Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

গরিবের বরাতেই কি ফাঁসিকাঠ, প্রশ্ন আজও

দণ্ডিতের সাথে দণ্ডদাতা কাঁদে সমান আঘাতে! রাগারাগি নয়, চেঁচামেচি নয়। শান্ত ভাবেই জেলকর্তাদের কাছে সে জানিয়েছিল মনের কথাটি, ‘অনেকেই আমার মতো অপরাধ করেছে। তাদের তো ফাঁসি হয়নি! যাবজ্জীবন হয়েছে। আমি গরিব। তাই আপনারা আমাকে ফাঁসিতে ঝোলালেন।’

এ পি শাহ

এ পি শাহ

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ১২ জুলাই ২০১৫ ০৩:২২
Share: Save:

দণ্ডিতের সাথে দণ্ডদাতা কাঁদে সমান আঘাতে!

রাগারাগি নয়, চেঁচামেচি নয়। শান্ত ভাবেই জেলকর্তাদের কাছে সে জানিয়েছিল মনের কথাটি, ‘অনেকেই আমার মতো অপরাধ করেছে। তাদের তো ফাঁসি হয়নি! যাবজ্জীবন হয়েছে। আমি গরিব। তাই আপনারা আমাকে ফাঁসিতে ঝোলালেন।’

২০০৪ সালের ১৪ অগস্ট। ধর্ষণ ও খুনের দায়ে কলকাতার আলিপুর জেলে ফাঁসি হয়েছিল ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়ের। প্রশ্নটি তুলে গিয়েছিল, তার আয়ু তখন আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা। তার পরে এগারো বছর কেটে গিয়েছে, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে চলেছে দেশ। আজ একই খেদ দণ্ডদাতার মুখে! ‘‘এ দেশে সাধারণত গরিব ও পিছিয়ে পড়া মানুষের ভাগ্যেই মৃত্যুদণ্ড জোটে। ওটা গরিবেরই বিশেষ অধিকার।’’ কথাগুলি বলেছেন প্রাক্তন বিচারপতি এ পি শাহ। দেশের আইন কমিশনের প্রধান।

দীর্ঘদিন ধরেই মৃত্যুদণ্ড তুলে দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করছেন দেশের চিন্তাবিদ ও আইন বিশেষজ্ঞদের একাংশ। বিষয়টি নিয়ে সমাজের বিভিন্ন অংশের মত সংগ্রহ করে একটি রিপোর্ট জমা দিতে আইন কমিশনকে নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। সেই প্রক্রিয়ারই অঙ্গ হিসেবে আজ বেশ কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তির মত নেন আইন কমিশনের সদস্যেরা। সেখানে বিষয়টি নিয়ে তীব্র মতভেদ প্রকাশ পেয়েছে।

আজমল কসাব বা আফজল গুরুর ফাঁসির ক্ষেত্রে সন্ত্রাস ও রাজনীতির অন্য মাত্রা থাকলেও ধনঞ্জয়ের শাস্তির পরে এই এগারো বছরে আরও অনেক মৃত্যুদণ্ড হয়েছে এ দেশে। ফাঁসিতে গরিবের ‘অধিকার’ নিয়ে বিতর্কের নিষ্পত্তি হয়নি আজও। এখন যখন প্রশ্ন, আদৌ মৃত্যুদণ্ড চালু থাকা উচিত কি না— তখনও শাস্তির ক্ষেত্রে আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের প্রশ্ন উঠে আসছে বারবার। একই প্রশ্ন উঠেছে বহুচর্চিত আরুষি হত্যা মামলাতেও। প্রথমে অভিযুক্ত হিসেবে পরিচারকদের চিহ্নিত করা হলেও পরে নিহত কিশোরীর বাবা ও মায়ের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে নিম্ন আদালতে। মামলা উচ্চ আদালতের বিচারাধীন। আম আদমির মনে প্রশ্ন রয়ে গিয়েছে।

অনেকেইে প্রশ্ন তুলেছেন, যাবজ্জীবন কেন? প্রভাবশালী বলে? নিঠারি মামলাতেও এতগুলি শিশু-কিশোরীর মৃত্যুর পরে প্রাণদণ্ডের রায় হয়েছিল মণীন্দ্র সিংহ পান্ধের ও তাঁর বাড়ির পরিচারক সুরেন্দ্র কোহলি— দু’জনেরই। হাইকোর্টে পান্ধের বেকসুর ছাড়া পান ওই মামলায়। তাঁর বিরুদ্ধে এখনও ৫টি মামলা ঝুলে। আর কোহলির সাজা যাবজ্জীবনে পরিণত হয়েছে পরে। কোনও নির্দিষ্ট মামলার প্রসঙ্গ না তুলেও এ পি শাহের অকপট স্বীকারোক্তি, ‘‘আমাদের বিচারব্যবস্থায় অসঙ্গতি আছে। অপরাধের সাজা দেওয়ার বিকল্প মডেলের কথা ভাবা উচিত। মৃত্যুদণ্ড নিয়েও ফের ভাবা প্রয়োজন।’’

আইন কমিশনে আজ সারা দিনের আলোচনায় দেখা গিয়েছে চিন্তাবিদ ও আইনজীবীরা এই প্রশ্নে কার্যত দ্বিধাবিভক্ত। মৃত্যুদণ্ড তুলে দেওয়ার পক্ষে জোর সওয়াল করেছেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এ পি জে আব্দুল কালাম, পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গাঁধী, ডিএমকে নেত্রী কানিমোঝি-রা। আবার মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখার পক্ষেও জোরদার যুক্তি দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের দুষ্মন্ত দাভের মতো ব্যক্তিরা। গোপালকৃষ্ণ গাঁধীর কথায়, ‘‘কোনও মানুষের প্রাণ কেড়ে নেওয়া রাষ্ট্রের হাতে থাকা একটি বিশেষ সুবিধে। রাষ্ট্রের উচিত কাউকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে দায়মুক্তির শর্টকাট না নিয়ে অপরাধের ঠিক মতো তদন্ত করা।’’

এই প্রসঙ্গে উঠে এসেছে ‘বিরলের মধ্যে বিরলতম’ অপরাধের সংজ্ঞা এবং রাষ্ট্রপতির কাছে যাওয়া প্রাণভিক্ষার আর্জি নিয়ে সিদ্ধান্তে বিলম্বের প্রসঙ্গও। ‘বিরলের মধ্যে বিরলতম’ অপরাধ কোনটি, তা নিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই একপেশে সিদ্ধান্ত হয় বলে মনে করেন প্রাক্তন বিচারপতি বিলাল নাজকি। তাঁর কথায়, ‘‘বিচারপতিদেরও অনেক মানসিক বোঝা থাকে। তাই এই ধরনের একতরফা সিদ্ধান্ত হয়। উচ্চ আদালতে যাঁরা বিচারপতি হচ্ছেন, তাঁদের অনেকেই স্পর্শকাতর বিষয় বিবেচনার মতো শিক্ষা পান না।’’ নাজকির দাবি, সংবাদমাধ্যমের প্রচারও অনেক সময়ে বিচারপতিদের মনে প্রভাব ফেলে।

রাষ্ট্রপতির কাছে ফাঁসির আসামির প্রাণভিক্ষার আর্জি ঝুলে থাকা নিয়ে বিতর্ক কম নয়। বছরের পর বছর প্রাণভিক্ষার আর্জি পড়ে থাকার কারণে বেশ কয়েক বার মৃত্যুদণ্ডের আদেশ খারিজ করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। রাজীব গাঁধী হত্যা মামলার তিন আসামিও এ ভাবেই ফাঁসিকাঠ থেকে মুক্তি পেয়েছিল। আজ আইন কমিশনের আলোচনাসভায় কংগ্রেস নেতা ও আইনজীবী মণীশ তিওয়ারি বলেন, ‘‘আইনি ও সরকারি প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পরে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আর্জি পাঠানো হয়। তাই এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে রাষ্ট্রপতির বেশি দেরি করা উচিত নয়। বর্তমান রাষ্ট্রপতি তাঁর পূর্বসূরিদের চেয়ে এই বিষয়ে অনেক স্পষ্ট সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।’’ মণীশের মতে, এই বিষয়ে রাষ্ট্রপতির নিজের মতামত না প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া, কোনটিকে গুরুত্ব দেওয়া হবে তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে আলোচনা হওয়া উচিত।

ধনঞ্জয়ের প্রাণভিক্ষার আর্জি খারিজ হয়েছিল এ পি জে আব্দুল কালাম রাষ্ট্রপতি থাকার সময়ে। প্রাণভিক্ষার আর্জি নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে কঠিন সমস্যায় পড়েছিলেন, এ দিন তা অকপটেই জানিয়েছেন কালাম। তার চেয়েও তাৎপর্যপূর্ণ, আর্থ-সামাজিক বৈষম্য নিয়ে তাঁর মন্তব্য। কালামের কথায়, ‘‘যে সব মামলার আর্জি আমার কাছে এসেছিল সেগুলির প্রত্যেকটির মধ্যেই সামাজিক ও আর্থিক বৈষম্যের ইঙ্গিত ছিল।’’

মৃত্যুদণ্ডের বিপক্ষে যাঁরা, তাঁরা মনে করেন, বিচার ব্যবস্থার উদ্দেশ্য অপরাধীর সংশোধন। প্রাণদণ্ড না হলে হলে নিজের অপরাধের গুরুত্ব বুঝতে পেরে অপরাধী নিজেকে বদলে ফেলার একটা সুযোগ অন্তত পায়। অন্য দিকে মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে সওয়ালকারীরা মনে করেন, সমাজের পবিত্রতা যে ক্ষেত্রে ক্ষুণ্ণ হয়, সে ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডের ব্যবস্থা থাকা উচিত। কারণ এই ধরনের অপরাধ যারা করে, তারা আর নিজেকে সংশোধনের পরোয়া করে না। চিন্তাবিদ ও আইনজীবীদের এই অংশের মতে, মৃত্যুদণ্ড রাষ্ট্রের প্রতিশোধের হাতিয়ার নয়। রাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে সমাজের বিবেক বাঁচিয়ে রাখার কাজ করছে।

প্রবীণ আইনজীবী ও লোকসভার প্রাক্তন স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের বিশ্লেষণ, গরিবেরা জোরালো আইনজীবী নিযুক্ত করতে পারেন না বলেই হয় তো মৃত্যুদণ্ডের মতো শাস্তির মুখে পড়েন। তাঁর কথায়, ‘‘সুপ্রিম কোর্ট তো এখন বলেছে, বিরলতম শাস্তির ক্ষেত্রেই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া উচিত। তবে এই ধরনের শাস্তির ক্ষেত্রে সব দিক যাচাই করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।’’

বম্বে হাইকোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি চিত্ততোষ মুখোপাধ্যায়ের মতে, ‘‘মৃত্যুদণ্ডকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হিসেবে দেখা উচিত। তাই এটা উঠে

যাওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। মৃত্যুদণ্ডের ভয় অপরাধীদের মধ্যে কাজ করে।’’ তাঁর মতে, বিরলতম অপরাধের ক্ষেত্রেই এই ধরনের শাস্তি দেওয়া হয়। সুপ্রিম কোর্টও একই কথা বলেছে। এ ক্ষেত্রে শুধু অপরাধের গুরুত্ব নয়, সমাজের উপরে তার প্রভাবটাও বিচার করা হয়। কী ধরনের অপরাধকে বিরলতম বলা হবে, সুপ্রিম কোর্ট তার একটি সংজ্ঞাও দিয়েছে। তবে অনেক অপরাধের সময় অপরাধীর মানসিক ভারসাম্য ঠিক থাকে না। সে ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ড তার কাছে কতটা অর্থপূর্ণ সে প্রশ্ন থেকেই যায়, মেনে নিয়েছেন চিত্ততোষবাবু।

সুপ্রিম কোর্ট মৃত্যুদণ্ডকে বিরলতম অপরাধের ক্ষেত্রে বহাল রাখার কথা বললেও শীর্ষ আদালতের প্রাক্তন বিচারপতি এবং রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান অশোক গঙ্গোপাধ্যায় মৃত্যুদণ্ডকে সমর্থন করেন না। তাঁর মতে, ‘‘এটা ভারতীয় সংবিধানের মূল ভাবধারার পরিপন্থী। কারণ, আদালতের রায়ে মানুষের ব্যক্তিগত অধিকার খর্ব হয়ে যাবে, এটা খুব শক্ত ব্যাপার। ’’

মৃত্যুদণ্ডকে সমর্থন না করার পিছনে আরও একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের এই প্রাক্তন বিচারপতি। তিনি বলছেন, ‘‘আদালতে বিচার হয় পুলিশি তদন্ত ও সাক্ষীসাবুদের ভিত্তিতে। পুলিশি তদন্তে প্রচুর গরমিল থাকে। সাক্ষীসাবুদ জোগাড় করার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এ সবের ভিত্তিতে কারও জীবন নিয়ে নেওয়া ঠিক হতে পারে না। এটা অনেক সময়ই বিপজ্জনক সিদ্ধান্ত।’’ তাঁর মতে, পুলিশি তদন্তে গরিব লোকেরাই শিকার হন। ধনী এবং প্রভাবশালী লোকেরা বরং নানা উপায়ে সে সব এড়িয়ে যেতে পারেন। তার ফলেই মৃত্যুদণ্ডের ক্ষেত্রেও গরিবেরাই শিকার বেশি হন।

তবে কি বিরলতম অপরাধের ক্ষেত্রেও মৃত্যুদণ্ড তুলে দেওয়া উচিত?

অশোকবাবু বলছেন, ‘‘সে ক্ষেত্রে যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া যেতে পারে। মৃত্যুদণ্ডের ভয়ে কি অপরাধ কমেছে?’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE