাত জেগে পড়তেন। ভোরের দিকে একটু ঘুমিয়ে নিতেন। তার পর স্কুল-কলেজ। কোনও কাজই বেশি ক্ষণ ধরে টানা করতে পারতেন না। কিছু দিন বাদে বাদেই কোনও না কোনও জায়গার হাড় ভেঙে যেত। তার পর অস্ত্রোপচার। এতে আঠাশ বছরের জীবনে অনেকটা সময়ই নষ্ট হয়ে যায়!
সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় সফল হওয়ার পর এখন একটাই ইচ্ছা উম্মুলের। পরিবারের মুখে হাসি ফোটানো।
আরও একটা ইচ্ছা আছে, বস্তির ছেলেমেয়েদের জন্য কিছু করা। আপাতত একটা ভাল পোস্টিং-এর আশায় উম্মুখ উম্মুল। তার পর নতুন করে শুরু হবে লড়াই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy