Advertisement
E-Paper

মায়ানমারি ঝাঁকুনিতে টলোমলো বঙ্গ

হুঁশিয়ারি মিলে গেল যেন কড়ায়-গণ্ডায়! গত জানুয়ারিতে মণিপুরের তামেংলং জেলায় ৬.৭ রিখটার মাত্রার কম্পনের সময়েই ভূ-বিজ্ঞানীরা জানিয়ে দিয়েছিলেন, উত্তর-পূর্ব ভারতের ভূস্তর এতটাই অস্থির যে, সেখানে অদূর ভবিষ্যতে ৮.৫ মাত্রার তীব্র ভূকম্পও হতে পারে।

দেবদূত ঘোষঠাকুর

শেষ আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:৩৩

হুঁশিয়ারি মিলে গেল যেন কড়ায়-গণ্ডায়!

গত জানুয়ারিতে মণিপুরের তামেংলং জেলায় ৬.৭ রিখটার মাত্রার কম্পনের সময়েই ভূ-বিজ্ঞানীরা জানিয়ে দিয়েছিলেন, উত্তর-পূর্ব ভারতের ভূস্তর এতটাই অস্থির যে, সেখানে অদূর ভবিষ্যতে ৮.৫ মাত্রার তীব্র ভূকম্পও হতে পারে। ৮.৫ হল না বটে। তবে বুধবার সন্ধ্যায় এক তীব্র ভূমিকম্প (মার্কিন ভূ-বিজ্ঞান সংস্থার হিসেবে ৬.৯ রিখটার, ইউরোপিয়ান জিওসায়েন্সেস বলছে ৭.২, ভারতের আবহবিজ্ঞান মন্ত্রকের মতে ৬.৮) ফের
নাড়িয়ে দিয়ে গেল উত্তর-পূর্ব ভারতকে।

আর তার রেশ এসে পড়ল কলকাতাতেও। জানুয়ারিতে মণিপুরের ভূমিকম্পটি হয়েছিল ভোরের দিকে। তাই কলকাতা ঠিক তার আঁচ মালুম পায়নি। কিন্তু এ দিন ফিরে এল এক বছর আগের সেই বিধ্বংসী নেপাল-ভূকম্পের স্মৃতি। সে বারের চেয়ে এ বার কলকাতা বেশি নড়েছে কি না, তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হতেও দেরি হয়নি। এ দিন কলকাতায় কম্পনের মাত্রা ছিল ৩ রিখটার।

এ দিন রাত পর্যন্ত অবশ্য ক্ষয়ক্ষতির ছবিটা পরিষ্কার নয়। শিলিগুড়িতে পড়ে গিয়ে তিন জন আহত হয়েছেন। ভয়ে অসুস্থ তিন জন। আতঙ্ক ছড়িয়েছে পড়শি বাংলাদেশেও। চট্টগ্রামে এক বহুতল শপিং মল বিপজ্জনক ভাবে হেলে গিয়েছে। কলকাতায় জোকা-বিবাদী বাগ মেট্রোর নির্মীয়মাণ একটি সেতুতে সামান্য ফাটল ধরেছে।

মার্কিন ভূ-বিজ্ঞান সর্বেক্ষণ সংস্থা (ইউএসজিএস)-র বিশ্লেষণ: এ দিন মায়ানমারের রাজধানী নেপিদওয়ের ৩৬০ কিলোমিটার উত্তরে মাটির ১৩৫ কিলোমিটার নীচে যেখানে ভূমিকম্পটির উৎস, সেটি খুবই অস্থির এলাকা। সেখানে ভূস্তরের ভারতীয় (ইন্ডিয়ান) প্লেট বছরে গড়ে ৪৮ মিলিমিটার হারে ইউরেশীয় প্লেটের ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে। ফলে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বছরভর তিন-চার মাত্রার ভূমিকম্প হয়ে চলেছে, যার অনেকগুলো টের পাওয়া যায় না। কিন্তু ভূস্তরের ঘর্ষণে এক সঙ্গে অনেক বেশি শক্তি নির্গত হলে ৬ রিখটার স্কেলের বেশি ভূমিকম্প তৈরি হয়।

যেমন হল এ দিন সন্ধ্যায়। খড়্গপুর আইআইটি’র ভূ-পদার্থবিদেরা দেখেছেন, এই ভূমিকম্পে নির্গত শক্তি হিরোশিমায় ফাটা পরমাণু বোমার ১২টির সমান (নেপালের ৭ রিখটারের ভূমিকম্পে বেরিয়েছিল ২৪টির সমান শক্তি।) খড়্গপুর আইআইটি’র ভূ-পদার্থবিদ শঙ্করকুমার নাথ বলেন, ‘‘ভূমিকম্পটি হয়েছে আরাকান-ইয়োমা (বর্মা) সাবডাকশন জোনে। ওই তল্লাটে ইন্ডিয়ান প্লেটটি বছরে ২২ মিলিমিটার হারে বর্মা প্লেটের তলায় সেঁধিয়ে যাচ্ছে। এই প্রক্রিয়ায় ওখানকার মাটি সর্বদা উথাল-পাথাল। নির্গত হচ্ছে শক্তি। শক্তি নির্গমনের হার অত্যধিক হয়ে গেলে ইন্ডিয়া প্লেট ছিটকে চলে যায় বর্মা প্লেটের নীচে। তখনই ভূমিকম্পের সৃষ্টি।’’

এ দিন তা-ই হয়েছে বলে শঙ্করবাবুর দাবি। সন্ধে সাড়ে সাতটা নাগাদ উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও কলকাতা তিন বার কেঁপে ওঠে। প্রথম বার দুলুনি, দ্বিতীয় বার ঝাঁকুনি, তৃতীয় বার মৃদু দুলুনি। তবে ভূমিকম্প একটাই। ‘‘ভূকম্পের কেন্দ্রস্থল অনেকটা গভীরে। ১৩৫ কিলোমিটার। যাকে বলে ডিপ ফোকাস আর্থকোয়েক। এতে মাটি তিন ধাপে কাঁপে।’’— ব্যাখ্যা শঙ্করবাবুর।

উপরন্তু খড়্গপুরের বিশেষজ্ঞেরা জানিয়ে দিয়েছেন, এ দিন যেখানে ভূমিকম্প হয়েছে, সেখান থেকে ভবিষ্যতে ৯ মাত্রার প্রবল কম্পন হওয়া আশ্চর্যের নয়। বস্তুত, উত্তর-পূর্ব ভারত ভূকম্পপ্রবণ। বিশ্বের যে পাঁচটি এলাকায় অতি তীব্র ভূমিকম্পের আশঙ্কা, উত্তর-পূর্বাঞ্চল তার অন্যতম। এখানে ভূমিকম্প হতে পারে চারটি ক্ষেত্র থেকে— শিলং খাত, আরাকান-বর্মা খাত (অর্থাৎ মায়ানমার-ত্রিপুরা-চট্টগ্রাম), মিসমি খাত (মায়ানমার লাগোয়া মিসমি পাহাড় এলাকা) ও পূর্ব হিমালয় খাত (সিকিম-দার্জিলিং)। খড়্গপুরের ভূ-পদার্থবিদ্যা বিভাগ ইতিমধ্যে হিমালয়ের ভূকম্পপ্রবণ এলাকা চিহ্নিতকরণের কাজে নেমেছে। প্রকল্পের মুখ্য বিজ্ঞানী শঙ্করবাবুর দাবি, ‘‘মিসমি খাত থেকে সর্বোচ্চ ৮.৭ রিখটারের ভূমিকম্প হতে পারে। আরাকান-বর্মা খাত থেকে ৯ মাত্রার কম্পনের আশঙ্কা। শিলং খাত সর্বোচ্চ ৮.৭ মাত্রার ভূমিকম্পের জন্ম দিতে পারে। আর পূর্ব হিমালয় খাত থেকে তৈরি হতে পারে ৮.৪ মাত্রার ভূমিকম্প।”

ইদানীং নেপাল ও উত্তর পূর্বাঞ্চলে ভূমিকম্পের যে বাড়াবাড়ি, তা কীসের ইঙ্গিত?

ভূ-বিজ্ঞানীরা অবশ্য এতে বিশেষ অস্বাভাবিকতা দেখছেন না। জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া-র অবসরপ্রাপ্ত ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল জ্ঞানরঞ্জন কয়ালের কথায়, ‘‘গোটা উত্তর-পূর্বাঞ্চল অতি ভূমিকম্পপ্রবণ। মাটি সব সময়ে অল্পবিস্তর কাঁপছে। ১০-২০ বছর অন্তর ৬-৭ মাত্রার ভূমিকম্প ওখানে অস্বাভাবিক কিছু নয়।’’

ভূ বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভূমিকম্পের এই তথ্যই ভবিষ্যতের জন্য সতর্কবার্তা। ধরে নেওয়া যায়, কলকাতার মাটি আবার জোরে কেঁপে উঠতে পারে। এ দিন কলকাতায় স্রেফ ৩ রিখটারের ভূমিকম্পেই বাড়ি-ঘর যে ভাবে কেঁপে উঠেছে, তাতে অশনি সঙ্কেত দেখছেন বিশেষজ্ঞেরা। ওঁদের আশঙ্কা, আর একটু বেশি তীব্রতার ভূমিকম্প হলে মহানগরে ঘোরতর বিপর্যয় দেখা দেবে। সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি তো বটেই, প্রাণহানিরও প্রভূত সম্ভাবনা। কারণ, নিরাপত্তা-বিধি মেনে বাড়ি তৈরির অনুশাসন বহু ক্ষেত্রেই মানা হচ্ছে না।

MostReadStories Earthquake Myanmar
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy