Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

কথাই সার, শহরে বাড়ছে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা

ভবানীপুরের একটি বিত্তবান পরিবারে থাকে পূজা। বছর তেরোর মেয়েটিকে ওই পরিবার ঠিক ‘নিজের মেয়ের মতো’ রাখেনি। বরং তার পোশাক-আশাক, সামাজিক অবস্থানেই ফুটে ওঠে তার পরিচয়।

পারমিতা মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৯ জুলাই ২০১৫ ১৫:৪৮
Share: Save:

ভবানীপুরের একটি বিত্তবান পরিবারে থাকে পূজা। বছর তেরোর মেয়েটিকে ওই পরিবার ঠিক ‘নিজের মেয়ের মতো’ রাখেনি। বরং তার পোশাক-আশাক, সামাজিক অবস্থানেই ফুটে ওঠে তার পরিচয়। গেরস্থালির কাজ নিপুণ ভাবে সামলে দেয় কচি হাত। মালকিন তা নিয়ে প্রশংসা করতেও ছাড়েন না।

কলকাতা ছেড়ে মেদিনীপুরে যেতে হবে ভাবলেই কষ্ট হয় পূজার। মুখ কালো করে সে বলে, ‘‘ফিরে যেতে হবে। কী করব বাড়িতে সমস্যা, মা ডেকে পাঠিয়েছে।’’

আসলে পূজার অন্য সমস্যা। বাড়িতে গেলেই বাবা-মা জোর করে বিয়ে দিয়ে দিতে চায় তার। তা ছাড়া খাওয়া জোটে না ঠিক মতো। আরও ভাইবোন আছে, তাদের সঙ্গে দিনরাত ঝামেলা। তার থেকে অনেক ভাল থাকা যায় ভবানীপুরে। ‘দিদি’-র পুরনো জামা দিব্যি সুন্দর গায়ে হয়। গরমে কষ্ট নেই। শীতে জুটে যায় কম্বল। খাওয়া দাওয়া তো ভালই। মালকিনের সুনজরও আছে।

কিন্তু কী করা যায়? সমীক্ষার হিসাবে পূজা শিশু শ্রমিকের গোত্রভুক্ত। তার এই কলকাতায় থাকাটা আইনত অন্যায়। অথচ কে বোঝে পূজা ভাল আছে।

এই ভাল থাকাটা কিন্তু একা পূজার নয়। একটি বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সমীক্ষায় ধরা পড়েছে সেই ছবি। প্রায় ৯২শতাংশ শিশু শ্রমিক তাদের পেশা নিয়ে খুশি। হাসি মুখে তারা জানিয়ে দিয়েছে কাজ করে বাবা মার হাতে টাকা তুলে দিতে পেরে তাদের ভালই লাগে।

এমনকী এই সব শিশুরা কেউই তেমনভাবে স্কুলে যেতে আগ্রহী নয়। কেউ কেউ অবশ্য আগে কোনও না কোনও সময় পড়াশোনা করেছে। কিন্তু সে সব আর ভাল লাগে না। যে দেশে শিশু শ্রম নিয়ে কাজ করার জন্য এসেছে নোবেল পুরস্কার, সে দেশে এই প্রবণতাই মূল বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে শিশু শ্রম নিবারণে। আজও তাই প্রায় এক কোটি শ্রমিকের বয়স ৫ থেকে ১৭-এর মধ্যে।

সম্প্রতি একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন তাদের গবেষণায় জানিয়েছে গত এক দশকে শিশু শ্রমিক কমেছে মাত্র ২.২ শতাংশ। তাদের আশঙ্কা এ ভাবে চলতে থাকলে এক শতাব্দীরও বেশি সময় লাগবে শিশু শ্রম বন্ধ করতে।

আরও একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে তাদের গবেষণায়, যেখান বলা হয়েছে ২০০১-২০১১ সালের মধ্যে শহরাঞ্চলে শিশু শ্রমের হার বেড়েছে ৫৩ শতাংশ। এর মধ্যে ৫-৯ বছরের শিশুদের চাহিদাই সবচেয়ে বেশি। সমীক্ষা বলছে ২০০১-এ শহরাঞ্চলে এই বয়সের শিশু শ্রমিকে সংখ্যা যেখানে ছিল ২২৬৬৫৪, দশ বছরের মধ্যে তা বেড়ে হয়েছে ৬৪৭৬৫৯। অর্থাৎ শতাংশের হিসাবে এই বৃদ্ধি ১৮৫.৭৫ হারে। অন্যদিকে ১০ থেকে ১৪ বছরের শিশু শ্রমিকের হার বেড়েছে মাত্র ২৫.৯৩ শতাংশ।

পশ্চিমবঙ্গের জেলাওয়াড়ি হিসাব দেখলে ৫-৯ বছরের শিশুদের কাজের পরিসংখ্যানে কলকাতার স্থান দ্বিতীয়। প্রথম স্থানে অবশ্য রয়েছে দক্ষিণ ২৪ পরগনা। কিন্তু ১০ থেকে ১৪ বছরের শিশুদের কাজের হিসাবে প্রথম পাঁচে নেই কলকাতা। বরং সেখানে পরপর রয়েছে দক্ষিণ ২৪ পরগনা, মুর্শিদাবাদ, উত্তর ২৪ পরগনা, পশ্চিম মেদিনীপুর এবং বর্ধমান। অর্থাৎ শহুরে কাজের ভঙ্গিটা বেশ বোঝা যায়।

এর জন্য অবশ্য কোনও সমীক্ষার তেমন প্রয়োজন হয় না। একটু চোখ খুলে রাখলে এই কলকাতাতেই দেখতে পাওয়া যায় হাজার শিশুর নিত্যকর্ম। এই যে পরব-পার্বণের মরসুম শুরু হয়েছে, সেখানেও যোগ দেব বেশ কয়েক হাজার শিশু শ্রমিক। ঈদের বাজারে খদ্দের ধরতে দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে কোনও না কোনও বালক, ‘‘আসুন না, ভাল সালোয়ার আছে’’। দুর্গাপুজোর পাঁচদিন কলকাতার ফুটপাথ যখন ভরে যাবে ফাস্টফুডের দোকানে, থালা ভরা চাউমিন কি ভাপা-মোমো এগিয়ে দেবে কোনও বছর বারো। দাদার সঙ্গে সেই থালা ধুয়ে দেবে অন্য কোনও বছর সাত।

শুধু তাই কেন? ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে কুমোরটুলির প্রস্তুতি। কলকাতার বাইরে বিভিন্ন জেলা থেকে এসেছেন কারিগররা। সঙ্গী তাঁদের ছোট ছেলেরাও। এখন থেকে কাজ শিখতে হবে যে তাদের।

দেশের একটা বড় অংশের শিশু শ্রমিক যুক্ত জামা কাপড়ের ব্যবসার সঙ্গে। মূলত জরির কাজ, সুতোর কাটার কাজে অদক্ষ শ্রমিক হিসাবে ব্যবহার করা হয় ৫ থেকে ১৭ বছরের ছেলেমেয়েদের। তা ছাড়া, শহুরে কর্মরত মায়ের দরকার তার ছেলেমেয়ের জন্য একটি খেলার সাথী। তাই অনেক সময়ই শিশু দেখাশোনার জন্য নিয়ে আসা হয় আর একটি শিশুকে। হিসাবেও মিলছে সেই ইঙ্গিত। সমীক্ষা অনুযায়ী শহরে পুরুষ শিশুশ্রমিকের হার বেড়েছে ১৫৪ শতাংশ, অন্যদিকে স্ত্রী শিশুশ্রমিকের হার বেড়েছে ২৪০ শতাংশ।


সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন

তবে সারা দেশের হিসাবে শিশু শ্রমে পশ্চিমবঙ্গের স্থান কিন্তু সাতে। ২০১১-র জনগণনা অনুযায়ী এ রাজ্যের শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ৫৫০০৯২, সেখানে প্রথম স্থানে থাকা উত্তরপ্রদেশে সংখ্যাটা ২১৭৬৭০৬। গত এক দশকে পশ্চিমবঙ্গে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা কমেছে ৩৫.৮২ শতাংশ, সেখানে উত্তর প্রদেশে এই সংখ্যাটা বেড়েছে ১২.৯০ শতাংশ।

শহরে শিশু শ্রমের হার বেশি হলেও, এই শিশুরা যে বেশিরভাগই শহরের বাসিন্দা তা নয়। বরং শহরে কাজের সুযোগ অনেক বেশি বলে গ্রাম থেকে শহরে কাজ করতে আসা শিশুর সংখ্যাই বেশি। ফলে ভয়টাও বাড়ে। সমীক্ষাকারী ওই সংস্থার অধিকর্তা (পলিসি এন্ড রিসার্চ) কোমল গনোত্রা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘‘শহরের এই প্রবণতা ভয়ঙ্কর। গ্রামের শিশুরা কাজের সুযোগ নিতে শহরে চলে আসছে, অনেক সময়ই একা থাকছে। এ ভাবে শহরে এসে কাজ করা বাড়িয়ে দিতে পারে শিশু পাচার ঘটনা।’’ তাঁর আক্ষেপ শহরের সচেতনতা বা প্রশসানিক তৎপরতা সত্ত্বেও শিশুশ্রমিক বেড়ে যাচ্ছে।

এই সংক্রান্ত আরও ছবি দেখতে ক্লিক করুন:

ওরা কাজ করে

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE