স্বঘোষিত গোরক্ষকদের মার। গত ডিসেম্বরে ঝাড়খণ্ডে। ছবি: সংগৃহীত
কট্টরবাদীদের এই বাড়বাড়ন্তের জন্য কি নরেন্দ্র মোদীকে সরাসরি দোষারোপ করা সম্ভব? কেন্দ্রে তাঁর সরকার আসার পর থেকেই দেশে অসহিষ্ণুতার বাতাবরণ বেড়েছে, সে কথা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী কি কখনও সমর্থন করেছেন এই হিংসাকে? প্রধানমন্ত্রী তো একাধিক বার এই হিংসার বিরুদ্ধে বার্তা দিয়েছেন। সাবরমতী আশ্রমের শতবর্ষ পূর্তির অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, ‘‘গো-ভক্তির নামে মানুষ খুন মেনে নেওয়া যায় না।’’ ২০১৭ সালে সংসদের বাদল অধিবেশন শুরু হওয়ার আগের দিন ফের নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, গোরক্ষার নামে হামলা বরদাস্ত করা হবে না, রাজ্যগুলি এর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করুক। এর পরেও কি মোদীকে দায়ী করা যাবে?
আরও পড়ুন: নিকা হালালায় নারাজ, মারার হুমকি ফরজ়ানাকে
অধ্যাপক উদয়ন বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘‘মোদীকে সরাসরি দায়ী করা কঠিন। এমনকি, আরএসএস-কেও সরাসরি দায়ী করা যায় না। কারণ আরএসএস যে হিন্দুত্বের কথা বলে, তার সঙ্গে এই তথাকথিত গোরক্ষা কর্মসূচির কোনও মিল নেই। আরএসএসেরও গো-সেবা কর্মসূচি রয়েছে। কিন্তু সেই কর্মসূচির নামে হিংসাত্মক আক্রমণ বা হামলা আরএসএস করেছে, এমন নজির নেই। শ্রীরাম সেনা, রাজপুত করণী সেনা— এই সব সংগঠন কিন্তু হামলাগুলো করছে।’’
তা হলে কি বিজেপি বা আরএসএস এই হিংসার জন্য দায়ী নয়? উদয়নের ব্যাখ্যা, ‘‘দায়ী তো বটেই। আসলে একটা প্যান্ডোরার বাক্স খুলে দেওয়া হয়েছে। গোরক্ষার নামে মানুষ খুন করতে হয়তো নরেন্দ্র মোদী বলেননি। কিন্তু কট্টরবাদকে প্রশ্রয় দিয়েছেন। তাই নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতাসীন হওয়ার পরে কট্টরবাদীরা উৎসাহিত হয়েছেন। দেশে এখন তাঁরা যা বলবেন, তেমনই হবে— কট্টরবাদীরা এমনই ভাবতে শুরু করেছেন।’’
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আর এক অধ্যাপক বিশ্বনাথ চক্রবর্তী অবশ্য প্রাথমিক দায় নরেন্দ্র মোদীদের উপরেই চাপাতে চান। তাঁর কথায়, ‘‘এই রকম পরিস্থিতি তো হওয়ারই ছিল। যে দলটা দেশ শাসন করছে, কোনও একটি ধর্ম বা সম্প্রদায়ের প্রতি পক্ষপাতমূলক আচরণ যদি সে দল করে, তা হলে এই রকম পরিস্থিতিই তৈরি হয়। শাসক দল যাঁদের পাশে নেই বলে বোঝা যায়, তাঁদের উপরে হামলা বাড়ে।’’
এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রশাসন কতটা আগ্রহী, তা নিয়েও বিশেষজ্ঞদের সংশয় রয়েছে। তাঁরা বলছেন, গোরক্ষার নামে হামলা বন্ধ করার দায় রাজ্যগুলির উপরে চাপিয়ে হাত ধুয়ে ফেলতে চেয়েছেন মোদী। কিন্তু রাজ্যগুলিও কট্টরবাদীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করার দায় নিজেদের উপরে নিতে চাইছে না। বিভিন্ন রাজ্যের বিজেপি সরকার নীরব থাকছে। কট্টরবাদীদের তারা সরাসরি সমর্থন করছে না ঠিকই। কিন্তু নীরব প্রশ্রয় দিয়ে রাজনৈতিক লাভ ঘরে তুলতে চাইছে।
কী ভাবে মুক্তি মিলবে এই পরিস্থিতি থেকে? অধ্যাপক উদয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যাখ্যা, ‘‘প্রশাসনিক পদক্ষেপই সর্বাগ্রে জরুরি। কিন্তু তার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা চাই। সেটা এ দেশে প্রায় কোনও দলের নেই। বিজেপি শুধু নয়, কংগ্রেস বা অন্যান্য দল যে সব রাজ্যে ক্ষমতায়, সে সব রাজ্যেও স্বঘোষিত গোরক্ষকদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ হচ্ছে না। কারণ বিজেপি-র কট্টর হিন্দুত্বের মোকাবিলা করতে গিয়ে কংগ্রেস-সহ অন্য অনেক দলই এখন নরম হিন্দুত্বের লাইন নিয়েছে। তাই কেউই তথাকথিত গোরক্ষকদের চটাতে চায় না।’’
গোরক্ষকদের তাণ্ডবেই অবশ্য শেষ নয় সমস্যার। ছেলেধরা গুজবে পিটিয়ে মারার প্রবণতাও আচমকা হু হু করে ছড়িয়েছে গোটা দেশে। এই ধরনের ঘটনা আগে খুব বেশি ঘটত না। কিন্তু গত দেড় বছরে বিভিন্ন রাজ্য থেকে এই ধরনের একের পর এক ঘটনার খবর আসতে শুরু করেছে। ২০১৭-র ১ জানুয়ারি থেকে ২০১৮-র ৫ জুলাই পর্যন্ত ছেলেধরা গুজবের শিকার কত জন? দেখে নেওয়া যাক এক ঝলকে: