‘লক্ষ্য’ ছবিতে প্রীতি জিন্টা অভিনীত চরিত্রটি গড়া হয়েছিল বরখা দত্ত-র আদলেই
সীমান্তের সামনে এসে দাঁড়ালেই কেন জানি না মনে হয়, আমি এক প্রহরী। সাংবাদিক হিসাবে কাশ্মীর সীমান্ত বহু বছর ধরে দেখছি। সীমান্ত মানেই যেন মনে হয় নিরাপত্তার অভাববোধ। সীমান্ত মানেই যেন মনে হয় এই ভূখণ্ডকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমার। যে সেনা জওয়ানটি কারগিলের যুদ্ধের সময় রক্ত ঝরিয়ে লড়াই করেছিল দেশের জন্য, সেই দেশটা শুধু জওয়ানটার দেশ নয়। সেই দেশটা তো আমারও। এ এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। এক বিপন্ন অনুভূতি।
অথচ দেখুন, এই সীমান্তটা ঈশ্বর রচনা করেননি। এই সীমান্তটা আমি অথবা আপনি রচনা করেননি। এই সীমান্তটা রচনা করেছে দেশভাগ। এই সীমান্তটা রচনা করেছে কায়েমি স্বার্থ। এই সীমান্ত রচনা করেছে তথাকথিত রাজনেতা। দেশভাগ উচিত কি উচিত ছিল না— সেই বিতর্ক তৈরি করাটা আমার লক্ষ্য নয়। কোনও বিভাজনই তো আমার পছন্দ নয়। মানবজমিনে কীসের সীমানা! এক দিকে আমরা বিশ্বায়নের বড় বড় কথা বলছি। এক দিকে আমরা বলছি, ক্ষুদ্র থেকে বৃহতে পৌঁছতে হবে। তা সে হৃদয়ই হোক কি বাজারই হোক। অথচ আমরাই পাঁচিলের পর পাঁচিল তুলে যাচ্ছি।
কাঁটাতারের পর কাঁটাতার। মশারির মধ্যে মশারি। এক দিকে বৃহৎ হওয়ার চেষ্টা। আর এক দিকে সীমান্তে রক্তপাত। সাংঘাতিক এক আত্মপ্রবঞ্চনা। রাষ্ট্রপুঞ্জে শান্তির সাদা পায়রা ওড়ে হাডসন নদীর ওপরে। সেই সাদা পায়রায় রক্তের দাগ লাগে গাজার স্ট্রিপে, অথবা ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন সীমান্তে। ইরান ইরাকে। উত্তর এবং দক্ষিণ কোরিয়ায়। পূর্ব এবং পশ্চিম জার্মানিতে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি শান্তির ললিত বাণী শোনায়, আবার যুদ্ধাস্ত্র বিক্রি করাকে শিশুর মিল্ক পাউডার বিক্রি করার থেকে বেশি জরুরি বলে মনে করে।
আসলে সীমান্ত তো শুধু ভৌগোলিক বস্তুগত একটা বিষয় নয়। সীমান্ত একটা মানসিক অবস্থান। সীমান্ত মানে একটা প্রান্তের শেষ, আর একটা প্রান্তের শুরু। সীমান্ত আমরা-ওরার বিভাজিকা রেখা। সীমান্ত এক-কে বহু করার চেষ্টা।
এক বার পাকিস্তানে গিয়ে দেখেছিলাম সীমান্তের ও-পার থেকে এ-পারকে দেখতে কেমন লাগে। পাকিস্তানেরও মন আছে। সেই মনে ভারত-বিদ্বেষ আছে কি? সীমান্তের এ-পারে এসে মনে হয়, প্রতিটি পাক নাগরিক ভারতবিদ্বেষী। আবার লাহৌরের আনারকলি বাজারে গিয়ে বিন্দাস। আমি তো পঞ্জাবি। আনারকলি বাজারে গিয়ে মনে হল, এ তো দিল্লির চাঁদনি চক। পঞ্জাবি দোকানদার আর ব্যবসায়ীরা তো ভারতীয় দোকানদার আর ব্যবসায়ীদের মতনই। তারা কোনও ভাবেই ভারতবিরোধী নয়। তবে এটা ঠিক, ৭০ বছর ধরে ওরাও শুনে আসছে— ভারত অবিচার করেছে। ভারত যুদ্ধবাজ। ভারত এখনও পাকিস্তানের জমি-পিপাসু। কাশ্মীরের পুরো দখল নিয়ে নিয়েছে ওরা। শৈশব থেকে এ-সব কথা শুনতে শুনতে যে প্রভাব পড়েছে পাকিস্তানের মনস্তত্ত্বে, সেটা তো ভারত রাষ্ট্র সম্পর্কে। ভারতের নাগরিকদের সঙ্গে সীমান্ত বিরোধ কোথায়?
সীমান্ত আসলে একটা সত্তা। আমাদের অনেকগুলি পরিচিতি থাকে। আমি বরখা দত্ত, জন্মসূত্রে একজন পঞ্জাবি। সেটা আমার একটা ক্ষুদ্র সত্তা। আমি ভারতীয়। সেটা আমার একটা বৃহত্তর সত্তা। কাজেই পঞ্জাব সীমান্ত থেকে আমি ভারতের সীমান্তে এসে পৌঁছেছি। আবার ভারতীয় হলেও আমি আজ এক বিশ্বনাগরিক। সাংবাদিক হিসেবে গোটা পৃথিবীর বহু প্রান্ত ঘোরার সুযোগ হয়েছে। কখনও সার্ক, কখনও জি-২০, কখনও রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ অধিবেশন— কত ধরনের বহুপাক্ষিক মঞ্চ। সেখানে সীমান্ত কোথায়? আসলে সীমান্ত যদি ভৌগোলিক প্রয়োজনীয়তার কারণে হয়, তবে সে এক রকম। আর সীমান্ত যদি হয়ে ওঠে অসহিষ্ণু, তবে সে সীমান্তকে নিয়ে বড় বিপদ। অনেক সময় রাজনৈতিক অবস্থান এক ধরনের কৃত্রিম, মেকি অসহিষ্ণুতা তৈরি করে, যাকে রাষ্ট্রনেতারা রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেন। এই যুদ্ধং দেহি মনোভাবের নাম দেওয়া হয় দেশাত্মবোধ। অথচ পারভেজ মুশারফ থেকে নওয়াজ শরিফ— ইন্টারভিউ নিতে গিয়ে দেখেছি, তাঁরাও আমাদের মতো রক্ত-মাংসের মানুষ। হিন্দি ছবি দেখেন। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শোনেন। খেতে এবং আড্ডা মারতে ভালবাসেন।
মানবিকতার কোনও সীমান্ত আছে কি!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy