নেতা বড়? না অন্দোলন বড়?
নেতা আন্দোলনের জন্ম দেন? নাকি আন্দোলন নেতার জন্ম দেয়?
খুব বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রশ্নটা। এবং এই প্রশ্নটার জবাব খোঁজার জন্য ইরম চানু শর্মিলাকে নিয়ে পর পর দু’দিন কলম ধরতে হচ্ছে।
যে প্রশ্নটা উঠে এসেছে, তার উত্তর খোঁজা বড় সহজ কাজ নয়। ইতিহাসের পাতা ওল্টালে দেখা যায়, কোনও ক্ষেত্রে নেতা আন্দোলনের চেয়ে অনেক বড় হয়ে উঠেছেন। আবার কোথাও আন্দোলনই নেতার জন্ম দিয়েছে।
গাঁধীজির নেতৃত্বে ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে প্রথম সর্বাত্মক এবং বৃহৎ আন্দোলন ছিল অহিংস অসহযোগ আন্দোলন। সে আন্দোলনের গাঙে যখন ভরা জোয়ার, তখন হঠাৎ হিংসার প্রকাশ ঘটল। চৌরিচৌরায় জ্বালিয়ে দেওয়া হল থানা, পুড়িয়ে মারা হল পুলিশকর্মীদের। মুহূর্ত বিলম্ব না করে মহাত্মা গাঁধী আন্দোলনের সমাপ্তি ঘোষণা করেছিলেন। বিভিন্ন মহল প্রতিবাদ করার চেষ্টা করছিল। গাঁধীর সিদ্ধান্তের সমালোচনা শুরু হয়েছিল। কিন্তু নেতা অবস্থানে অনড় ছিলেন— হিংসাকে প্রশ্রয় দেবেন না। নেতারই জয় হয়েছিল। কেউ স্বেচ্ছায়, কেউ হয়তো অনিচ্ছায়, আন্দোলন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তই মেনে নিয়েছিলেন। নেতার আদর্শেই আস্থা রেখেছিলেন অনুগামীরা। তার ফলও ফলেছিল। গাঁধীজি জীবদ্দশাতেই স্বাধীন ভারত দেখে গিয়েছিলেন, দেশবাসীকে স্বাধীন ভারত দেখিয়ে গিয়েছিলেন।
বছর কয়েক আগে আরও একটি বৃহৎ জনআন্দোলন দেখেছে ভারত। দিল্লি ছিল সে আন্দোলনের ভরকেন্দ্র। তবে ভারতের বিরাট অংশ একাত্ম ছিল সেই আন্দোলনের সঙ্গে। ‘লোকপাল’ আন্দোলন। ‘গাঁধীবাদী’ অণ্ণা হজারের নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল ঠিকই। তবে সে আন্দোলন আরও অনেক নেতার জন্ম দিয়েছিল। দিল্লির বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীবালও সেই আন্দোলনেরই সন্তান। লোকপাল আন্দোলন মূলত দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলন ছিল। কিন্তু আন্দোলনের প্রাবল্য নেতার ব্যক্তিত্বকে ছাপিয়ে গিয়েছিল। ফলে নেতা আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিয়ে নিজেই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেলেন। আর আন্দোলনের সুবাদে জন্ম নেওয়া নেতাদের অনেকে মসনদে পৌঁছে গেলেন। অনেকে আবার হারিয়েও গেলেন। দিনের শেষে আন্দোলনটা আর কোনও লক্ষ্যে পৌঁছল না।
এই দুই পরিস্থিতির সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আজ মণিপুর। ইরম চানু শর্মিলা দীর্ঘ ষোলো বছর পর অনশন প্রত্যাহার করেছেন। দীর্ঘ সংগ্রামে যে জনসমর্থন অর্জন করেছেন, তাকে সম্বল করে রাজনৈতিক ক্ষমতার অলিন্দে পৌঁছনোর লড়াইতে নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। রাজনৈতিক কর্তৃত্ব অর্জন করেই মণিপুর থেকে আফস্পা প্রত্যাহার করবেন বলে স্থির করেছেন।
ভুল কী করেছেন ইরম চানু শর্মিলা? দীর্ঘ ১৬ বছর অনশন করেও যখন লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেননি, তখন গণতান্ত্রিক উপায়েই অন্য কৌশল অবলম্বন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। লক্ষ্যে পৌঁছনো যাবে কি না, তা স্থির করার ভার অনির্দিষ্টের হাতে ছেড়ে না দিয়ে, সদর্থক পদক্ষেপ করেছেন। কিন্তু নেতার এই সিদ্ধান্তের পর সংগঠনের বৃহদংশই নেতার বিরুদ্ধে তীব্র বিক্ষোভে মত্ত। অনশন প্রত্যাহারের পর জামিনে মুক্ত শর্মিলা হাসপাতাল ছেড়ে যতগুলি ঠিকানায় ঠাঁই নেওয়ার চেষ্টা করেছেন, ততগুলি জায়গাতেই অযৌক্তিক, উন্মত্ত বিক্ষোভ দেখিয়ে শর্মিলাকে হাসপাতালে ফিরে যেতে বাধ্য করেছে তাঁর সংগঠন।
অর্থাৎ সংগঠন তথা আন্দোলন নেতাকে ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। নেতার আদর্শে বা নেতার দেখানো পথে আর চলতে রাজি নন অনুগামীরা। তাঁরা চান নেতা তাঁদের দেখানো পথে চলুন। অর্থাৎ মণিপুরে আফস্পা বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীরা এখন সকলেই পথপ্রর্দশক তথা নেতা, অনুগামী শুধু ইরম চানু শর্মিলা। এমনটাই হোক চাইছেন শর্মিলার সংগঠনের লোকজন।
শর্মিলা অনশন শুরু করেছিলেন স্বেচ্ছায়। প্রত্যাহার করার অধিকারও তাঁরই। শর্মিলার সমর্থনে এগিয়ে এসেছিলেন যে বিশাল সংখ্যক, তাঁরাও এসেছিলেন স্বেচ্ছায়। শর্মিলা তাঁদের বাধ্য করেননি। শর্মিলার পথ পছন্দ না হলে, সরে যাওয়ার পূর্ণ অধিকার রয়েছে এঁদের। কিন্তু শর্মিলাকে অনশনে আটকে রাখার চেষ্টা করার বিন্দুমাত্র অধিকারও তাঁদের নেই।
আন্দোলন জীবনের স্বার্থে। জীবন আন্দোলনের স্বার্থে নয়। সত্যাগ্রহের স্বার্থে দীর্ঘদিন স্বাভাবিক জীবন থেকে বিমুখ থাকার পরও যখন মণিপুরকে স্বাভাবিক জীবন দেওয়া গেল না, শর্মিলা তখন স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসে এক অন্য পদ্ধতিতে লড়তে চাইছেন। সমর্থন করুন বা না করুন, এতে তাঁকে বাধা দেওয়ার অধিকার কারওর নেই।
মনে রাখবেন, যে আন্দোলন তার নেতাকে ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, লক্ষ্যে পৌঁছনো তার পক্ষে খুব শক্ত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy