চার পাশের গুঞ্জন শুনতে শুনতে, পাশের জলাশয়ের দিকে তাকিয়ে মনে মনে দেখতে পেলুম ধোঁয়া উঠছে। ফিসফিস বৃষ্টি পড়ছে না সেই ফেলে-আসা দিনের মতোন। তবু, শ্রবণে শত মানুষ-মানুষির গুঞ্জন, জলাশয়ের দৃশ্য পেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দেখতে পেলুম চার দশক আগের সেই গৌরীকুণ্ডের আশ্চর্য রাত্রির স্মৃতি এখনও তরতাজা। হয়তো, আজীবন থেকেও যাবে স্বর্গীয় কোনও অমলিন ফুলের মতোন। বৃষ্টির রাত্রের পেঁজা তুলো বা দোঁয়ার মতো হালকা মেঘের পাখনায় ভর দিয়ে আসে স্মৃতি আর মুহূর্তে উড়িয়ে নিয়ে যায় ভবঘুরে মনকে হিমালয়ের বুকে। দেখতে পাই পিচ্ছিল কয়েক ধাপ পাথুরে সিঁড়ি বেয়ে স্নানার্থীরা উঠছে-নামছে। গৌরীকুণ্ডের উষ্ণ-প্রসবনের প্রায় ফুটন্ত জল থেকে কুয়াশার মতো ধোঁয়া উঠছে আকাশে।
কুণ্ডের কয়েক গজ দূরেই প্রকৃতির এক অবাক করা চমত্কার কাণ্ড। ফুটন্ত জলের প্রায় গায়ে গায়েই বরফের পুরু আস্তরণের তলা দিয়ে হিমালয়-কন্যা মন্দাকিনীর খরস্রোত ঊর্ধ্বশ্বাস বয়ে চলেছে। তারই একটানা হালকা শব্দ উঠে আসছে তপ্ত জলের ধোঁয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছলছল ছলছল আমি আছি, আমি আছি...। আমরা যে পথ বেয়ে উঠে এসেছি, সেই পথেই উল্টোমুখো বয়ে চলেছে ওর আপন বোন অলকানন্দার সঙ্গে মিলিত হবে বলে। মিলেমিশে দুই বোন কলকলিয়ে রাজ্যের কথা বলতে বলতে নেমে যাবে রুদ্রপ্রয়াগের দিকে। দেবপ্রয়াগের সঙ্গমে উচ্ছলা, চঞ্চলা বড় বোন ভাগীরথীর সঙ্গে মিলিত হয়ে, সম্মিলিত স্রোত হিসেবে উত্তরণ হবে হৃষিকেশ-হরিদ্বার পেরিয়ে ভারতের সমতলের গ্রামে-গঞ্জে, নগরে নগরে।
কুণ্ডটি ঘিরে চার পাশের পাথুরে দেওয়ালে জমে গেছে সবুজ শ্যাওলা। তারই স্যঁাতস্যঁাতে, ভেজা গন্ধ, ধোঁয়ার গন্ধ মিলেমিশে একাকার। সেই সঙ্গে সমবেত পুণ্যার্থীদের চাপা গুঞ্জন, অল্প দূরে প্রবাহিনী মন্দাকিনীর বরফ-শীতল স্রোত বয়ে যাবার একটানা শব্দের মিশ্রিত পরিবেশের মধ্যে থেকে কার যেন গম্ভীর কণ্ঠ ভেসে আসছে শ্রবণে। নানান মন্ত্রোচ্চারণ ও শীতের কাঁপুনির শব্দাবলি ছাপিয়ে সেই অজানা, অচেনা কণ্ঠস্বর শুনতে শুনতে সর্বাঙ্গে কাঁটা দিয়ে উঠছে
“মন্দাকিনী সলিল চন্দন চর্চিতায়
নান্দীশ্বর মহেশ্বর প্রমথনাথ
বিশ্বেশ্বরায়—”
পর্বতের অতল-অন্তর গহ্বর থেকে, নাভি থেকেই বুঝিবা, উঠে আসছে সেই গম্ভীর, অমোঘ নাদ।
সেই রাতে, অমন হাড়কাঁপানি প্রচণ্ড শীত-বৃষ্টির মধ্যেও স্তম্ভিত হয়ে কাঁপতে কাঁপতে দেখেছিলুম কুণ্ডের মস্ত পাথুরে চৌবাচ্চার জলে নেমে স্নান করছে কয়েক জন পুণ্যার্থী। দোনোমনো করতে করতে অসীম সাহসে ভর করেই একে একে, সইয়ে সইয়ে কোট-সোয়েটারের পাতলুম খুলে ফেলেছিলুম আমরা দু’জনে। স্নানও করে ফেলেছিলুম (অনেকটা কাক-স্নানও বলা যায়) ফুটন্ত জলে। অবশ্যই অন্যদের দেখাদেখি আগে অনেকটা ‘শান্তি-জল’ ছিটোনোর কায়দায় টগবগে ফুটন্ত জল একটু একটু করে গায়ে-মাথায় ছিটিয়ে, সইয়ে নিয়ে, তার পর। বীর-বিপ্লবী বা শহিদের মতো ভেবে রেখেছিলুম—ঠান্ডা লেগে জ্বর হলে, তখন দেখা যাবে—জয় বাবা কেদারনাথ মহারাজজি। না। বিপরীত ফল কিছু হয়নি। বরং পায়ের-গায়ের ব্যথা-বেদনা সেরে গিয়ে পর দিন সকালে এক্কেবারে তরতাজা হয়ে ডবল উত্সাহে রওনা দিতে পেরেছিলুম কেদারনাথের দিকে।
ছোট্ট একটি বিশেষ বোধ তথা প্রশ্ন জাগ্রত হয়েছিল মনে, সেই কৈশোর-যৌবনের সন্ধিক্ষণেই। মানুষের সুবিধে-অসুবিধে-প্রয়োজন ইত্যাদি বুঝে-শুনে, হিসেব করেই কি প্রকৃতি-ঈশ্বরী তাবত্ ব্যবস্থা আগেভাগে করে রেখে দেন? নইলে, হা-ক্লান্ত হয়ে হেঁটে হেঁটে গা-গতর-হাঁটুর কল-কব্জা-খিল যখন অসম্ভব যন্ত্রণা ব্যথায় খুলে পড়বার দাখিল হয়, ঠিক তখন, সেখানেই, অনেকটা যেন মন্ত্র-বলে তার নিরাময়ের ব্যবস্থা হিসেবে একটি উষ্ণপ্রস্রবণ বানিয়ে রাখবেন কেন?!...
তাই বোধহয় জিরিয়ে, বসে, চা-জল খেতে খেতে, নৈশ আরামের বাতাসে সমতল-ভূমির পিচের মসৃণ রাস্তায় আমরা, যারা বেশ কয়েক ঘণ্টা হেঁটে মন্দির দর্শন করতে চলেছি—আমাদের জন্যে এখানে কোনও উষ্ণ-প্রস্রবণের বদলে সাধারণ দৃশ্যাবলির মতো শান্ত ‘বান্দ্রা তালাও” বা দিঘি রয়েছে।
দুটো নাগাদ মহিমকজওয়ে তথা জংশন ছাড়িয়ে এগোচ্ছি। দেখি, মানুষ-মানুষী দলে দলে হেঁটে আসছে, হাইওয়ে দিয়ে ‘ওপার’ মুম্বইয়ের বাসিন্দারা। ভিড়ের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কয়েকটি ছোট্ট দল উড়াল পুলের ওপরে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের খোলা বাতাসের আমেজ নিচ্ছে। মহিম গির্জা ও ভিক্টোরিয়া হাইস্কুল পেরোচ্ছি, দেখি, এক কিশোর হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে চলেছে। মানত-টানত করেছিল হয়তো। এর পর আরও দু’চার জনকে দেখলুম সরীসৃপের মতো এগোচ্ছে, অনেকটা বঙ্গে দেখা সেই তারকেশ্বর মন্দিরের দিকে পুণ্যার্থীদের গণ্ডি কাটতে কাটতে যাওয়া, মনে পড়ে গেল “বাবা তারকেশ্বরের (নাকি, ‘তারকনাথের’) চরণের সেবা লাগে -এ-এ-এ—
যুবকটি কলেজের ছাত্র। নাম অলঙ্কার রাওয়ত। আরও একজনের সঙ্গে দেখা হল শশীকান্ত মৌরিয়া। এঁরা দু’জনেই হামাগুড়ি দিয়ে এসেছেন কোনও মানত-রক্ষার জন্যে। কল সেন্টারের ড্রাইভার সবুজ প্যাটেল গত ১৫ বছর ধরে সোমবার রাতে বেরিয়ে পড়েন গোরেগাঁওয়ের বাসা থেকে। রাত দশটা নাগাদ, যাতে পুণ্যতিথি মঙ্গলবার ভোরবেলায় প্রথম ‘দর্শন’ করতে পারেন সিদ্ধিদাতার।