Advertisement
০২ মে ২০২৪

সংগ্রামী কৃতীদের সংবর্ধনা বরাকে

কয়েক দিন পরই অসমে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকের ফল প্রকাশ। নম্বরের লড়াইয়ে সামনের সারিতে থাকা পড়ুয়াদের আড়ালে হারিয়ে যাবে সংগ্রামী কৃতীরা। পড়াশোনা টাকা কে জোগাবে, তা ভেবে শিক্ষা-জীবনে ইতি টানবে অনেকেই।

মীনা ওরাং (বাঁ দিকে) ও সুমিত্রা দাসকে সংবর্ধনা দেওয়া হচ্ছে। হিমাংশু দে-র তোলা ছবি।

মীনা ওরাং (বাঁ দিকে) ও সুমিত্রা দাসকে সংবর্ধনা দেওয়া হচ্ছে। হিমাংশু দে-র তোলা ছবি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শিলচর শেষ আপডেট: ২৪ মে ২০১৬ ০৩:২৩
Share: Save:

কয়েক দিন পরই অসমে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকের ফল প্রকাশ। নম্বরের লড়াইয়ে সামনের সারিতে থাকা পড়ুয়াদের আড়ালে হারিয়ে যাবে সংগ্রামী কৃতীরা। পড়াশোনা টাকা কে জোগাবে, তা ভেবে শিক্ষা-জীবনে ইতি টানবে অনেকেই।

সে দিকে তাকিয়ে বরাকের সাংস্কৃতিক সংস্থা ‘ছন্দনীড়’ জানিয়ে দিল, সংগ্রামী কৃতীরা মোটেও হারিয়ে যায় না। তাদের পড়ানোর জন্য সমাজে রয়েছেন অনেকে। তাই ছাত্রছাত্রীদের হতাশ না হওয়ার পরামর্শ দিয়ে দুই সংগ্রামী কৃতীকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা হয়।

এক জন মীনা ওরাং। কবে মা-বাবাকে হারিয়েছেন, বলতে পারেন না। পরিচারিকার কাজ করতে গিয়ে পেয়ে যান শিক্ষার আলো। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, বিএ পাশ করেন। শিক্ষক নিযুক্তির যোগ্যতা পরীক্ষায় (টেট) মেধায় অনেককে টেক্কা দিয়ে চাকরি জুটিয়ে নেন।

আর এক জন সুমিত্রা দাস। বাবা ঠেলাচালক। পাঁচ বোন, এক ভাই। তৃতীয় শ্রেণিতে ওঠার পরই বাবা বলেছিলেন, আর পড়ার দরকার নেই। কয়েকটি বাড়িতে কাজ জুটিয়ে দিলেন। শুধু নিজের আগ্রহে কাজের সঙ্গে পড়া চালিয়ে যান সুমিত্রা। কোনও দিন কারও কাছে আঁকা শেখেনি। তবু তাঁর ছবি দেখে বিস্মিত শিক্ষক-শিক্ষিকারা। উচ্চ-মাধ্যমিকে চিত্রকলায় লেটার পান। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফাইন আর্টস বিভাগের ছাত্রী।

জনতা কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষা নন্দিতা দত্তরায় বললেন, ‘‘এমন মেয়েদের কে না সাহায্য করতে চায়!’’ মীনা তাঁর বাড়িতে রয়েছেন সাড়ে চার বছর বয়স থেকে। তিনি জানান, এক দিন এক জনকে একটা কাজের মেয়ে এনে দিতে বলেছিলেন। পর দিনই তিনি মীনাকে নিয়ে আসেন। দেখেই আপত্তি করেন নন্দিতাদেবী। ফিরিয়ে নিতে বলেন তাকে। কিন্তু উধারবন্দের চলিতাকান্দিতে বাড়ি তাঁদের। তখনই কী করে নিয়ে যাবেন! এই ভেবে রাতটা রেখে দিতে বলেন। সে রাতেই কাঁপিয়ে জ্বর আসে মেয়ের। সারারাত বসে থেকে তার মাথায় জল ঢালেন। পর দিন সকালে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। মায়ার বাঁধনে আটকে পড়েন নন্দিতাদেবী। আর ফিরিয়ে দেওয়া হল না তাকে। বরং মৈত্রেয়ী সঙ্ঘের স্কুল বনফুল-এ ভর্তি করিয়ে দিলেন। সেখান থেকে কুলদাসুন্দরী পাঠশালা ও পরে ছোটেলাল শেঠ ইনস্টিটিউটে।

আবৃত্তি, আকস্মিক বক্তৃতা, মহাপুরুষের জীবনী পাঠের জন্য স্কুলে সকলের নজর কাড়েন। দ্বিতীয় বিভাগে মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হন। উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হন দীননাথ নবকিশোর বালিকা বিদ্যালয়ে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানে লেটার পান। মহিলা মহাবিদ্যালয়েও তিনি সবাইকে চমকে দেন, কোনও টিউশন ছাড়া নিয়মিত পড়া দিচ্ছেন সব ক্লাসে! টেট দিয়ে তো সবাইকে অবাক করে দেন। অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণিতে কাছাড় জেলায় সর্বোচ্চ নম্বর তাঁরই জোটে। রামকৃষ্ণ বিদ্যামন্দিরে চাকরি পেয়ে যান। সঙ্গে চলছে গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের দূর-শিক্ষা মাধ্যমে এমএ এবং বিভাগীয় নির্দেশে শিক্ষাতত্ত্বে ডিপ্লোমা গ্রহণ।

মীনা জানান, মা-বাবার কোনও কথা তাঁর মনে নেই। চেহারাও চোখে ভাসাতে পারেন না। দাদা দিনমজুর, ছোট বোন থাকে তাঁরই সঙ্গে। দু’জনের কারও অক্ষরের সঙ্গে পরিচয় হয়নি। নন্দিতাদেবীর কাঁধে মাথা রেখে বলেন, ‘‘ভাগ্য সহায় ছিল বলে মাসীকে পেয়েছিলাম। পড়ছি, চাকরি করছি।’’

একই ভাবে দীননাথ নবকিশোর উচ্চতর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষা স্বস্তিকা দাসের কথা বললেন আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন আর্টস-এর ছাত্রী সুমিত্রা দাস। বাবা অবনীমোহন দাস ঠেলা চালান। প্রথমে তাঁরা ছিলেন জয়পুর হরিনগরে। সুমিত্রা সেখানে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়তেন। শহরে ঠেলা চালালে ভাল রোজগার হবে ভেবে সবাই চলে আসেন রংপুর শিমূলতলায়। এ বার পড়াশোনা? বাবা বললেন, আর দরকার নেই। বরং মানুষের বাড়ি কাজ করলে সংসারের সুবিধা হয়। শেষপর্যন্ত তাই হল। ঝিয়ের কাজ করতে করতে খবর পান রংপুর জ্যোতিকেন্দ্রের। স্কুলে যারা নিয়মিত যেতে পারে না সর্বশিক্ষা মিশন তাদের জন্য জ্যোতিকেন্দ্র খুলেছে। পরে তাঁরাই ভর্তি করায় রামকুমার এমই স্কুলে। সমস্যা দেখা দেয় অষ্টম শ্রেণিতে ওঠার পর। তখন সর্বশিক্ষা মিশন সপ্তম শ্রেণি পর্যন্তই জ্যোতিকেন্দ্রের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করত।

সুমিত্রার কথায়, ‘‘তখন যেটা মনে হয়েছিল সব চেয়ে বড় সমস্যা, সেটাই আসলে সমস্ত সমাধান-সূত্র।’’ দীননাথ নবকিশোর উচ্চতর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। আদৌ পড়া হবে কি না, সংশয় গাঢ়তর হচ্ছিল তাঁর কাছে। সে দিন অভয় দিয়েছিলেন অধ্যক্ষা স্বস্তিকা দাস। কিন্তু মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার সময় তাঁর আশঙ্কা সত্যে পরিণত হচ্ছিল। সারাদিন এ বাড়ি-ও বাড়ি কাজ করে রাতে বই নিয়ে বসলেই ঘরের সকলের সমস্যা। পড়ার আওয়াজ, আলো জ্বালিয়ে রাখায় নাকি ঘুমোতে পারতেন না কেউ। এ ছাড়া, ছোট্ট এক ঘরে আট জনের বসবাস বলে পড়াশোনার পরিবেশও ছিল না। শেষে স্কুলের শিক্ষিকা প্লাবনী পাল তাঁকে তাঁদের বাড়ি নিয়ে রাখেন। সেখানে থেকেই মাধ্যমিক পরীক্ষা দেন তিনি। মাধ্যমিক পাশ করে উচ্চ মাধ্যমিক ভর্তি হতে গিয়ে ফের সঙ্কটে পড়েন। স্বস্তিকা দাসই সমাধান বের করেন। বলেন— ‘‘ভর্তি ফি নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না।’’ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত অবশ্য ভর্তি ফি নিয়ে তাঁকে আর ভাবতে হয়নি। ফাইন আর্টস বিভাগে চতুর্থ সেমিস্টার পরীক্ষা দিয়েছে। সর্বশেষ ফলাফল পর্যন্ত সে-ই ব্যাচের সেরা ছাত্রী।

স্বস্তিকা দাস বলেন, ‘‘শুধু কি আর পড়া! আর্টেও ও অত্যন্ত মেধাবী। যে কোনও ছবি আঁকলে তাকিয়ে থাকতে হয়। চিত্রকলার প্রথাগত শিক্ষা ছাড়াই সবাইকে চমকে দিচ্ছিল। তাই উচ্চমাধ্যমিকে ফাইন আর্টস নিতে বলি। লেটার পায় তাতে। পরে ফাইন আর্টসেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করানো হয়।’’

তাঁর কথায়, সে জন্য শুধু তাঁকে কৃতিত্ব দিলে ভুল করা হবে। ছাত্রীনিবাসে খাওয়ার খরচ প্রথম বছর মৈত্রেয়ী সঙ্ঘ বহন করেছে। পরে চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট শিবব্রত দত্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি ওই খরচ দেবেন বলে জানিয়েছেন। তিনি তা করছেনও।

সুমিত্রা জানান, বিভাগীয় শিক্ষকরাও তাঁকে খুব সাহায্য করেন। বিশেষভাবে উল্লেখ করেন বিভাগীয় প্রধান নির্মলকান্তি রায়ের কথা। তাঁর ইচ্ছা, জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে তাঁর মতো দুঃখকষ্টে থাকা মেয়েদের পাশে দাঁড়াবেন।

ছন্দনীড়ের সাধারণ সম্পাদক ভাস্কর দাস জানান, সব সময় তাঁরা বার্ষিক অনুষ্ঠানে ব্যতিক্রমীদের খুঁজে বের করে সংবর্ধিত করেন। মীনা ওরাং এবং সুমিত্রা দাসই কাল তাদের অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন। পরে মনোজ মুরলী নায়ার ও মনীষা মুরলী নায়ার রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনান। একক নৃত্যানুষ্ঠান ভানুসিংহের পদাবলী পরিবেশন করেন মধুবনী চট্টোপাধ্যায়। মনোজবাবুও গানের শুরুতে মীনা ও সুমিত্রার মত মেয়েদের সংবর্ধিত করার জন্য ছন্দনীড়কে সাধুবাদ জানান। তাঁদের দেখে অন্যরা উতসাহিত হবে, আশাবাদী মনীষাও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Award ceremony Merit student
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE