অঙ্কন: কুণাল বর্মণ
নরেন্দ্র মোদী বনাম অলোক বর্মা। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দৌড়চ্ছিলেন দু’জনেই। কে আগে লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেন!
নরেন্দ্র মোদীর লক্ষ্য ছিল, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বর্মাকে সিবিআই ডিরেক্টরের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া। কারণ মোদী সরকারের আশঙ্কা ছিল, রাফাল-চুক্তিতে তদন্তের এফআইআর দায়ের করে দিতে পারেন তিনি।
অন্য দিকে, নিজের আস্থাভাজন অফিসারদের দ্রুত দিল্লির সদর দফতরে ফিরিয়ে আনছিলেন বর্মা। যাঁর সঙ্গে সংঘাতকে কেন্দ্র করে মধ্যরাতের অপারেশনে বর্মাকে সরিয়েছিল কেন্দ্র, সেই রাকেশ আস্থানার বিরুদ্ধে তদন্তে নতুন অফিসার নিয়োগ করেন তিনি। স্পেশ্যাল ডিরেক্টর আস্থানা সিবিআইয়ের অন্দরে মোদীর ঘনিষ্ঠ বলেই পরিচিত। ফলে যে কোনও সময় মোদী-সরকার ও আস্থানার বিরুদ্ধে আঘাত আসছে বলে জল্পনা তুঙ্গে ওঠে।
আরও পড়ুন: প্রতিবাদ না করলে ‘শত্রু’ বাঙালিরা, হুমকি পরেশের
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মোদী বনাম বর্মা প্রতিযোগিতায় ইতি পড়ল। সিবিআই ডিরেক্টরের পদ থেকে বর্মাকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বাছাই কমিটি। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নিজেই বর্মাকে সরানোর পক্ষে সওয়াল করেন। তাঁকে সমর্থন করেন প্রধান বিচারপতির প্রতিনিধি বিচারপতি এ কে সিক্রি। আপত্তি জানান লোকসভায় কংগ্রেসের দলনেতা মল্লিকার্জুন খড়্গে। ২-১ ভোটে বর্মাকে ডিরেক্টর পদ থেক অপসারণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পরে মোদী এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহকে নিয়ে গঠিত মন্ত্রিসভার নিয়োগ কমিটি তাকে পাঠায় ডিজি (ফায়ার সার্ভিসেস, সিভিল ডিফেন্স ও হোমগার্ড)-এর মতো প্রায় গুরুত্বহীন পদে। বলা হয়, নতুন ডিরেক্টর নিয়োগ না-হওয়া পর্যন্ত দায়িত্ব সামলাবেন এম নাগেশ্বর রাও। ২৩ অক্টোবর বর্মাকে সরানোর পরে যাঁর হাতে সিবিআইয়ের দায়িত্ব সঁপেছিল মোদী সরকার। রাতেই দায়িত্ব নেন তিনি।
আরও পড়ুন: আবার পিছোল অযোধ্যা শুনানি
সুপ্রিম কোর্ট পুনর্বহাল করার পরে বুধবার সকালেই কাজে যোগ দেন বর্মা। কিন্তু তাঁর ভবিষ্যৎ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়টি বাছাই কমিটির হাতে ছেড়েছিল শীর্ষ আদালত। সেই সূত্রে বুধবার রাতেই বাছাই কমিটির বৈঠক ডাকেন মোদী। সে-দিন সিদ্ধান্ত না-হওয়ায় বৃহস্পতিবার বিকেলে ফের বৈঠক ডাকা হয়।
আজ সকালেই রাহুল গাঁধী প্রশ্ন তোলেন, বর্মাকে সরাতে প্রধানমন্ত্রীর এত তাড়াহুড়ো কিসের? এর একটাই জবাব— রাফাল তদন্ত। বর্মাকে সরানোর পরে কংগ্রেসের বক্তব্য, ‘প্রধানমন্ত্রী দেখিয়ে দিলেন, জেপিসি-ই হোক বা সিবিআই, রাফাল চুক্তির তদন্ত নিয়ে তিনি কতখানি আতঙ্কিত।’ বর্মার ভবিষ্যৎ যা-ই হোক, রাজনীতির ময়দানে লাভই দেখছে কংগ্রেস। দলীয় নেতাদের বক্তব্য, যে ভাবে তড়িঘড়ি বর্মাকে সরাল মোদী সরকার, তাতে এই প্রচারের পথ প্রশস্ত হয়ে গেল যে, রাফাল-দুর্নীতি ফাঁসের ভয়েই এমনটা করা হল। রাতে রাহুল টুইট করেন: মিস্টার মোদীর মনে এখন প্রবল ভয়। তিনি ঘুমোতে পারছেন না। বায়ুসেনার থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা চুরি করে তিনি অনিল অম্বানীকে দিয়েছেন। পর পর দু’বার অলোক বর্মাকে সরানোয় এটাই প্রমাণ হল যে, মোদী নিজের মিথ্যার জালে বন্দি।
রাফাল নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন বলেই বর্মাকে সরানো হচ্ছে, এই অভিযোগ সামনে রেখে আজ বাছাই কমিটির আড়াই ঘণ্টা বৈঠকে তাঁর অপসারণের বিরুদ্ধে সওয়াল করেন খড়্গে। ঘটনাচক্রে, দু’বছর আগে বর্মাকে ডিরেক্টর হিসেবে নিয়োগ করার সময় খড়্গেই তাঁর বিরোধিতা করেছিলেন। সূত্রের খবর, সেই প্রসঙ্গ তুলে আজ খড়্গেকে কটাক্ষ করেন মোদী। বলেন, আপনিই ওঁকে নিয়োগের বিরোধিতা করেছিলেন। আবার ওঁকে সরানোর বিরোধিতা করে আদালতে গিয়েছিলেন!’’
বিজেপি সূত্রের বক্তব্য, খড়্গে যে হেতু বর্মার অপসারণ নিয়ে মামলা করেছিলেন, তাই ওঁর বাছাই কমিটির বৈঠকে যাওয়া উচিত হয়নি। যেমন মামলাটি শুনেছেন বলে যাননি প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ। আইন অনুযায়ী খড়্গের অবশ্য প্রতিনিধি পাঠানোর সুযোগ ছিল না।
বর্মার অপসারণের পক্ষে যুক্তি দিয়ে সরকারের তরফে বলা হচ্ছে, সিবিআই ডিরেক্টর হিসেবে তাঁর থেকে যে সততা প্রত্যাশিত, তা দেখাতে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। ভিজিল্যান্স কমিশন রিপোর্ট দিয়েছে, মাংস ব্যবসায়ী মইন কুরেশির বিরুদ্ধে তদন্ত প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছিলেন বর্মা। ২ কোটি টাকা ঘুষ নেওয়ার প্রমাণও মিলেছে। আইআরসিটিসি-তে দুর্নীতির একটি মামলাতেও তিনি হস্তক্ষেপ করেছিলেন। বর্মা আস্থাভাজন অফিসারদের ফের সদর দফতরে ফেরানো নিয়ে চিন্তা প্রকাশ করে সরকারের তরফে কমিটিতে বলা হয়, ওই অফিসারদের সততা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সিবিআইয়ের প্রাতিষ্ঠানিক বিশ্বস্ততা বজায় রাখতে বর্মাকে হঠানো প্রয়োজন। কমিটি শুধু সিবিআই ডিরেক্টর বাছাই করতে পারে বা বদলি করতে পারে। তাই বর্মার বিরুদ্ধে নিরপেক্ষ তদন্তের স্বার্থে তাঁকে বদলি করা হোক।
খড়্গে যুক্তি দেন, তার আগে বর্মার বক্তব্যও শোনা উচিত। কিন্তু পাল্টা যুক্তি ওঠে, বর্মা ভিজিল্যান্স কমিশনের কাছেই নিজের বক্তব্য জানানোর সুযোগ পেয়েছেন। সুপ্রিম কোর্টও ভিজিল্যান্স কমিশনের রিপোর্ট দেখেছে। খড়্গে বলেন, বর্মার বিরুদ্ধে আস্থানা যে ১০টি অভিযোগ তুলেছেন, তার মধ্যে কমিশন ৪টিই খারিজ করে দিয়েছে। তিনি দাবি তোলেন, ২৩ অক্টোবর মধ্যরাতে বর্মাকে ছুটিতে পাঠানোর ঘটনায় প্রধানমন্ত্রীর দফতর, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালের ভূমিকার তদন্ত প্রয়োজন।
সূত্রের খবর, বিচারপতি সিক্রি মত দেন, বর্মার বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত প্রয়োজন। কিছু ক্ষেত্রে পুলিশি তদন্ত দরকার। সেই তদন্তের প্রয়োজনে তাঁর সিবিআই ডিরেক্টর পদে থাকা সঠিক নয়। সরকারি সূত্র বলছে, খুব শীঘ্রই বর্মার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হবে।
বাছাই কমিটির বৈঠকের আগে আজ দিনভর ঘুঁটি সাজানোর কাজ করছিলেন বর্মা। আস্থানার বিরুদ্ধে তদন্তের ভার এম কে সিনহাকে দিতে চান তিনি। সিনহা রাজি না হওয়ায় এসপি মোহিত গুপ্তকে নতুন তদন্তকারী অফিসার করা হয়। জল্পনা শুরু হয়, আস্থানার বাড়িতে বৃহস্পতিবার রাতেই তল্লাশি হবে। অগুস্তা ওয়েস্টল্যান্ডের দালাল ক্রিশ্চিয়ান মিশেলকে যে সিবিআই অফিসারের নেতৃত্বে ভারতে ফেরানো হয়, সেই সাই মনোহরের দফতরেও তল্লাশি হবে। তার আগেই অবশ্য বর্মাকে বদলির নির্দেশ জারি হয়ে যায়। তার পরেই সিবিআই দফতর ঘিরে ফেলে দিল্লি পুলিশ।
তবে সিবিআই কর্তারা মনে করছেন, এই বিবাদ এখানেই থামবে না। আপাতত আস্থানার মুখে হাসি ফুটছে। আস্থানার বিরুদ্ধে বর্মা যে এফআইআর দায়ের করেছিলেন, তা খারিজ করার জন্য আস্থানা দিল্লি হাইকোর্টে মামলা করেছিলেন। শুক্রবার সেই মামলার রায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy