Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪

বিজেপিকে রুখতে ভাষাই বর্ম কংগ্রেসের

ধর্মে বিজেপি, ভাষায় কংগ্রেস। বিধানসভা ভোটের জন্য এ ভাবেই তৈরি হচ্ছে বরাক উপত্যকার দুই প্রধান রাজনৈতিক শক্তি। ধর্মের নামে ভোট আদায়ের কৌশল বিজেপির নতুন নয়। বিষয়টিতে তাদের কোনও রাখঢাকও নেই। এটিই আশঙ্কার কারণ হয়েছে স্থানীয় কংগ্রেস নেতাদের। বিধানসভা ভোটকে সামনে রেখে বরাকে গেরুয়াবাহিনীর শক্তি যত বাড়ছে, তত সংগঠিত হচ্ছে এআইইউডিএফ-ও।

উত্তম সাহা
শিলচর শেষ আপডেট: ১৫ জুন ২০১৫ ০৫:২০
Share: Save:

ধর্মে বিজেপি, ভাষায় কংগ্রেস।

বিধানসভা ভোটের জন্য এ ভাবেই তৈরি হচ্ছে বরাক উপত্যকার দুই প্রধান রাজনৈতিক শক্তি।

ধর্মের নামে ভোট আদায়ের কৌশল বিজেপির নতুন নয়। বিষয়টিতে তাদের কোনও রাখঢাকও নেই। এটিই আশঙ্কার কারণ হয়েছে স্থানীয় কংগ্রেস নেতাদের। বিধানসভা ভোটকে সামনে রেখে বরাকে গেরুয়াবাহিনীর শক্তি যত বাড়ছে, তত সংগঠিত হচ্ছে এআইইউডিএফ-ও। কংগ্রেস তাই ‘এক ঢিলে দুই পাখি মারতে’ বিজেপিকেই প্রধান লক্ষ্য করছে। মোদী-হাওয়া রুখতে সব রকম চেষ্টা করে চলেছে। এ ক্ষেত্রে ‘বর্ম’ হিসেবে হাতে তুলেছে ভাষা-প্রসঙ্গ।

উপত্যকায় কংগ্রেস শিবিরকে একজোট করে ভোট-রণনীতি ঠিক করতে এআইসিসি সাধারণ সম্পাদক সিপি জোশী বরাক সফরে এসেছেন। তাঁকে নিয়ে জনসভা বা দলীয় আলোচনা— সব সময়ই দলীয় নেতারা ভাষার প্রতি বরাক উপত্যকার আবেগকে কাজে লাগাতে চাইছেন। শুক্রবার শিলচরই হোক, আজ করিমগঞ্জ-হাইলাকান্দির জনসভা— সি পি জোশী থেকে শুরু করে স্থানীয় সাংসদ সুস্মিতা দেব, অসমের প্রদেশ সভাপতি অঞ্জন দত্ত-ও বারবার ভাষাশহিদদের স্মরণ করেন।

বিজেপির প্রদেশ সভাপতি সিদ্ধার্থ ভট্টাচার্য গত মাসে শিলচরে সাংবাদিক সম্মেলন করে বলেছিলেন— ‘অসমে বসবাসকারী সবাই অসমিয়া। বিষয়টি বরাকবাসীর ভাবাবেগে প্রচণ্ড আঘাত করে। ১৯ মে ভাষাশহিদ দিবসে জায়গায় জায়গায় তাঁর বক্তব্যে ধিক্কার জানানো হয়। পথনাটকে সাংস্কৃতিক কর্মীরা তাঁকে খলনায়ক করেন।

কংগ্রেস নেতারা এখন ওই প্রসঙ্গটিকেই বিধানসভা নির্বাচন পর্যন্ত জিইয়ে রাখতে চান। কয়েক দিন আগে কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি শিলচর ঘুরে গিয়েছেন। এই সপ্তাহে করিমগঞ্জে দক্ষিণ অসমের চার জেলার পদাধিকারীদের নিয়ে বৈঠক করেছে বিজেপি। সেখানে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়াল এবং দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক রামলাল উপস্থিত ছিলেন। নানা সমস্যার কথা তুলে তাঁরা অসমে বিজেপি সরকার গড়ার আহ্বান জানান।

স্মৃতি-রামলাল-সর্বানন্দের প্রচার-ঝড়ে লাগাম টানতে কংগ্রেস সি পি জোশীকে এনে জনসভার উদ্যোগ নেয়। সঙ্গে ছিলেন প্রদেশ সভাপতি অঞ্জন দত্ত। পরিকল্পনা মতোই প্রকাশ্য সভায় ভাষার আবেগ উস্কে দেন নেতারা। জোশীর মন্তব্য ছিল, ‘‘এমন কোন জায়গা রয়েছে, যেখানে ভাষার জন্য মানুষ প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন! আমার কাছে এ জন্যই শিলচর একটি আদর্শ জায়গা।’’ জোশীর দাবি, সরকার সেই ভাষাকে স্বীকৃতি দেওয়ায় বঙ্গভাষীরা এখানে গর্বের সঙ্গে বসবাস করছেন।

প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অঞ্জন দত্তের প্রশ্ন— ‘বরাকে অসমিয়া ভাষা লাগে, এ আবার কেমন কথা!’ তিনি সারা অসম ছাত্র সংস্থা আসু-র বিরুদ্ধে এ নিয়ে তোপ দাগেন। ওই ছাত্র সংগঠনেরই সভাপতি ছিলেন বর্তমান কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়াল। এই ইঙ্গিত করে তিনি সিদ্ধার্থ-সর্বানন্দকে বঙ্গভাষী-বিদ্বেষী হিসেবে তুলে ধরেন।

সাংসদ সুস্মিতা অবশ্য সোজাসুজিই সর্বানন্দকে বাঙালির শত্রু হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি ১৯৮৩ সালের আইএমডিটি আইনের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ‘‘বঙ্গভাষীদের সুরক্ষায় ইন্দিরা গাঁধী ওই আইন লাগু করেছিলেন। তাতে বলা হয়েছিল, অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করলে তাঁর অভিযোগের সত্যতা প্রমাণের দায় পুলিশের উপরই বর্তায়।’’ সুস্মিতাদেবীর অভিযোগ, সর্বানন্দ সোনোয়াল সুপ্রিম কোর্টে রিট পিটিশন করে সেই আইন খারিজ করেন। তার জেরেই এখন যাঁকে-তাঁকে বাংলাদেশি বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। হেনস্থার মুখে পড়ছেন সাধারণ মানুষ।

শরণার্থীদের নাগরিকত্ব প্রদানের দাবির বিরোধিতা না করলেও সুস্মিতাদেবী ‘শরণার্থী’ শব্দ প্রয়োগের বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন, ‘‘আমরা ২০১৪ সালের ভোটার তালিকার ভিত্তিতে নাগরিকত্ব প্রদানের দাবি করছি। শরণার্থী নয়, অধিকার হিসেবেই বরাকের সবাই নাগরিকত্ব পাবেন।’’

জনসভায় মুখ্যমন্ত্রীর উপদেষ্টা গৌতম রায়, রাজ্যের পরিবহণ মন্ত্রী অজিত সিংহ, জেলা কংগ্রেস সভাপতি কর্ণেন্দু ভট্টাচার্য, সাধারণ সম্পাদক জালাল আহমদ মজুমদারও বক্তব্য রাখেন। কারামন্ত্রী গিরীন্দ্র মল্লিক-সহ কাছাড়ের সব কংগ্রেস বিধায়ক মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন। একমাত্র গাড়ি চুরি মামলায় জামিনে মুক্ত বড়খলার বিধায়ক রুমি নাথকে সভাস্থলে দেখা যায়নি। রুমিদেবী এই সময়ে শিলচরে থাকলেও, কংগ্রেসের এক সূত্রে জানা গিয়েছে, দলীয় নেতৃত্বই তাঁকে সভায় না যেতে বলে দিয়েছিল।

সর্বানন্দ সোনোয়াল শিলচর বিধানসভা আসনের উপনির্বাচনের আগে ঘোষণা করেছিলেন— শিলচর শহরকে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকল্পে স্মার্ট সিটি হিসেবে গড়ে তোলা হবে। জোশী এ দিন তাঁকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলেন, ‘‘পারলে শিলচরকে স্মার্ট সিটি হিসেবে গড়ে ২০১৬ সালের ভোটে লড়তে আসুন। তা করতে পারলে আমরা বরাকে ভোট চাইব না।’’

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকেও তুলোধোনা করেন এআইসিসি সাধারণ সম্পাদক। তিনি একের পর এক প্রশ্ন তোলেন— বিশ্ববাজারে তেলের দাম ৫০ শতাংশ কমলেও, ভারতে সেই হারে কমেনি কেন? কর্পোরেট ট্যাক্স কমিয়ে সার্ভিস ট্যাক্স বাড়ানো হল কাদের স্বার্থে। বিদেশের ব্যাঙ্কে রাখা কালো টাকার কতটা ফিরিয়েছেন মোদী? কার কার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ঢুকেছে সেই টাকা? জোশীর কথায়, ‘‘ধর্মের কথা বলে, মন্দির তৈরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোট আদায় করা যায়। কিন্তু দেশ চালানো বড় কঠিন।’’ গণতন্ত্রের সামনে বড় বিপদ এসেছে বলে তিনি বরাকের মানুষকে সতর্ক করে দেন। বিপদ থেকে উত্তরণের উপায়ও জানান। তা হল, অসমে কংগ্রেস সরকার গড়ে মোদীকে নিয়ন্ত্রণ করা।

কংগ্রেস অবশ্য শুধু হিন্দুভোটে থাবা পড়বে বলেই বিজেপি-কে নিয়ে চিন্তিত নয়। তাদের কাছে আশঙ্কার কথা, হিন্দুরা যত সংগঠিত হবে, সংখ্যালঘুরাও দলমত নির্বিশেষে এআইইউডিএফ-এর পতাকায় সামিল হবে। সে ক্ষেত্রে কংগ্রেসের চিরাচরিত ভোটব্যাঙ্কে বড় ধরনের টান পড়তে পারে। সেই ভাবনা থেকে শাস্তির মেয়াদ ফুরনোর আগেই সম্প্রতি প্রাক্তন মন্ত্রী মিসবাহুল ইসলাম লস্করকে দলে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। পাশাপাশি এআইইউডিএফ থেকে বিতাড়িত বিধায়ক আতাউর রহমান মাঝারভুঁইয়াকেও কাছে টানার চেষ্টা চলছে। রাজ্যসভা নির্বাচনে মাঝারভুঁইয়া ভোট না দেওয়ায় কংগ্রেস জিতে যায়। দু’বছর থেকে আতাউর কার্যত দলহীন বিধায়ক। অঞ্জন দত্ত এ বার বরাকে এসে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁর বাড়িতে নৈশাহারও সারেন। তবে এ নিয়ে অঞ্জনবাবু বা আতাউরবাবু এখনই প্রকাশ্যে কিছু বলতে নারাজ।

বরাক উপত্যকার তিন জেলায় মোট ১৫টি বিধানসভা আসন রয়েছে। এর মধ্যে ১৩টি এখন কংগ্রেসের দখলে। এআইইউডিএফ টিকিটে নির্বাচিত আতাউর রহমান মাঝারভুঁইয়া ভোটের আগে কংগ্রেসে যোগ দিলে সংখ্যাটি ১৪তে পৌঁছবে। ২০১৬ সালের নির্বাচনে কতগুলি আসন তাঁরা ধরে রাখতে পারবেন, এই প্রশ্নই ভাবিয়ে তুলছে বরাকের কংগ্রেস নেতাদের। বিশেষ করে চিন্তিত সাংসদ সুস্মিতা দেব ও মুখ্যমন্ত্রীর উপদেষ্টা গৌতম রায়। ভাষার আবেগ সিদ্ধার্থ ভট্টাচার্যকে আপাতত খলনায়ক করলেও ভোটের বাক্সে কী প্রভাব পড়ে, তা-ই এখন খতিয়ে দেখছে রাজনৈতিক শিবির।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE