Advertisement
E-Paper

গুরুজনের কথাটা অন্তত শুনুন, বলছে কংগ্রেস

রাজধর্ম নিয়ে বিজেপির বর্ষীয়ান নেতা লালকৃষ্ণ আডবাণীর মন্তব্যকে ষোলো আনার উপরে আঠারো আনা কাজে লাগাতে তেড়েফুঁড়ে নেমে পড়ল কংগ্রেস। কংগ্রেসের নেতারা মনে করছেন, নিজেদের গোলেই বল মেরেছেন বিপক্ষের প্রবীণ খেলোয়াড়!

শঙ্খদীপ দাস

শেষ আপডেট: ২৯ জুন ২০১৫ ০৩:১৭

রাজধর্ম নিয়ে বিজেপির বর্ষীয়ান নেতা লালকৃষ্ণ আডবাণীর মন্তব্যকে ষোলো আনার উপরে আঠারো আনা কাজে লাগাতে তেড়েফুঁড়ে নেমে পড়ল কংগ্রেস। কংগ্রেসের নেতারা মনে করছেন, নিজেদের গোলেই বল মেরেছেন বিপক্ষের প্রবীণ খেলোয়াড়! সেই বল এ বার গোললাইন পার করিয়ে দিতে হবে কংগ্রেসকেই। সে কারণেই সুষমা স্বরাজ ও বসুন্ধরা রাজের ইস্তফার দাবিতে চাপ বাড়াতে আজ নতুন উদ্যমে দৌড় শুরু করল কংগ্রেস! বল ঠেলল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কোর্টে। আডবাণীর মন্তব্যকে মোদীকে বেঁধার অস্ত্র করছে বাকি বিরোধীরাও।

লালকৃষ্ণ আডবাণী সুষমা-বসুন্ধরার ‘কুকীর্তি’ নিয়ে সরাসরি মন্তব্য না করলেও, রাজধর্মে নৈতিকতার গুরুত্ব বোঝাতে কাল নিজের ইস্তফার প্রসঙ্গ টেনে এনেছিলেন। বোঝাতে চেয়েছিলেন, মানুষের চোখে বিশ্বাসযোগ্য থাকাটাই রাজনীতিকের অন্যতম দায়িত্ব! আডবাণীর এই কটাক্ষকেই সুষমা-বসুন্ধরার ইস্তফার জন্য চাপ বাড়ানোর অস্ত্র করছে কংগ্রেস। তাঁদের বক্তব্য, বিরোধীদের কথায় কান না দিন, দলের গুরুজনদের কথা অন্তত শোনা উচিত মোদীর! নইলে দুর্নীতিকে প্রশ্রয়ের অভিযোগে এ বার খোদ প্রধানমন্ত্রীর ইস্তফার দাবি উঠবে সংসদের ভিতরে-বাইরে।

গত কাল আনন্দবাজারকে এক বিশেষ সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন বিজেপির এক সময়ের লৌহপুরুষ লালকৃষ্ণ আডবাণী। দু’দশক আগে জৈন হাওয়ালা কাণ্ডে তাঁর ইস্তফার সিদ্ধান্ত নিয়ে সেখানে তিনি অকপটে জানান তাঁর মতামত। বলেন, ‘‘রাজনৈতিক নেতার জীবনে মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা রক্ষা করাই সব থেকে বড় ধর্ম। নৈতিকতা কী দাবি করছে, সেটাই রাজধর্ম।’’ যদিও ললিত মোদী কাণ্ডে বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বা রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা রাজের ইস্তফা নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি। আডবাণীর কথায়, ‘‘সে দিন বিবেকের ডাকে সাড়া দিয়েই ইস্তফা দিয়েছিলাম। বাজপেয়ীজির কথাও শুনিনি। আমি কেবল আমার কথাটুকুই বলতে পারি। অন্যেরা কী করবেন, কার কী বিষয়, কার কী সমস্যা, এ সব আমি জানি না। এ সব বিষয়ে কোনও মন্তব্যও করব না।’’

আডবাণীর এই সাক্ষাৎকার নিয়েই জাতীয় রাজনীতিতে সাড়া পড়ে গিয়েছে। তোলপাড় বিজেপির অন্দরেও। এমনকী, বিজেপির অনেক নেতাও ঘরোয়া আলোচনায় স্বীকার করছেন, আডবাণী তাঁদের মনের কথাই বলেছেন। যদিও দলের তরফে এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করা হচ্ছে না।

সাম্প্রতিক কালে আডবাণী যখনই কোনও বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন, দলের বেশির ভাগ মুখপাত্র এই বলে এড়িয়ে গিয়েছেন যে, তিনি দলের প্রবীণতম নেতা। তাঁর বক্তব্য দলের কাছে উপদেশ। কিন্তু আডবাণীর গত কালের মন্তব্যের পরে মুখপাত্ররাও আজ রা কাড়তে চাননি। কারণ, তাঁরা বুঝতে পারছেন তাতে জল আরও ঘোলা হবে। তাই নীরব থাকাটাই বুদ্ধিমানের কাজ।

দলের এক কেন্দ্রীয় নেতা বললেন, ‘‘বসুন্ধরা-সুষমা বিতর্কটি সরাসরি সামলাচ্ছেন নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ এবং অরুণ জেটলি। দুই নেত্রীকে ক্লিনচিট দিয়েও সঙ্কট এখনও কাটেনি। বাদল অধিবেশনের ভবিষ্যৎ নিয়েও উদ্বেগে রয়েছে সরকার। এর মাঝে আডবাণী কেন ধন্দ বাড়ালেন সেটাই আশ্চর্যের।’’ দলের নেতাদের একটি মনে করছেন, আডবাণী নিজের দৃষ্টান্ত দিয়েছেন বটে, কিন্তু সুষমার ইস্তফা হয়তো তিনি চান না। চান বসুন্ধরা পদত্যাগ করুন।

তবে বিরোধীরা স্বাভাবিক ভাবেই জৈন হাওয়ালা কাণ্ডে আডবাণীর ইস্তফার প্রেক্ষাপটেই দেখছেন সুষমা-বসুন্ধরা ঘিরে তৈরি হওয়া বিতর্ককে। তাই যে কংগ্রেস বরাবর আডবাণীকে ‘সাম্প্রদায়িক’ ও ‘বাবরি মসজিদ ধ্বংসের’ নায়ক বলে সমালোচনা করত এত দিন, তাঁকেই আজ ‘উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন’ ও ‘বিবেচক রাজনীতিক’ হিসেবে তুলে ধরে তাঁর ইস্তফার নজিরকে হাতিয়ার করতে দেরি করেনি। রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা গুলাম নবি আজাদ বলেন, ‘‘কোনও ইশারা-ইঙ্গিত নয়, আডবাণী স্পষ্ট ভাষায় মোদীকে বুঝিয়ে দিয়েছেন, সুষমা-বসুন্ধরাকে এখনই তাঁদের পদ থেকে সরানো উচিত। সেটাই নৈতিকতার দাবি।’’

কিন্তু মোদী যদি আডবাণীর কথাও না শোনেন? এই প্রশ্নে গুলাম নবির কটাক্ষ, ‘‘এ সব ব্যাপারে মোদী বরাবরই অবাধ্য জানি। দলের গুরুজনদের কথাও যে তিনি শোনেন না, তার নজিরও রয়েছে।’’ গুজরাত-হিংসার পর তাঁকে রাজধর্ম স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী। তিনি শোনেননি। ওই মর্মান্তিক ঘটনা নিয়ে আজও ক্ষমা চাননি। এই প্রসঙ্গ মনে করিয়ে দিয়ে নবি বলেন, ‘‘এখন আডবাণীর রাজধর্মের পাঠও তিনি না শুনতে পারেন। কারণ, বিজেপিতে তাঁর কাছের নেতারা ইদানীং বলতে শুরু করেছেন, যে সব নেতার ৭৫ বছরের বেশি বয়স হয়েছে, তাঁদের মস্তিষ্ক কাজ করছে না বলে ধরে নেওয়াই ভাল!’’ তবে এই টিপ্পনির পাশাপাশি, নবি বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রীর ভালর জন্যই সুষমা-বসুন্ধরার ইস্তফা জরুরি। নইলে তাঁর ইস্তফার দাবিও উঠবে।’’ কংগ্রেসের আর এক নেতা পি সি চাকোও বলেন ‘‘আডবাণীর কথাতেই স্পষ্ট তিনি দুই নেত্রীর ইস্তফা চান’’ চাকোর দাবি, এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর স্পষ্ট ব্যাখ্যা দেওয়া উচিত। কারণ, আডবাণীর মন্তব্য ‘আম-জনতার মনের কথা’।

কংগ্রেস শুধু নয়, নৈতিকতার প্রশ্ন তুলে বিজেপিকে আক্রমণ করেছেন জেডিইউ নেতা তথা বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারও। তাঁর বক্তব্য, ‘‘ওরা বলে ওরা নাকি অন্য রকম দল। কিন্তু তফাৎটা কোথায়? ওরা নিজেদের লোকদের বাঁচাতেই ব্যস্ত। এটা এখন স্পষ্ট, রাজনৈতিক নৈতিকতার ধার ধারছে না ওরা। আডবাণীজি এ ব্যাপারেই সতর্ক করেছেন দলকে।’’

সুষমা-বসুন্ধরা বিতর্কের জল আদালতেও গড়াতে পারে ভবিষ্যতে। কংগ্রেসের গুলাম নবি এ দিন বলেছেন, ‘‘এই সরকারে যে চোর, সে-ই বিচারক। কিন্তু দেশ থেকে এখনও হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্ট উঠে যায়নি। পলাতক অভিযুক্তকে যে ভাবে বিদেশমন্ত্রী ও রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী সাহায্য করেছেন, তা ফৌজদারি অপরাধ। সুতরাং পালানোর পথ নেই।’’

জরুরি অবস্থা নিয়ে মোদীকে প্রকারান্তরে খোঁচা দিয়ে ক’দিন আগেও বিরোধীদের হাত অস্ত্র তুলে দিয়েছিলেন আডবাণী। তাঁর গত কালের মন্তব্যে আরও উৎসাহিত কংগ্রেস। তাদের এক নেতার বিশ্লেষণ, মোদী, জেটলি, অমিত শাহদের কৌশলটা পরিষ্কার। সুষমা ও বসুন্ধরার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে ওঁরা আপাতত ঘাপটি মেরে থাকতে চাইছেন। ওঁরা হয়তো ভাবছেন, একই ভাঙা রেকর্ড বিরোধীদের পক্ষে বেশি দিন চালানো সম্ভব নয়। সুষমা-বসুন্ধরার সঙ্গে ললিত মোদীর যোগাযোগ নিয়ে রোজ নতুন তথ্য জোগাড় করাও বিরোধীদের পক্ষে মুশকিল। ব্যাপারটা তাই ক্রমে ফিকে হয়ে যাবে। কিন্তু কংগ্রেসের এই নেতা মনে করেন, আডবাণীর গত কালের মন্তব্য বিতর্কটিকে শুধু জিইয়ে রাখতে সাহায্য করল না, মোদীকেও অস্বস্তিতে ফেলে দিল।

কংগ্রেস নেতাদের আশা, আডবাণী এ ভাবে মুখ খোলার পর মুরলীমনোহর জোশী বা তাঁর মতো বিজেপির আরও কিছু মোদী-বিরোধী শিবিরের নেতা ক্রমশ মুখ খুলবেন। কীর্তি আজাদের মতো নেতারা ইতিমধ্যেই দলের অস্বস্তি বাড়াতে শুরু করেছেন। ললিত-পর্ব বিজেপির অন্দরে কোন্দল আরও বাড়বে।

ললিত-কাণ্ডে আজ নতুন একটি বিতর্কও সামনে এসেছে। ললিত মোদীর পাসপোর্ট ও অভিভাসন সংক্রান্ত তথ্য জানতে চেয়ে বিদেশ মন্ত্রকের কাছে এক ব্যক্তি তথ্যের অধিকার আইনের আওতায় আবেদন জানিয়েছিলেন। কিন্তু বিদেশ মন্ত্রক সেই আবেদন খারিজ করে দিয়েছে। আজ তা নিয়েও সরকারের সমালোচনা করেন কংগ্রেস নেতারা। কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা দিগ্বিজয় সিংহের অভিযোগ, সরকারের কুকীর্তি যাতে ফাঁস না হয়ে যায় সে জন্যই মোদী তথ্য কমিশনকে অকেজো করে রাখতে চেয়েছিলেন। এটা আগে সন্দেহ ছিল, এখন বোঝা যাচ্ছে সেটাই আসল কারণ। কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধী সংসদে সরব না হলে মুখ্য তথ্য কমিশনার নিয়োগ এত দিনেও হতো না। দিগ্বিজয়ের কথায়, ‘‘তথ্য লুকিয়েও এখন আর লাভ নেই। ইতিমধ্যেই যে সব তথ্য ফাঁস হয়েছে, সুষমা-বসুন্ধরার ইস্তফার জন্য সেগুলিই যথেষ্ট। কংগ্রেসের স্পষ্ট দাবি, সুষমা-বসুন্ধরাকে ইস্তফা দিতে হবে। নইলে কী ভাবে ইস্তফা আদায় করতে হয়, কংগ্রেস তা জানে।’’

lalit modi issue cong suggest modi advani advani advise gulam nabi azad abpnewsletters cong modi advani
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy