Advertisement
০৪ মে ২০২৪

ভাঙা সরকারি বাসে জমাটি ভোটযাত্রা, শেষমেশ ‘ফেভারিট’ সেই অখিলেশই

প্রথমে ছিল বাসের মারাত্মক ঝাঁকুনি। তার পর বচসা। বচসা থেকে মারামারি।ব্রিজলাল যাদব দেখতে নিরীহ। কিন্তু তেজ ভালই আছে। দুর্গাপ্রসাদ মিশ্রর সঙ্গে হাতাহাতিটা একাই চালিয়ে যাচ্ছেন। অন্য দিকে মিশ্রজির দশাসই চেহারা। বচসার মুখ্য বিষয়— অখিলেশ যাদব!

জয়ন্ত ঘোষাল
অমেঠী শেষ আপডেট: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০৩:৩১
Share: Save:

প্রথমে ছিল বাসের মারাত্মক ঝাঁকুনি। তার পর বচসা। বচসা থেকে মারামারি।

ব্রিজলাল যাদব দেখতে নিরীহ। কিন্তু তেজ ভালই আছে। দুর্গাপ্রসাদ মিশ্রর সঙ্গে হাতাহাতিটা একাই চালিয়ে যাচ্ছেন। অন্য দিকে মিশ্রজির দশাসই চেহারা। বচসার মুখ্য বিষয়— অখিলেশ যাদব!

উত্তরপ্রদেশ রাজ্য পরিবহণের বাসটা ঝরঝরে। কিন্তু ঝড়ের গতিতে রওনা দিয়েছে ইলাহাবাদ ‘বাস-আড্ডা’ থেকে। চন্দ্রশেখর আজাদ পুল দিয়ে গঙ্গা পেরোতেই তিড়িংবিড়িং করে লাফাচ্ছে বাস! পাশাপাশি বসেছিলেন মিশ্র আর যাদব। আমি ছিলাম শেষ বেঞ্চের জানলার ধারে। মিশ্র ঘোরতর বিজেপি সমর্থক। কপালে সঙ্কটমোচনের গেরুয়া টিপ। তিনি রাস্তাটা দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘‘এই রাস্তাটা তো আর মোদীজি করে দেবেন না। এটা করার কথা ছিল অখিলেশের। ইসকো কাম
বোলতা হ্যায়?’’

এতেই দপ করে জ্বলে উঠেছেন নিরীহ ব্রিজলাল। নোংরা টেরিকটের জামা, সস্তা প্যান্ট। পায়ে চটি, কিন্তু জামা গোঁজা। মাথার মাঝখানটায় টাক, দু’ধারে সাদা চুল। ব্রিজলালের বক্তব্য, পাঁচ বছরে অখিলেশ রাজ্যটা চালাতে পারলেন কই? দশজন তাঁকে বাগড়া দিয়েছে। এত দিনে তিনি শিবপালদের তাড়িয়েছেন। এ বার সব হবে। ব্যস্। বলা মাত্রই ধুন্ধুমার শুরু।

আরও পড়ুন: দিল্লির এটিএম থেকে বেরিয়ে এল ছেলেখেলার নোট

খোলা জানলা দিয়ে ঢুকছে ধুলো আর গরম হাওয়া। বাসের ভেতরটা বিড়ির গন্ধে ছয়লাপ। মাথার ওপর বাক্স-প্যাঁটরার তাক। নোংরা, ভাঙাচোরা লালরঙা বাস আপাতত থামতে থামতে চলেছে অমেঠী। কত মানুষ, কত কথা! সামনের দরজার পা-দানিতে কন্ডাক্টর। কথার ফোড়নের তাল তালে বাসের গায়ে চাপড়।

এক সময়ে মারামারি থামল। বাসটাও। সামনে একটা রেলগেট। বিশ্বনাথগঞ্জের ছোট স্টেশন। লখনউ থেকে বেনারস যাচ্ছে অজগরের মত একটা মালগাড়ি। প্রচুর খালি সরকারি বাস একের পর এক আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে। রায়বরেলীতে কাল ভোট। আবার অমেঠীতে আগামিকালই রাহুল গাঁধীর জনসভা।

আবার বাস চলেছে। হাইওয়ের ধারে ধানের খেত। আমলকি গাছের জঙ্গল। ইটভাটা, রাস্তার দু’ধারে বড় বড় গ্রামের জোতদারদের সবুজ-হলুদ বাড়ি। ভাল ধান হয়েছে এ বার। জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে গোলাভর্তি ধান, গরু, ট্রাক্টর। বিশ্বনাথগঞ্জ থেকে প্রতাপগড়ের ঘণ্টাঘর চকে এসে একটা রাস্তা চলে যাচ্ছে ফরিদাবাদ-অযোধ্যার দিকে। অন্যটা অমেঠী। এখানে বাস প্রায় খালি হয়ে গেল। দাঁড়াবে আধ ঘণ্টা।

হাইওয়ে থেকে নেমে কাঁচা রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলাম গ্রামের মধ্যে। মুসলিম এলাকা। নিজের মাটির বাড়ির সামনে সেলাই মেশিন চালাচ্ছিলেন জোহরা বাঈ। বসেছিলেন শাশুড়ি আর ছেলেও। চা খেতে খেতে আড্ডা জমল। আর বোঝা গেল, এই গ্রামের মুসলমানরা মায়াবতীকে নয়, ভোট দেবেন অখিলেশকেই। কালো বোরখা পরা জোহরা মুখের আবরণটা অল্প সরিয়ে বললেন, ‘‘বহেনজির লোকেরাও আমাদের গ্রামে নীল শাড়ি উপহার দিতে এসেছিল। নিইনি।’’

আধ ঘণ্টার জায়গায় এক ঘণ্টা পার করে বাসটা ছাড়ল। সিট চেঞ্জ করে এ বার বসেছি দুর্গাপ্রসাদ মিশ্রের পাশে। অমেঠীতেই তাঁর বাড়ি। আমলকি আর হরেক আয়ুর্বেদিক মশলা দিয়ে সর্দি-কাশি-গ্যাস নাশক ওষুধ তৈরি করে এই এলাকায় বিক্রি করেন। দশ টাকা ডিব্বা। অমেঠী পর্যন্ত যেতে যেতে মিশ্রজি বোঝালেন, তিনি বিজেপিকে ভোট দেবেন মোদীর জন্য। স্থানীয় কোনও বিজেপি নেতার জন্য নয়। ব্রাহ্মণ হয়ে বিজেপির কর্মীরা ভোট দিচ্ছে কুর্মি প্রার্থীকে। সে-ও তো মোদীর জন্যই।

অমেঠীতে ঢোকার মুখে বাস থামল চিলবিলা জংশনে। ধুপধাপ পুলিশ উঠল লাঠি হাতে। সবার ছবি তুলল। বাক্স চেক করল। ভোটের জন্য নিরাপত্তার কড়াকড়ি। অমেঠীতে নেমে একদম টাউন বাজারেই দেখলাম, ‘রাজা’ সঞ্জয় সিংহের জীর্ণ প্রাসাদে কংগ্রেসের জনসংযোগ অফিস। একতলার ছোট ঘরে ঘোমটা মাথায় ল্যাপটপ নিয়ে বসে ছোট রানি অমিতা সিংহ। কংগ্রেস প্রার্থী। দলের রাজ্যসভার সদস্য সঞ্জয়ের প্রতি রাহুল খুব প্রসন্ন নন। অমেঠীতে সমাজবাদী পার্টির প্রার্থীও রয়েছেন— গায়ত্রী প্রজাপতি। তাঁর ওপর আবার রুষ্ট অখিলেশ। আর বিজেপির প্রার্থী ‘বড় রানি’ গরিমা সিংহ।

রাহুলের লোকসভা কেন্দ্র অমেঠীর অধীনে রয়েছে চারটে বিধানসভা আসন। তার মধ্যে অমেঠী বিধানসভা কেন্দ্র অশান্তি গত বারেও ছিল। এ বার সনিয়া আসেননি। প্রিয়ঙ্কা দাদার সঙ্গে এক বার এসেই নিয়ম রক্ষা করেছেন। কথা ছিল রাহুল আজই অমেঠীতে চলে আসবেন, সভা করবেন কাল। শেষ মুহূর্তে ঠিক হয়েছে, কাল দিল্লি থেকে সরাসরিই এখানে আসবেন তিনি।

তবে সরকারি বাসে ইলাহাবাদ থেকে অমেঠী আসার পথে আমজনতার নানা মত শুনতে শুনতে একটা কথা স্পষ্ট হয়ে গেল। দলমত নির্বিশেষে সকলেই মুলায়মের অতীতের সমাজবিরোধী রাজনীতির ভাবমূর্তি থেকে আলাদা করে দেখছেন অখিলেশকে। এমনকী মায়াবতীর সমর্থক কামতাপ্রসাদও বললেন, ‘‘বেচারা অখিলেশ গুন্ডাগর্দি মে ফাঁস গ্যায়ে থে।’’ মনে পড়ল, বাসের মিশ্রজির ক্ষোভ ছিল অখিলেশ সরকারের কাজ নিয়ে। খুব একচোট হাতাহাতি করলেন বটে। কিন্তু ব্যক্তি অখিলেশকে নিয়ে গুস্সা নেই তাঁরও। ভালই লাগে ‘ছেলেটাকে’!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Akhilesh Yadav
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE