Advertisement
০৬ মে ২০২৪

শরিফের আশ্বাসেও বরফ গলবে তো

সপ্তাহখানেক আগেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, ‘সামনের বছর ইসলামাবাদে আমি তো যেতেই চাই। কিন্তু সন্ত্রাস আর শান্তি দু’টো কি এক সঙ্গে চলে! সন্ত্রাস নিয়ে যদি নওয়াজ শরিফ সুনির্দিষ্ট আশ্বাস দেন, তবেই যাব’।

সৌহার্দ্য। শুক্রবার রাশিয়ার উফায় একটি বৈঠকে নওয়াজ শরিফ এবং নরেন্দ্র মোদী। ছবি: পিটিআই।

সৌহার্দ্য। শুক্রবার রাশিয়ার উফায় একটি বৈঠকে নওয়াজ শরিফ এবং নরেন্দ্র মোদী। ছবি: পিটিআই।

জয়ন্ত ঘোষাল
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১১ জুলাই ২০১৫ ০০:০৭
Share: Save:

সপ্তাহখানেক আগেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, ‘সামনের বছর ইসলামাবাদে আমি তো যেতেই চাই। কিন্তু সন্ত্রাস আর শান্তি দু’টো কি এক সঙ্গে চলে! সন্ত্রাস নিয়ে যদি নওয়াজ শরিফ সুনির্দিষ্ট আশ্বাস দেন, তবেই যাব’।

আজ নওয়াজ আশ্বাস দিয়েছেন। ঠিক যেমন আশ্বাস তিনি ’৯৯-এর ফেব্রুয়ারিতে ঐতিহাসিক লাহৌর বাসযাত্রার সময় দিয়েছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ীকে। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। ভারতীয় এক কূটনীতিক আজ সাউথ ব্লকে টেলিভিশনের পর্দায় মোদী-নওয়াজের ছবি দেখতে দেখতে বললেন, ‘‘আমরা ঘরপোড়া গরু তো! তাই সাদা পায়রা ওড়াতে গেলেও একটা ভীতি কাজ করে!’’ অবসরপ্রাপ্ত এক কট্টরপন্থী কূটনীতিক, যিনি বাজপেয়ী

জমানায় পাকিস্তানের দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম-সচিব ছিলেন, সেই বিবেক কাটজু তো বলেই বসলেন, ‘‘পাকিস্তানের সদিচ্ছা নিয়ে আমার কিন্তু এখনও সিনিসিজম আছে!’’

মনে পড়ছে ১৯৯৮-এর জুলাই মাসের কথা। কলম্বোয় সার্ক সম্মেলনে গিয়েছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী। সেটা ছিল প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর প্রথম বিদেশ সফর। তাজসমুদ্র হোটেলে পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন বাজপেয়ী। সেই দ্বিপাক্ষিক বৈঠক কিন্তু বাহ্যত সফল হয়নি। বিশাল সভাগৃহে প্রথমে সাংবাদিক বৈঠক করেছিলেন বাজপেয়ী। তিনি বলেছিলেন, ‘‘ভারত শান্তি চায়। সন্ত্রাস নয়। আমি আলোচনার পক্ষে।’’ সাংবাদিক সম্মেলন শেষে টেবিলের উপরে রাখা ভারতের জাতীয় পতাকা নিয়ে চলে যান এসপিজি-রা। কিন্তু টেবল ক্লথ বদলাননি। তার উপরে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা রেখে সাংবাদিক সম্মেলন করেন নওয়াজ শরিফ। তিনি বলেছিলেন, ‘‘দ্বিপাক্ষিক বৈঠক ব্যর্থ।’’ সেই সাংবাদিক সম্মেলনে বসেই কাশ্মীরিদের উপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুললেন তিনি। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর তৎকালীন মিডিয়া উপদেষ্টা অশোক টন্ডনের সঙ্গে একদম পিছনে দাঁড়িয়েছিলাম। টন্ডন স্বগতোক্তি করে বলেছিলেন, ‘‘কী অদ্ভুত ব্যাপার! বৈঠকে এত ক্ষণ পঞ্জাবের ব্যবসা-বাণিজ্যের কথা বললেন ভদ্রলোক। আর সাংবাদিক সম্মেলনে বিদ্রোহ!’’ বাজপেয়ী কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হননি। ওই বছরেরই সেপ্টেম্বরে রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভায় নওয়াজের সঙ্গে বৈঠক হয় বাজপেয়ীর। নিউ ইয়র্ক প্যালেস হোটেলে সে দিন দেখেছিলাম বাজপেয়ী ও নওয়াজের যৌথ সাংবাদিক সম্মেলন। ঘোষণা

হয়, লাহোর বাসযাত্রার নীল নকশা। নিউ ইয়র্কের এক মার্কিন সাংবাদিক সে দিন এই প্রতিবেদককে

বলেছিলেন, ‘‘এই দৌত্যে এখন মার্কিনিরাও খুব সক্রিয়।’’

’৯৯-এর ফেব্রুয়ারি মাসে শান্তির বার্তা নিয়ে বাজপেয়ীর সঙ্গে লাহৌর পৌঁছেছিলাম। তখন সেখানে সেনাপ্রধান পারভেজ মুশারফ। বাজপেয়ীকে স্বাগত জানাতে তিন সেনাপ্রধানই সে দিন অনুপস্থিত ছিলেন। এমনকী, লাহৌর দুর্গের কাছে বাজপেয়ীর কনভয়ের সামনে কিছু জেহাদি গোষ্ঠী বিক্ষোভ পর্যন্ত দেখায়। সে সব কথা তুললে তৎকালীন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ব্রজেশ মিশ্রের বক্তব্য ছিল, ‘‘শান্তির প্রক্রিয়া যখন শুরু হয়, তখন এ ধরনের কিছু লোকজন তা সব সময়েই ভেস্তে দেওয়ার চেষ্টা করে। তোমরা এ সব নিয়ে বেশি প্রচার করো না। এতে এদের মদত দেওয়া হবে।’’ তার পর কন্দহর-কার্গিল সেই ইতিহাস তো আমাদের সকলের জানা। আর শান্তির দৌত্য করতে গিয়ে সেনা অভ্যুত্থানের শিকার হন নওয়াজ শরিফ।

মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে সার্কের রাষ্ট্রপ্রধানদের ডেকে একটি চমক সৃষ্টি করেছিলেন। তখনও কেউ কেউ বলেছিলে, নওয়াজ শরিফের সঙ্গে এখনই দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করার কী আছে! সার্কের রাষ্ট্রপ্রধানেরা এসে শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েই তো ফিরে যেতে পারেন। এত মাখামাখির দরকার নেই বলেই মত দেন অনেকে। মোদী কিন্তু সেই যুক্তি না মেনে নওয়াজের সঙ্গে মুখোমুখি বৈঠকে বসেন। আরএসএস তথা সঙ্ঘ পরিবার পাকিস্তানের সঙ্গে সখ্য রচনার প্রশ্নে বরাবরই সংশয়ী। এ নিয়ে বিজেপির মধ্যেও দোলাচল রয়েছে। জম্মু-কাশ্মীরের নির্বাচনের মুখে জম্মুর হিন্দু ভোটকে সুসংহত করার কৌশলে পাকিস্তানের সঙ্গে রাজনৈতিক সংঘাতে যাওয়ার প্রয়োজন অনেকে অনুভব করেন। পাক হাইকমিশনের সঙ্গে হুরিয়ত নেতাদের বৈঠকের জেরে দু’দেশের বিদেশসচিব পর্যায়ের আলোচনা ভেস্তে যায়। কাশ্মীর সীমান্তে পাক হানা বাড়তে থাকে। ফলে পাকিস্তান নিয়ে একটি কট্টরবাদী লাইন নিতে শুরু করে মোদী সরকার। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যস্থতাকারী প্রাক্তন কূটনৈতিক লাম্বা কিন্তু মোদীর সঙ্গে দেখা করে বলেছিলেন, ‘‘এই প্রতিক্রিয়াটা বোধহয় একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। কারণ হুরিয়ত নেতাদের সঙ্গে তো বাজেপীয়-আডবাণীও আলোচনা করতেন।’’ পাক হাইকমিশনে হুরিয়ত নেতাদের আসাটাও নতুন নয়। আর তা ছাড়া হুরিয়ত নেতারা তো দিল্লির অনুমতি নিয়েই ওই বৈঠকে যোগ দিতে এসেছিলেন। তা না হলে তো তাদের বিমানবন্দরেই আটক করা হতো।

পাকিস্তানের আচরণের প্রতিবাদে ২০০২-এ ইসলামাবাদের সার্ক সম্মেলন বয়কট করেছিলেন বাজপেয়ী। ফলে সেই সম্মেলনটিই ভেস্তে যায়। পরে অবশ্য আগরা সম্মেলনে মুশারফকে ডেকে সেই শান্তিপ্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন বাজপেয়ী। মূলত তৎকালীন উপপ্রধানমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আডবাণীর কট্টর মনোভাবের কারণে সেই বৈঠকও ভন্ডুল হয়ে যায়। এখন মোদীও বুঝতে পারছেন, সংঘাত-সন্ত্রাস যাই হোক, দু’টি পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রের সামনে আলোচনা ছাড়া আর কোনও রাস্তা খোলা নেই। মনমোহন সিংহও পাকিস্তান যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভোটের রাজনীতির কথা মাথায় রেখে কংগ্রেস তাঁকে যেতে দেয়নি। শর্ম-অল-শেখের যৌথ বিবৃতিতে কাশ্মীরের পাশাপাশি বালুচিস্তান নিয়ে পাক আশঙ্কার কথা অন্তর্ভুক্ত করে দেশে বিতর্কের ঝড় তুলেছিলেন মনমোহন। দিল্লিতে কর্মরত এক পাক কূটনীতিক বলেন, ‘‘মনমোহন সিংহ চেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি দুর্বল প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। আর তখন বিজেপি কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু তোষণের বিষয়টি তুলে রাজনীতি করত। এখন বিজেপির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর পক্ষে ২৮২টি আসনের কর্তৃত্বের জোরে পাকিস্তান নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া অনেক সহজ।’’ আর যাই হোক, বিজেপি-র বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু তোষনের অভিযোগ তোলা যাবে না। পাকিস্তান তাই সব সময় মনে করে বিজেপি জামানাতেই ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করা সহজ হয়।

মোদী সরকার অবশ্য নওয়াজকে বিপদে ফেলতে চায় না। কারণ, পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সেনা-আইএসআই-জেহাদি গোষ্ঠীর কাছে নওয়াজ খুব প্রিয়পাত্র নন। তাই নওয়াজের আশ্বাসে প্রকাশ্যে ভারত সবটা জানিয়ে দিয়েও বাজপেয়ীর ভুল আজ করতে চান না মোদী। আডবাণীর সঙ্গে যখন পাকিস্তান গিয়েছিলাম, তখন আডবাণীর সঙ্গে বৈঠকে মুশারফ স্বীকার করেন, কাশ্মীরে পাকিস্তানের জঙ্গি ঘাঁটি রয়েছে। তিনি আশ্বাস দিয়েছিলেন, সেই ঘাঁটিগুলি ধ্বংস করার। যাতে ভারত-বিরোধী সন্ত্রাস বন্ধ করা সম্ভব হয়। তখন পারভেজ ছিলেন আমেরিকার ‘গুড বয়’। শিবশঙ্কর মেনন তখন ছিলেন পাকিস্তানে কর্মরত ভারতীয় হাইকমিশনার। তিনি আডবাণীকে পরামর্শ দিয়ে বলেছিলেন, পারভেজের এই আশ্বাস নিয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুলবেন না। তাতে পারভেজের পক্ষে ব্যবস্থাগ্রহণ করা কঠিন হবে। এবং তাঁকে বিবৃতি দিয়ে বিষয়টি অস্বীকার করতে হবে। সেই পরামর্শ মেনে নেন আডবাণী। পারভেজের প্রতিশ্রুতি নিয়ে সে যাত্রায় মুখ খোলা থেকে বিরত থাকেন আডবাণী। সে দিন কংগ্রেস অভিযোগ করেছিল, পাকিস্তানের আশ্বাস কোথায়! আজ আবার সেই কংগ্রেসই অভিযোগ তুলছে, সন্ত্রাস নিয়ে নওয়াজ শরিফের আশ্বাস কোথায়!

মোদী স্পিকটি নট! তাই ভারত-পাকিস্তানের সম্পর্ক গত সত্তর বছর পেন্ডুলামের মতো এ দিক থেকে ও দিকে যায়। কিন্তু বিবেক কাটজুর মতো কূটনীতিকও মানতে বাধ্য হন যে, দু’দেশের মধ্যে আলোচনা ছাড়াও রাস্তা নেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE