প্রবেশ নিষেধ। পর্যটকহীন হেরিটেজ হোটেল। —নিজস্ব চিত্র।
ফটকের দু’দিকে দুই থামের উপর পাথরের সিংহ। লোহার ফটক অবশ্য তালা বন্ধ। দেড় মানুষ সমান পাঁচিল। তার উপরে কাঁটাতার। গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে নজর করা শক্ত, ১৩ একর জমির উপর দাঁড়িয়ে থাকা রাজ নিবাস প্যালেস হোটেলের অন্দরে কী হচ্ছে! নজরে আসে ফটকের ও ধারে ইতিউতি কয়েক জন ঘাস কাটা, আগাছা সাফ করার মতো কাজ করছেন। হাঁক পেড়ে কিছু জিজ্ঞেস করলেই ছিটকে যাচ্ছেন। বাইরে থেকে ছবি তোলার চেষ্টা করতেইও এল কড়া হুমকি, ‘ইয়ে প্রাইভেট প্রপার্টি হ্যায়।’
ক্যামেরা হাতে অপরিচিতকে উঁকিঝুঁকি মারতে কাঁধে টোকা মারলেন এক জন। মুখ ভর্তি গুটখা। না ধমক নয়, এল কৌতুকের আবদার, ‘‘হামারা ভি ফোটো খিঁচিয়ে না!’’ জানা গেল, স্থানীয় বাসিন্দা। শক্তিকান্ত কুশওয়াহা।
আবদারের অবশ্য কারণ আছে। সারা দিন টিভির পর্দায় ঢোলপুরের এই রাজপ্রাসাদ নিয়েই বাগ্বিতণ্ডা। নেতা-মন্ত্রীদের পিছনে ছুটছে টিভি ক্যামেরা। সকলেই জানতে চায়, ঢোলপুরের এই রাজপ্রাসাদ এখন কার? সরকারের না ‘মহারানি’ ও রাজপুত্রের? এই হোটেল ব্যবসায় নাকি ললিত মোদীর কালো টাকা খাটছে? বসুন্ধরা রাজেকে কি ঢোলপুর-কাণ্ডে পদত্যাগ করতে হবে? গোটা দেশের মতো এই সব প্রশ্ন ভাবাচ্ছে ঢোলপুরকেও। তবে রাজনীতির চাপানউতোর বা আদালতের কাগজপত্র যা-ই বলুক, ঢোলপুরের মানুষের কাছে বরাবরই এই প্রাসাদ মহারানি ও তাঁর ছেলের। কিন্তু মহারানির সেই প্রাসাদ ঘিরেই এখন শুধু সম্ভ্রম নয়। তার সঙ্গে ভয় ও চেপে রাখা বিরক্তি। আর বেশ খানিকটা রহস্যও।
প্রাসাদে বিদেশিদের আসা নিয়ে কৌতূহল ছিলই। কী হয় প্রাসাদের ভিতরে, প্রশ্ন ছিল স্থানীয় মহলে। তাঁরাই জানালেন, নতুন করে রহস্যের শুরু কংগ্রেসের জয়রাম রমেশ দিল্লিতে যে দিন ঢোলপুর প্রাসাদকে হাতিয়ার করে বসুন্ধরা-ললিতের আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ তোলেন, তার ক’দিন আগেই। বিদেশিরা সাধারণত এখানে থেকে আগরা, গ্বালিয়র ঘুরে বেড়ান। চম্বলে নৌবিহার করেন। ঘুরে আসেন ভরতপুরের জঙ্গলে। এক দিন দেখা গেল চম্বল থেকে হোটেলের নৌকোগুলি তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। জঙ্গল সাফারির আয়োজনও কী কারণে গুটিয়ে ফেলা হচ্ছে দ্রুত। গাড়িগুলি সব প্রাসাদে ফিরে গিয়েছে। তালা হেরিটেজ হোটেলের ফটকে। সব ‘বুকিং’ বাতিল। নতুন কোনও বুকিংও নেওয়া হচ্ছে না দিল্লি থেকে। কংগ্রেস অভিযোগ তোলার পরে এ সব হলে স্বাভাবিক মনে হতো। কেন তার আগেই গা ঢাকল হোটেল? স্থানীয়দের কাছে এ এক রহস্যই বটে। ঢোলপুরের প্রাসাদে কারা আসছেন, এখন রহস্য তাঁদের নিয়েও। ক’দিন আগেই দিল্লি থেকে তদন্তকারী সংস্থার একটি দল ঢোলপুরে ঘুরে গিয়েছে। কীসের জন্য? জানতে চায় ঢোলপুর।
ফটকের বাইরে শক্তিকান্তরা হালফিল তারিয়ে উপভোগ করেছেন এই রহস্য আর হঠাৎ কৌতূহলী হয়ে ওঠা বাইরের লোকদের আনাগোনা। তবে তাঁরাও জানেন, যত শোরগোল প্রাসাদ নিয়ে, আসল ঢোলপুরের কথা কেউ ভাবে না। ক’দিন পরেই ফের ঢোলপুরকে ভুলে যাবে সকলে। কেউ জানতে চাইবে না, কেমন আছেন ঢোলপুরের শক্তিকান্তরা।
রাজস্থানের মানুষ বরাবরই রাজঘরানার সম্মান করেন। ব্যতিক্রম নয় ঢোলপুরও। এখানকার শেষ স্বীকৃত রাজা হেমন্ত সিংহ এ-মুখো হন না। দিল্লিতেই থাকেন। ঢোলপুরের মহারানি বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়াকে এখনও সম্ভ্রম করেন এখানকার মানুষ। হেমন্ত সিংহের সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে হয়ে যাওয়ার এত বছর পরেও। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে? শক্তিকান্তর পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘মহারানি মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে বসেছেন। আমাদের কী লাভ হয়েছে বলুন তো?’’ লাভ যে হয়নি, তা ঢোলপুরে দু’চক্কর ঘুরলেই স্পষ্ট। উন্নয়ন বা নাগরিক পরিষেবা বলতে কিছুই নেই। সন্ধে হলেই লোডশেডিং। চাষআবাদ বাদ দিলে হাতে গোনা কয়েকটি কারখানা। সম্বল বলতে পাথরের ব্যবসা। ঢোলপুরের লাল পাথর দিয়েই লাল কেল্লার মতো দিল্লির বহু অট্টালিকা তৈরি হয়েছে। কিন্তু ঢোলপুরের নিহালগঞ্জের ভাঙা কোঠি ভাঙাই থেকে গিয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরার প্রসঙ্গ তুলতেই বিরক্তিতে মুখ ভরে গেল মনীশ গয়ালের। জগন মার্কেটে জামাকাপড়ের দোকানে বসে আক্ষরিক অর্থেই মাছি তাড়াতে তাড়াতে মনীশের জবাব, ‘‘ওই সব রাজঘরানা, গ্ল্যামার দিয়ে বেশি দিন চলে না। মহারানি ঢোলপুর বিধানসভা থেকে ভোটে দাঁড়িয়ে এক বার হেরে তা টের পেয়েছেন।’’ মাঝেমাঝে জয়পুর থেকে ছুটি কাটাতে আসেন বসুন্ধরা। বিধানসভা ভোটের আগে এই প্যালেসে বসেই টিকিট বিলি করেছিলেন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরাকে আর কাছে পায়নি ঢোলপুর।
ইতিহাস বলছে, চম্বল নদীর ধার ঘেঁষে ৭০০ খ্রিস্টাব্দে রাজা ঢোলন দেও তোমর ঢোলপুর পত্তন করেন। ১০৫০ খ্রিস্টাব্দে নতুন করে শহর তৈরি করেন রাজা ধবলদেও। তার পর সুলতান, মুঘল, ব্রিটিশ, রাজপুতানা— সব শাসকেরই পা পড়েছে এই ঢোলপুরে। গ্বালিয়রকে শত্রুদের হাত থেকে বাঁচাতে শেরশাহ সুরি এখানে কেল্লাও গড়েছিলেন। যার নাম শেরগড় ফোর্ট। ঢোলপুর কুখ্যাত ছিল চম্বলের ডাকাতদের জন্যও।
ফের ঢোলপুর নজর কাড়ছে এর রাজ নিবাস প্যালেসের দৌলতে। তৈরি হয় ১৮৭৬-এ, সপ্তম এডওয়ার্ডকে স্বাগত জানাতে। এখন যা ‘ক্লাসিফায়েড হেরিটেজ হোটেল’। চিন ও ইউরোপের টাইল দিয়ে সাজানো, রাজকীয় ঘরে বেলজিয়ান কাচ, পারস্যের কার্পেট, আঠারো শতকের পিয়ানো। প্রাসাদের ঘরগুলো নাকি এতই বড়, এ-মাথা ও-মাথা করতে পা ব্যথা হয়ে যায়। বিদেশিদের বিলাসের হরেক আয়োজন থাকলেও ঢোলপুরের ঐতিহ্য ও ইতিহাসকে দেশীয় পর্যটকদের সামনে তুলে ধরার কোনও চেষ্টা হয়নি। তাই রাজ নিবাস প্যালেস ছাড়া আর কোনও ভাল হোটেল নেই ঢোলপুরে।
নিহালগঞ্জের বৃদ্ধ শের সিংহ শেখাওয়াত গল্প বলছিলেন, মুঘল জমানায় নুরজাহান ও শাহজাহানের মধ্যে ঢোলপুর নিয়ে লড়াই হয়েছিল। এখন লড়াই কংগ্রেস-বিজেপিতে। এক বার কংগ্রেস তো পরের বার বিজেপি। বেশির ভাগ সময়ই যে দল রাজ্যে ক্ষমতায় আসে, অন্য দল জেতে ঢোলপুরে। জাতপাতের হিসেবে এ বার বিএসপি-র বি এল কুশওয়াহা জিতে বিধায়ক হয়েছিলেন। খুনের মামলায় গত বছর থেকে তিনি জেলবন্দি। ঢোলপুর আটক অনুন্নয়নের খাঁচায়।
শুধু অনুন্নয়ন নয়। ক্ষোভ অনেক হেরিটেজ হোটেল ঘিরেও। প্রাসাদের পাঁচিল অন্তত ৩০-৪০ ফুট এগিয়ে এনে বাড়তি জমি দখল করা হয়েছে। পাঁচিলের গায়ে পাথর বোঝাই করে রাখলে ‘খাজনা’ দিতে হয়। প্রাসাদের সামনে নেহরু-সুভাষ-গাঁধীর নামে তিনটি পার্ক ছিল। রাতারাতি সেগুলো উধাও হয়ে গিয়ে ‘মডার্ন পার্ক’ তৈরি হয়েছে, শুধু প্রাসাদের রাস্তা বানানোর জন্য। কোনও সরকারি অনুমতি ছাড়াই। ঢোলপুর জানে, এ সব
নিয়ে লেখালেখি করায় স্থানীয় একটি পত্রিকার সাংবাদিকের হাত-পা ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। দিল্লিতে কংগ্রেস নেতারা রোজ ঢোলপুরের কেলেঙ্কারির এক-এক কিস্সা ‘খুলাসা’ করছেন। কিন্তু ঢোলপুরের কংগ্রেস নেতারা মুখে রা কাড়তে নারাজ। আর
বিজেপি নেতারা?
কথা বলার অনুমতি নেই তাঁদের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy