Advertisement
০২ মে ২০২৪
ভর্তুকির ফিল্ম স্কুল

করের টাকা কেন, পুণের তর্ক শহরেও

সরকারি কোষাগারের টাকায় ফিল্ম ইনস্টিটিউট চালানোর যুক্তি কী, পুণের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউটে (এফটিআইআই) নয়া চেয়ারম্যান নিয়োগের প্রতিবাদে ছাত্র বিক্ষোভ ও লাগাতার ধর্মঘটের আবহে মাথা চাড়া দিচ্ছে এই প্রশ্নও। ফিল্ম ইনস্টিটিউটের পড়াশোনা পুরোটাই চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন জগতের সঙ্গে যুক্ত।

ঋজু বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ জুলাই ২০১৫ ০৪:০৫
Share: Save:

সরকারি কোষাগারের টাকায় ফিল্ম ইনস্টিটিউট চালানোর যুক্তি কী, পুণের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউটে (এফটিআইআই) নয়া চেয়ারম্যান নিয়োগের প্রতিবাদে ছাত্র বিক্ষোভ ও লাগাতার ধর্মঘটের আবহে মাথা চাড়া দিচ্ছে এই প্রশ্নও।

ফিল্ম ইনস্টিটিউটের পড়াশোনা পুরোটাই চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন জগতের সঙ্গে যুক্ত। যাঁরা সেখান থেকে শিখে আসেন, তাঁদের সেই অর্জিত বিদ্যা সবটাই কাজে লাগে পর্দায়। কেউ পরিচালনা, কেউ সিনেমাটোগ্রাফি, কেউ বা সম্পাদনা, শব্দবিন্যাস ইত্যাদিতে পটু। আর সেই সব দক্ষতা কাজে লাগান সিনেমার প্রযোজকেরা। পুণের এফটিআইআই বা কলকাতার সত্যজিৎ রায় ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট (এসআরএফটিআই) থেকে পাশ করা পড়ুয়াদের দিয়ে সিনেমা তৈরি করানো ওই প্রযোজকদের ব্যবসা। তা সে বড় পর্দাতেই হোক বা ছোট পর্দায়।

ফিল্ম ইনস্টিটিউটে বছরে এক-এক জন ছাত্রের জন্য ১০-১২ লক্ষ টাকা খরচ হয় বলে সরকারি সূত্রের খবর। বিপুল ভর্তুকি দিয়ে এই ব্যয় বহন করে সরকার। প্রশ্ন উঠেছে, সিনেমা প্রযোজকদের ব্যবসায়িক ‘স্বার্থ’ রক্ষার খাতিরে সরকার করদাতাদের কোটি কোটি টাকা এই ধরনের ফিল্ম ইনস্টিটিউটের পিছনে ঢালবে কেন? যাঁরা এই সব ইনস্টিটিউট থেকে ‘প্রকৃত’ লাভবান হন, কেন তাঁরা সেই ব্যয়ভার বহন করবেন না?

প্রশাসনিক সূত্রের খবর, ব্যয় সংস্কার কমিশনের একটি পুরনো রিপোর্টেও দেশের ফিল্ম ইনস্টিটিউটের খরচের বিপুল ভার ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির দিকে ঠেলে দেওয়ার কথা উঠেছিল। কেন্দ্রের প্রাক্তন অর্থসচিব পি গীতাকৃষ্ণণ তেমনই সুপারিশ করেছিলেন। কিন্তু একে ফিল্ম ইনস্টিটিউটের বিপুল ব্যয়ভার, সেই বোঝার উপরে শাকের আঁটির মতো এফটিআইআই-এ ছাত্র আন্দোলনের জেরে মাসখানেক ধরে অচলাবস্থা পরিস্থিতি ঘোরালো করে তুলেছে। তার জেরেই কেন্দ্রীয় সরকার ফের সেই পুরনো সুপারিশ নিয়ে চর্চা করছে বলে জল্পনা শুরু হয়েছে।

এফটিআইআই-এর ছাত্ররা জানাচ্ছেন, খোদ কেন্দ্রীয় সরকারের তরফেই ইনস্টিটিউটের দায়মুক্ত হয়ে হাত ধুয়ে ফেলার সম্ভাবনা ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় তথ্য-সম্প্রচার মন্ত্রী অরুণ জেটলির সঙ্গে ইনস্টিটিউটের প্রতিনিধি ও ছাত্রদের বৈঠকেই মন্ত্রী কার্যত তেমনই ইঙ্গিত মিলেছে। আন্দোলনরত ছাত্রদের কোর কমিটির সদস্য রঞ্জিত নায়ারের দাবি, ‘‘মন্ত্রী সরাসরি কিছু বলেননি। কিন্তু আমাদের অনড় দাবির মুখে বেসরকারিকরণের প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়েছেন।’’ পুণের ক্ষেত্রে বেসরকারিকরণের সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে কলকাতার সত্যজিৎ রায় ফিল্ম ইনস্টিটিউটের ক্ষেত্রেও অন্যথা হবে না। তাই গোটা দেশেই সরকারি ফিল্ম স্কুল মহলে আশঙ্কা দানা বাঁধছে।

সরকারি তরফে অবশ্য ফিল্ম স্কুলগুলির ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রকাশ্যে কিছু স্বীকার করা হয়নি। বরং ছাত্রদের সঙ্গে বৈঠকে এফটিআইআইয়ের সামগ্রিক বিকাশে আরও ৮০ কোটি টাকা ব্যয় করার কথাই বলা

হয়েছে। কিন্তু কবে, কী ভাবে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হবে, তার কোনও রূপরেখা না-মেলায় ছাত্রদের মধ্যে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সংশয় তৈরি হচ্ছে।

বিজেপি-ঘনিষ্ঠ অভিনেতা গজেন্দ্র চৌহানকে এফটিআইআই-এর মতো ঐতিহ্যশালী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ বা গভর্নিং কাউন্সিলের কয়েক জন সদস্যের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে আপত্তি যুক্তিযুক্ত বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট অনেকেই। কিন্তু সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার উপরে সম্পূর্ণ নির্ভরশীল ফিল্ম স্কুলগুলিকে এ ভাবে পুষে যাওয়া সরকারের পক্ষেও ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ছে বলে অনেকেরই অভিমত।

খাস ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে যুক্ত অনেকেই ফিল্ম স্কুলগুলিকে নিয়ে সরকারের উপরে চাপের বিষয়টি উড়িয়ে দিতে পারছেন না। তাঁদেরও অভিমত, সরকারি ফিল্ম ইনস্টিটিউটের পরিচালনার দায়িত্ব নিতে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিরই এগিয়ে আসা উচিত। একদা পুণের এফটিআইআই-এর গভর্নিং কাউন্সিলের সদস্য এবং

কলকাতার এসআরএফটিআই-এর প্রাক্তন চেয়ারম্যান তথা চলচ্চিত্রকার গৌতম ঘোষই বলছেন, ‘‘যে অর্থনৈতিক পটভূমিতে সরকারি ভর্তুকির ভরসায় দেশে প্রথম ফিল্ম ইনস্টিটিউটের সূচনা হয়েছিল, সে পরিস্থিতি এখন পাল্টেছে। ভর্তুকি নির্ভর চলচ্চিত্র শিক্ষা এখন চলতে পারে না। ইন্ডাস্ট্রির এই দায়িত্ব নিতে এগিয়ে আসা উচিত।’’

টলিউডের তারকা প্রসেনজিৎ মনে করাচ্ছেন, মুম্বইয়ে তো বটেই টালিগঞ্জেও ইন্ডাস্ট্রির কেউ কেউ নতুন অভিনেতা-পরিচালক-কলাকুশলী তৈরির কাজে যুক্ত। এ দেশের চলচ্চিত্র-সংক্রান্ত শিক্ষায় এফটিআইআই বা এসআরএফটিআই এখন আর মোটেও শিক্ষার্থীদের একমাত্র অবলম্বন নয়। মুম্বইয়েই যেমন চলচ্চিত্র পরিচালক তথা প্রযোজক সুভাষ ঘাই (যিনি আবার এফটিআইআই-এর প্রাক্তনী) নিজে ‘হুইসলিং উড্‌স’ নামে একটি ফিল্মস্কুল গড়ে তুলেছেন, যা দেশ-বিদেশে চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞদের সম্ভ্রম আদায় করে নিয়েছে। চেন্নাইয়ের এল ভি প্রসাদ ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন অ্যাকাডেমিরও নামডাক রয়েছে। প্রসেনজিতের কথায়, ‘‘চলচ্চিত্রকর্মী গড়ে তোলার কাজে ইন্ডাস্ট্রির অবশ্যই শরিক হওয়া উচিত।’’

রাজ্য সরকারের ফিল্ম প্রশিক্ষণ সংস্থা, রূপকলা কেন্দ্রের প্রাক্তন অধিকর্তা এবং এসআরএফটিআই-এর শিক্ষক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ও মনে করেন, ফিল্ম স্কুলগুলির বিষয়ে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির কিছু দায়িত্ব রয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘আইআইটি বা ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলির বহু প্রকল্পেই বেসরকারি শিল্পপতিরা যুক্ত হন। ফিল্ম স্কুলগুলিতেও সেটা হলে আখেরে ছাত্রদের লাভই হবে।’’

তবে এ রাজ্যের প্রভাবশালী সিনেমা ব্যবসায়ী-গোষ্ঠীর মধ্যেই এ বিষয়ে এগিয়ে আসায় জড়তা রয়েছে। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির জন্য প্রতিভার জোগান দিতে তাঁরা কি চলচ্চিত্র শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোর ভার নিতে চান? শুনেই এড়িয়ে যাচ্ছেন ভেঙ্কটেশ ফিল্মস-এর অন্যতম কর্ণধার মহেন্দ্র সোনি ওরফে মণি। তাঁর কথায়, ‘‘এ তো কাল্পনিক পরিস্থিতি নিয়ে (হাইপোথেটিক্যাল) প্রশ্ন। বিষয়টা নিয়ে আমরা ভেবে দেখিনি। আমাদের কিছু বলাও হয়নি।’’

চলচ্চিত্র জগতের ভিতরে কারও কারও মত, ইন্ডাস্ট্রির ভিতর থেকে দক্ষ কর্মী তৈরি করা বা প্রতিভায় শান দেওয়ার কাজে সদিচ্ছাটুকুর অভাবে কারওরই ভাল হচ্ছে না। সাধারণ নাগরিকদের চোখে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি দেশে স্বাস্থ্য বা কারিগরি শিক্ষার সমান গুরুত্বপূর্ণ নয়। তা হলে জনগণের করের টাকায় সরকার কেন প্রধানত ইন্ডাস্ট্রির জন্য কর্মী তৈরি করার কাজ করে যাবে— তা নিয়ে সমাজের নানা স্তরেই সংশয় রয়েছে। অনেকেই মনে করেন, ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ক্ষেত্রে তা-ও সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার যুক্তি থাকতে পারে। কিন্তু চলচ্চিত্রকর্মীদের জন্য কেন একই ব্যবস্থা থাকবে ?

এই যুক্তির বিপরীতে কিছু ভিন্ন স্বরও শোনা যাচ্ছে। পরিচালক তথা এসআরএফটিআই-এর প্রাক্তন চেয়ারম্যান বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত বা সেখানকার বর্তমান ডিন নীলোৎপল মজুমদারের মতে, ফিল্ম থেকে কর বাবদ রাজস্ব জমা হয় সরকারি কোষাগারে। সে-দিক দিয়ে চলচ্চিত্রকর্মী তৈরিতে সরকারের খরচ করা অযৌক্তিক বলা যায় না। তবে টালিগঞ্জের প্রযোজকদের ভূমিকা নিয়ে বুদ্ধদেববাবুরও আক্ষেপ রয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘ফিল্মের কারবারে কোটি টাকা মুনাফার চেষ্টা করছেন যে প্রযোজকেরা, তাঁদের মধ্যেই বা ক’জন কলাকুশলী বা পরিচালক তৈরিতে লগ্নি করেন? অথচ এ ক্ষেত্রে তাঁদের বেশি করে চলচ্চিত্র শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা করা উচিত ছিল।’’ কিন্তু কী ভাবে হবে এই পৃষ্ঠপোষকতা ? প্রযোজক মহলেও তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কলকাতায় প্রিয়া মুভিজের কর্ণধার অরিজিৎ দত্ত বা মুম্বইয়ের সিদ্ধান্ত সিনেভিশন সংস্থার এমডি মনীশ গোস্বামী বলেন, ‘‘গোটা ইন্ডাস্ট্রি কী ভাবে একসঙ্গে হবে? কারা কতটা দায়িত্ব সামলাবে?’’ তাঁদের শঙ্কা, আমলানির্ভর সরকারি কর্তৃপক্ষের হাত থেকে পেশাদার হাতে ফিল্ম স্কুলের ভার গেলে ইতিবাচক কিছু ঘটতেই পারে। তবে স্বচ্ছতা বজায় রেখে পক্ষপাতহীন ভাবে কাজটা করা সব সময়ই চ্যালেঞ্জ।

কারও কারও আবার আশঙ্কা, ইন্ডাস্ট্রির হাতে গেলে চলচ্চিত্র শিক্ষণের খরচ বাড়তে পারে। তাতে নিম্নবিত্ত মেধাবীদের পক্ষে এ ধরনের কোর্সে ঢোকা মুশকিল হবে। তবে প্রযোজক রানা সরকার মনে করেন, ‘‘সরাসরি ইন্ডাস্ট্রির সংস্রবে এসে সেই পরিবেশে কাজ করলে চলচ্চিত্র শিক্ষার্থীদের কিছু সুবিধাও হবে। আর ইন্ডাস্ট্রি ও ফিল্ম স্কুলের গাঁটছড়ায় ঠিকঠাক পরিকল্পনা করা গেলে শিক্ষার খরচ খানিকটা কমিয়ে নিয়ে আসাও সম্ভব।’’

সেই সঙ্গে বেসরকারি হাতে ফিল্ম স্কুলের ভার গেলে আমলানির্ভরতা থেকে মুক্ত হয়ে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার কাজেও শৃঙ্খলা আসতে পারে। ফিল্ম ইনস্টিটিউটগুলিতে অনেক ক্ষেত্রেই ছাত্রেরা ডিপ্লোমা ফিল্ম শেষ করে কোর্স সম্পূর্ণ করতে টালবাহানা করেন বলেও অভিযোগ। এফটিআইআই-এর এক শিক্ষকের আশা, ‘‘প্রতিষ্ঠানের ভার বেসরকারি হাতে গেলে ধর্মঘটের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে ছাত্রেরা সময়ের কাজ সময়ে শেষ করতে তৎপর হবেন।’’

আন্দোলনরত ছাত্রদের মত, চলচ্চিত্র শিক্ষায় ইন্ডাস্ট্রির উপর নির্ভরশীলতাও ভাল নয়। এফটিআইআইয়ের প্রদ্যোতন বেরা বা এসআরএফটিআই-এর অতীশ চট্টোপাধ্যায়রা মনে করেন, শুধু ইন্ডাস্ট্রির বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষাই ফিল্মের ছাত্রদের শিক্ষার উদ্দেশ্য হতে পারে না। বাণিজ্যিক ছবির বাইরে তথ্যচিত্র বা অন্য ধরনের ছবির সঙ্গেও অনেকে যুক্ত হন। এফটিআইআই-এর পডুয়া ঋত্বিক গোস্বামীর মত, ‘‘দেশের

সংস্কৃতি বা নান্দনিকতাবোধের অংশ হিসেবে সিনেমা চর্চার রাস্তাও খোলা থাকা উচিত।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE